ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » প্রবাসের চিঠি » বিস্তারিত

'আসুন আমরা বাংলাদেশকে সার্বজনীন করি'

২০১৭ সেপ্টেম্বর ২৫ ১৬:৪০:৫৯
'আসুন আমরা বাংলাদেশকে সার্বজনীন করি'

শিতাংশু গুহ, নিউইয়র্ক : শুরুতেই সবাইকে দুর্গা পূজার শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখি। দুর্গাপূজা আসলে সুর এবং অ-সুরের মধ্যে লড়াই। সুর অর্থ সুন্দর এবং অ-সুর অর্থ অসুন্দর। যাহা সুন্দর তাহা সত্য। সত্য সর্বদা বিজয়ী হয়। দেবী দূর্গা ও মহিষাসুরের মধ্যেকার এই যুদ্ধে অসুর পরাজিত হয়। দেবী অর্থাৎ সুর বা সুন্দর বিজয়ী হয়। এটিকে মানুষের মনের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বা সমাজের ভাল-মন্দ বা একটি দেশের শুভ-অশুভ হিসাবে বিবেচনা করা যায়? সবাই শুভশক্তির বিজয় কামনা করে। দেবীদুর্গা শুভ শক্তির প্রতীক। মা যেমন সর্বদা সন্তানের মঙ্গল কামনায় ব্যস্ত, জগৎজ্জননী মা-দুর্গা তেমনি জীবের মঙ্গলে অসুরের সাথে যুদ্ধে করেন। জগতের কল্যানে ধরাধামে তিনি বারবার আবির্ভুত হন। দেবীদুর্গা বাংলাদেশের হিন্দুদের অসুর বিনাশের শক্তি দিন।

বাংলাদেশে এবার প্রায় ত্রিশ হাজার পূজা হচ্ছে। সরকার পূজার সময় যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেন, এজন্যে সরকারকে ধন্যবাদ। প্রশ্ন হলো, পূজার সময় নিরাপত্তা লাগে কেন? আগে তো লাগতো না? বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে বলেছিলেন, এখন থেকে যে যার ধর্ম পালন করবেন, কেউ কারো উপর ধর্মের নামে জোর-জবরদস্তি করতে পারবেনা। এজন্যেই তিনি সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে রাষ্ট্র কোন ধর্মকে প্রাধান্য দেবেনা। বাংলাদেশে একটি ধর্মকে প্রশ্রয় দেয়াটা এখন শুধু স্পষ্ট নয়, বরং দৃষ্টিকটু। অথচ মুখে ধর্মনিরপেক্ষার খই ফোঁটাতে আমরা ওস্তাদ। এজন্যেই হয়তো ইমরান এইচ সরকার বলেছিলেন, মুখে মুক্তিযুদ্ধের খই ফুটাবেন, আর মুর্ক্তি ভাঙ্গবেন তা তো হয়না! দেশে এখন বঙ্গবন্ধু নেই, ধর্মনিরপেক্ষতাও নেই?

বাংলাদেশে পূজার সময় প্রচুর মুর্ক্তি ভাঙ্গে, সেটা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে, বাহাত্তরেও ভেঙেছে; ২০১৭-তেওঁ ভাঙ্গছে। বাংলাদেশের ৪৬ বছরের ইতিহাসে হাজার হাজার মুর্ক্তি, মন্দির ভাঙ্গলেও আজ অবধি একজন এই অপরাধে শাস্তি পেয়েছে, এমন নজির সৃষ্টি হয়নি। এবার মানিকগঞ্জের সিংগাইর-এ দু'টি মন্দিরের ১৫টি মুর্ক্তি ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। সাতক্ষীরার আশাশুনীতে ৫টি প্রতিমা ভাংচুর হয়েছে। লালমনিরহাটে মন্দিরের জমি দখলের অভিযোগে ১৮টি মন্দিরে দুর্গাপূজা হবেনা। দিনাজপুরের বীরগঞ্জে মহালয়ার দিন দূর্গা প্রতিমা ভেঙেছে দুর্বৃত্তরা? চট্টগ্রামের পাথরঘাটা এলাকায় পাঁচবাড়ী পূজা মণ্ডপে এবার ব্যতিক্রমী একটি দেবীমুর্ক্তি গড়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ হিসাবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত নির্যাতনের বিভিন্ন সংবাদের কাটিং দিয়ে দেবীমুর্ক্তির পোশাক এবং ব্যাকগ্রাউন্ড সাজানো হয়েছে। মুর্ক্তির হাতে একটি কাটা মুন্ড এবং অন্যহাত খুঁটিতে বাঁধা দেখানো হয়েছে। কমিটির নেতারা বলেছেন, প্রতিবাদ হিসাবেই এটা করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ-এ চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম নাকি হিন্দুদের একটি মণ্ডপে পূজা করার নির্দেশ দিয়েছেন? আগে সেখানে চারটি মণ্ডপে পূজা হতো। এবার ইউপি চেয়ারম্যানের নির্দেশ, একটি পূজা। হুকুম না মানলে 'মালাউনদের মেরে সাইজ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন' তিনি। কবছর আগে 'ঘটপূজার' কথা তো আমরা সবাই জানি?

'যখন দূর্গা আসেন, অসুরও সাথে আসে'। দূর্গা দেবী ক'দিন বাদে চলে যান, কিন্তু অসুররা থেকে যায়? যারা মুর্ক্তি ভাঙ্গে তাদের কি অসুর বলা যায়? আসলে যা অ-সুন্দর তাই অসুর? দুর্গাপূজায় হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হয়। এবার কেউ কেউ ঘোষণা দিয়েছেন যে তারা এই খরচের কিছুটা দেশের বন্যার্তদের এবং শরণার্থীদের মধ্যে বিতরণ করবেন। এটি নি:সন্দেহে ভালো উদ্যাগ। মানবতার কল্যানে দেবীদুর্গার আগমন, তাই দুর্গতের সাহায্যে এগিয়ে যেতে তো হবেই। এবার দুর্গাপূজা উপলক্ষে আরো একটি আহ্বানে এসেছে যে, নিউইয়র্ক, বাংলাদেশ ও বিশ্বের প্রতিটি মন্দির ও পূজা কমিটিগুলো অনুগ্রহ করে যদি প্রতিবছর বাংলাদেশে একটি হিন্দু পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাহলে কি খুব ভালো হয়না? এমন মহতী সিদ্ধান্ত শুধু যে হিন্দুদের উপকারে লাগবে তা নয়, বরং এতে সমাজ ও দেশের উপকার হবে। নিউইয়র্কে প্রতিটি পূজায় খরচ ২৫-৬০ হাজার ডলার। মাত্র ১হাজার ডলার বাঁচিয়ে দেশে একটি পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করে দিলে পূজার আনন্দ নিশ্চয় বেড়ে যাবে।

দুর্গাপূজা সর্বজনীন। অর্থাৎ সবার। সবাই মিলেই এটি সার্থক করতে হয়। সবাই মিলিত হওয়া তখনই সম্ভব যখন সবার মধ্যে ভ্রাত্রিত্ববোধ থাকে। 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম'-গানটি আমরা প্রায়শঃ গাইতে পছন্দ করি। কিন্তু আগের দিনগুলো ফিরিয়ে আনতে আমাদের কোন প্রচেষ্টা নেই? মানুষে মানুষে আগেরমত সংযোগ নেই? পরিবারের সংজ্ঞা পাল্টে যাচ্ছে। উৎসবগুলো হয়ে যাচ্ছে সম্প্রদায় ভিত্তিক। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের মানুষ যখন নিউইয়র্কে 'বাংলাদেশ পূজা সমিতি'-র ব্যানারে দুর্গাপূজা শুরু করে, তখন পূজাটা হিন্দুদের থাকলেও উৎসবে সবাই জড়িত ছিলো। পূজায় মুসলমানদের উপস্থিতি ছিলো উৎসাহব্যঞ্জক। এখন নিউইয়র্কে অনেকগুলো পূজা হয়, লোক সমাগম প্রচুর। কিন্তু সংখ্যাগুরুর উপস্থিতি কমে গেছে। এর কারণ কি? তবে গতবার জ্যাকসন হাইটসে পূজা হয়েছিলো, তাতে জড়িত ছিলাম, সেই পূজার সংখ্যাগুরুর উপস্থিতি ছিলো লক্ষণীয় এবং স্থানীয় বাঙ্গালী ব্যবসায়ীরা তাতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এবার পূজাটি আর জ্যাকসন হাইটসে হচ্ছেনা। অন্যত্র সরে গেছে।

দেবীদুর্গা এবার নৌকায় এসেছেন। অর্থাৎ এবার ফলন ভালো হবে? আসলেই এবার বাম্পার ফলন দরকার। কারণ, বন্যার কারণে দেশে খাদ্যের মজুত কমে গেছে। আমাদের বার্মা থাকে চাল কিনতে হচ্ছে। তদুপরি অতিরিক্ত কয়েক লক্ষ শরণার্থীদের খাওয়াতে হচ্ছে। দেবীদুর্গা বাংলাদেশকে রক্ষা করুন। সংখ্যালঘুদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচান। তবে কানাডা থেকে শেখ শামসুন্নাহার ইতি লিখেছেন, 'পড়শীর জন্যে কেঁদে বুক ভাসাই, পূজা মণ্ডপ ভেঙ্গে বাপ্-দাদার ভিটামাটি থেকে তাড়াই' আমাদের এনীতি থেকে সরে আসা দরকার। আর কত? শরণার্থীরা জানান দিচ্ছে, কেউ স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়েনা, ছাড়তে বাধ্য হয়? যার বাড়িতে আগে দুর্গাপূজা হতো, এখন কেন হয়না, তা কি কেউ জিজ্ঞাসা করে না? হিন্দুরা কে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে তা জানার চেষ্টা করুন এবং তা ঠেকান। নইলে সৈয়দ আশরাফ-র কথাই না সত্য হয়ে যায়, 'হিন্দুরা ভালো না থাকলে আপনারাও ভালো থাকবেন না? দেশটি আমার। দুর্গাদেবী আমার। আসুন, আমরা দেশটিকে সার্বজনীন করি। ধর্ম যার যার, দেশ সবার।

(এসজি/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৭)