ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » শিল্প-সাহিত্য » বিস্তারিত

বিশ্বজিৎ বসু’র গল্প

২০১৭ অক্টোবর ০৩ ১৮:৩৩:০৯
বিশ্বজিৎ বসু’র গল্প







সেদিনও ছিল রবিবার

রবিবার। সাপ্তাহিক ছুটি শেষে অফিস খুলেছে। সাড়ে দশটার দিক দোতালা থেকে নেমে এলেন বড় সাহেব। সংগে এক মোটা সোটা উচু লম্বা পুরুষ। গুপ্তদার সংগে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি মিস্টার আজম যোগ দিচ্ছেন ম্যানেজার হিসাবে। ওয়াপদা, বি এল আর আই দুটো অফিসের দায়ীত্ব আপাতত একে দিয়ে দিন। এরপর আস্তে আস্তে পোখরাজের অফিসগুলোর দায়ীত্ব বুঝে নেবে।

ব্যস্ততম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রুপসি বাংলা। কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু হয় এর ব্যস্ততা। জ্বালানী সংগ্রহের জন্য তৈরি হয় সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত গাড়ির লম্বা লাইন। ঢাকা শহরের ব্যস্ততার সাথে সাথে এর ব্যস্ততা রেখা উঠতে থাকে উপরের দিকে হু হু করে। সকাল নটার দিকে এ রেখা উঠে যায় আকাশে। তারপর চলতে থাকে সমভুমির সমান্তরালে অনেক উপর দিয়ে। রাত দশটার পর ধীরে ধীরে সে রেখা নেমে আসে নিচের দিকে। ঝিমোতে থাকে রুপসি বাংলা। দুটি একটি গাড়ী আসে জ্বালানী নিতে। মাঝে মাঝে শোনা যায় দুই একটা ট্রাকের শব্দ, আধো ঘুমে নাকডাকা শব্দের মত। ভোরের আজানের পর আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠে আবার।

নিচ তলায় দরজার পাশে রাফি সাহেবের টেবিল। সদা হাস্যজ্জোল রাফি সাহেব কারও সাথে কটু কথা বললেও মুখে ফুটে থাকে হাসির রেখা। ডান পাশে কাঁচের দেয়াল ঘেসে ছোট ছোট টেবিল। এগুলো ম্যানেজারদের।এই রুমের ভিতর দিয়ে আর একটি দরজা। সে দরজা দিয়ে ঢুকলেই একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল। এটা গুপ্তদার। গুপ্তদা ম্যানেজারদের সমন্বয়ক। এর একপাশে কম্পিউটার টেবিল। অপর পাশে গাজীর টেবিল ।

অফিসের বড়কর্তার স্বাক্ষরে স্লিপ জমা দিয়ে তেল নিয়ে যায় গাড়ীর চালক। মাস শেষে সেগুলো জমা দিতে হয় সেই অফিসে বিল আকারে। এক সময় ফাইল পাশ হয়। অফিসের বড়কর্তার স্বাক্ষরের পর সে ফাইল যায় এজি অফিস কাকরাইলে। তৈরি হয় ব্যাংক চেক। জানুয়ারীর চেক পাশ হয় মার্চে, মার্চের চেক জুনে।

চেক পাশ করাতে ম্যানেজারদের ম্যানেজ করতে হয় ঘাটে ঘাটে। ম্যানেজ করতে হয় গাড়ীর ড্রাইভার, অফিসের পিয়ন, একাউন্টিং অফিসার, অফিসের বড়কর্তা। ম্যানেজ করতে না পারলে অনেক বাহানা। ফাইল আসেনি, ফাইল নম্বর পড়েনি, ফাইল খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা, আলমারীর চাবি ভুলে রয়ে গেছে বাড়িতে ইত্যাদি ইত্যাদি।

সকালে অফিসে এসে ব্যাগটি রাখতে রাখতেই রশিদ এসে হাজির হয় এক কাপ লাল চা নিয়ে। চা পানের সাথে সকলের সংগে হাই হ্যালো শেষে ম্যানেজাররা বেরিয়ে যায় অফিসে অফিসে বিল জমা দিতে অথবা চেক আদায়ের কাজে। তারপর লাঞ্চের সময় একে একে ফিরে আসে।

অফিসগুলো আজকাল আর হাতে লেখা চিঠি বা বিল নিতে চায় না। হাতে লেখা চিঠি দিলে সরকারি অফিসের কর্মকতারা ভ্রূ কুচকে বলে, এখনও হাতে লেখা চিঠি দিয়ে চালাচ্ছেন। বড় সাহেবকে বলেন এগুলো আর এখন চলে না। এখন কম্পিউটারের যুগ। খরিদ্দারের চাহিদা মেটাতে সমর যোগদান করেছেন মাস ছয়েক হলো। ব্যবসার ধরণ বুঝে তাকে একটা সফটওয়ার তৈরি করতে হবে।

আজম সাহেব যোগদান করেছেন বড় সাহেবের এক বন্ধুর সুপারিশে। মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন দশ বছর। দেশে ফিরে দিয়েছিলেন মুরগীর ফার্ম। স্বচ্ছল সংসার। রাজনীতির মিছিল মিটিংএ আসা যাওয়া করতেন। এমন সময় এলো ডিভি লটারি। আমেরিকা যাবার স্বপ্ন। আবেদন করেছিলেন ডিভি লটারিতে। টিকে গেলেন প্রাথমিক বাছাইয়ে। আমেরিকান অ্যাম্বেসি থেকে ডেকে জানাল ভিসার জন্য অনেক ডকুমেন্ট জমা দিতে হবে।

বাড়ীতে শুরু হয়ে গেল আনন্দের বন্যা। কাগজ পত্র সংগ্রহ করতে নেমে পড়লেন আজম সাহেব। বাড়ীর ছাদে মুরগির ফার্মটি দিলেন বন্ধ করে। আমেরিকা গেলে এগুলো এখন আর দরকার কী। পাসপোর্ট করালেন, সংগ্রহ করলেন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, সার্টিফিকেট ইংরেজিতে অনুবাদ করালেন। সৌদি আরব থেকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স আনালেন। মেডিকেল করালেন। আরও কত টুকি টাকি। নিজের, ছেলে মেয়ে বউ সবার কাগজপত্র সংগ্রহ করে জমা দিলেন আমেরিকার আম্বেসিতে।

ইংরেজি শিখতে হবে। পুরানো পল্টনের ফুটপাতের বইয়ের দোকান থেকে কিনে এনেছিলেন স্পোকেন ইংলিশ বই। আমেরিকায় তো আর বাংলা চলবে না। স্পোকেন ইংলিশ বইটি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মনে মনে ইংরেজিতে কথোপকথন চালান। কেমন আছেন ইংরেজিতে কি হবে। How are you? না How do you do? না How is going? How are you? টা বেশী ম্যাচ করে আমাদের বাংলার সাথে। যাককে যা কিছু জিজ্ঞেস করুক উত্তর তো একটাই। I am fine. How are you? মুসুরের ডালের ইংরেজি কী। বেগুনকে ওরা কি বলে এরকম আরও কত প্রশ্ন। মাঝে মাঝে বউ এর সাথে ইংরেজি চর্চা করেন। বড় মেয়ে পড়ে ক্লাস এইটে, সেও এসে যোগ দেয় মাঝে মাঝে।

কয়েক মাস পর ডাক পড়ল । রবিবার সপ্তাহের প্রথম দিন। সকাল সাড়ে দশটায় সাক্ষাৎকার। সময় মত আম্বেসিতে পৌঁছলেন আজম সাহেব। কাঁচের ওপাশ থেকে একজন অফিসার জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছেন আজম সাহেব।

প্রশ্ন শুনে প্রথমে থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন ইংরেজিতে প্রশ্ন করবে। কিন্তু এ দেখি বাংলায় জিজ্ঞেস করে। তারপর একটু থিতু হয়ে উত্তর দিলেন ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন।

কাগজপত্র উল্টাতে উল্টাতে অফিসার জিজ্ঞেস করলেন। আপনার স্ত্রীর ডেট অফ বার্থ কত। বউ এর জন্ম তারিখ, হায় হায় এটা কি জিজ্ঞেস করে। মনে মনে ভাবে আজম সাহেব। জীবনে কোনদিন তার জন্ম তারিখ জানার প্রয়োজন পরে নাই। বিয়ের দিন কাবিন নামায় ওটা লিখেছেন কাজী সাহেব। শুধুমাত্র পাসপোর্ট ফরম পুরণ করার সময় একবার দেখেছেন।

আজম সাহেব কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্ঠা করে পারলেন না। টেবিলের ওপার থেকে অফিসার জিজ্ঞেস করে, কত বছরের সংসার আপনার।

- ২২ বছর। আজম সাহেব উত্তর দেয়।

- বাইশ বছর একসংগে সংসার করছেন। আর স্ত্রীর জন্ম তারিখ জানেন না। আমেরিকা যাবেন কিভাবে? অফিসার জিজ্ঞেস করে।

আজম সাহেব নিচু স্বরে উত্তর দেয়, আসলে কখনও প্রয়োজন পড়ে নাইতো।

অফিসার ফাইলের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলে, জন্ম দিনে বউকে কোনদিন বলেন নাই ”হ্যাপি বার্থডে”। তারপর একটু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, অ্যম্বেসি আপনার সাথে পড়ে যোগাযোগ করবে।

অ্যাম্বেসি আর কোনদিন যোগাযোগ করে নাই। কিছুদিন দৌড়াদৌড়ি করেছেন আ্যাম্বেসিতে। চিঠি লিখেছেন বিভিন্ন দফতরে। কোন উত্তর পান নাই। স্ত্রী তিন সন্তান বউ আর নিজের সব কাগজপত্র সংগ্রহ করতে করতে টাকা পয়সা সব শেষ । সংসার চালাতে এই নতুন চাকরি। বড় সাহেবের এক বন্ধুর সুপারিশে যোগদান করেছেন রুপসি বাংলায়।

গুপ্তদার টেবিলের এক পাশে আজম সাহেবের ডেক্স। তাকে নতুন একটি অফিসের দায়ীত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে পোখরাজ। কম্পিউটারে কাজে ব্যস্ত সমর । ম্যানেজার গাজী ঢুকলো খবরের কাগজ হাতে নিয়ে। সমর উদ্দেশ্য করে বললেন, কি দাদা, জানেন নাকি কিছু? শের আহম্মেদ নাকি অভিনেত্রী মেঘলার সংগে চুটিয়ে প্রেম করছে। কথাটা শুনে বড় বড় করে গাজীর দিকে তাকালেন আজম সাহেব। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি জানলেন কিভাবে। গাজী আজম সাহেবের হাতে কাগজটা তুলে দিয়ে বললেন, এইযে পড়ে দেখুন।

খবরটা শুনে সমরের মুখটা কালো হয়ে যায়। চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলে” এগুলো আমার কাছে গছিপ বলেই মনে হয়। মেঘলা তার মেয়ের বয়েসি। তাছাড়া তার মেয়ের বন্ধুও বটে। মেইন স্ট্রিম কোন কাগজে এধরণের কোন খবর এখনও আসেনি। বিক্রি বাড়ানোর জন্য এরা এসব গছিপ তৈরি করে।

সমরবাবুর মুখটা লক্ষ্য করে আজম সাহেব। তারপর বলে দাদা মন খারাপ করবেন না। ঘটনা সত্য।

- আপনি কিভাবে জানলেন সেটা সত্য। সমর বাবু জিজ্ঞেস করে।

- আমাকে বিশ্বাস করেন। ঘটনা সত্য। আপনাকে পরে বলব।

সমরবাবু চুপ হয়ে যায়। খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে থাকে আজম সাহেব। আজম সাহেব বুঝতে পারে সমর বাবুর ব্যপারটা মেনে নিতে কষ্ঠ হচ্ছে। বিষয়টিকে হালকা করার জন্য সমরবাবুকে উদ্দেশ্য করে আজম সাহেব বলে, “আরে দাদা পরকীয়া প্রেমতো আমিও করেছিলাম আমারটা সাকসেস হয় নাই। লেখকেরটা হতে যাচ্ছে “।

সবাই হো হো করে হেসে উঠে। সমর মন দেয় নিজের কাজে । সে ম্যারাডোনাকে পছন্দ করে না। ব্রাজিলে প্লের পরে এই একজন ফুটবলার যার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশী। কৌশলি এবং দক্ষ খেলোয়াড় এখন আর দ্বিতীয়টি নেই। সমরের অপছন্দের কারণ ম্যারাডোনা নেশা করে। তার মতে বিখ্যাতদের মানুষ অনুসরণ করে। সুতরাং তাদের হতে হবে আদর্শিক। সমাজে যে কাজগুলো দৃষ্টিকটু সেগুলো থেকে তারা বিরত থাকবে। লেখক শের আহম্মেদকে অনুসরণ করে দেশের শত শত পাঠক পাঠিকা। সুতরাং তাকে হতে হবে একজন আদর্শবাদী। তবেই তো তাকে মানুষ অনুসরণ করবে।

আজম সাহেব ভোজন রসিক মানুষ। নিজে খেতে পছন্দ করেন খাওয়াতেও পছন্দ করেন। রবিবার হলেই ভাবির হাতের কোন না কোন রান্না আসে। রমযানের ছুটির পর অফিস খুলেছে। আজম সাহেব এনেছেন একটি বিশেষ খাবার। খাসির মাংসের ইষ্টু। ইষ্টুর এক টুকরো গাজীর প্লেটে তুলে দিতে দিতে রান্নার রেসিপি বলতে লাগলেন আজম সাহেব। দুই কেজি খাসির মাংস, এক কেজি পিয়াজ, আধাসের তেল। ২:১:০.৫। এর জন্য এর নাম ইষ্টু । অনুপাতের অংক। এর সাথে অন্যান্য মসলা দিবেন প্রয়োজন মত। ভাল করে মাখিয়ে চুলায় তুলে দিবেন। কোন নাড়াচাড়া করবেন না। একবারে নামিয়ে ফেলবেন।

গাজী মাংসের টুকরো চিবাতে চিবাতে বলে উঠে” আজম ভাই, ভাবির পাঠানো সব কিছুই মজদার। ভাবির পাঠানো গল্পও মজাদার, খাবারও মজাদার।

আজম সাহেবের ছোট শালিকার বান্ধবী মুনিয়া মেঘলারও বান্ধবী। শের আহম্মেদ এর প্রেমের গল্পগুলো সেখান থেকে আসে ভাবির কাছে, তারপর ভাবি থেকে আজম ভাইয়ের কাছে। একারণে আজম সাহেব কখোনো শের আহম্মেদের ভায়রা, কখনও লেখকের ভায়রা, আবার কখনও কখনও শুধু ভায়রা বলে ডাকে গাজী সাহেব। বিশেষ করে যখন তার মেঘলা আর লেখকের প্রেমের গল্প শোনার ইচ্ছা হয়।

আজম সাহেব সমরের থালায় মাংসের টুকরো তুলে দিতে দিতে বলে সমরদাতো বিশ্বাস করতে চায় না।

গুপ্তদা লকার রুমে বসে টাকা গুনছিল। সে সমরকে উদ্দেশ্যে করে বলে, আরে দাদা ধোঁয়া যখন দেখছেন আগুনের কুন্ডলী নিশ্চয় আছে।

সমর বাবু মনে মনে ভাবে পৃথিবীতে আর্নেস্ট হেমিংওয়েদের সংখ্যা অনেক। আমাদের দেশে আরেকটা বাড়ল। একই সংগে মেয়েকে দিয়েছেন বাৎসল্য প্রেম আর মেয়ের বন্ধুকে বিলিয়ে দিচ্ছেন রোমান্স ।

লেখকের প্রেমের প্রসঙ্গের সাথে চলতে থাকে দুপুরের খাওয়া। গাজী বেরিয়ে গিয়ে আবার কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে। হাতে দৈনিক সংবাদ। তুলে দেয় সমর বাবুর হাতে। লেখকের ছোট ভাই একটা বিবৃতি দিয়েছেন। তিনিও লেখালেখি করনে। ধীরে ধীওে তারও জনপ্রিয়তা বাড়ছে পাঠক সমাজে। তিনি সাংবাদিকদের আহ্বান জানিয়েছেন লেখকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার না করার জন্য।

আজম সাহেব খবরটি পড়ে বলে ভাই সাহেব কিছুই জানেন না। জানলে এই বিবৃতি দিতো না। খুব শিঘ্রই শুনবেন তারা বিয়ে করে ফেলেছে। স্ত্রীর সংগে এখন আর লেখক থাকেন না। তিনি বেশী সময় থাকেন তার বাগান বাড়ীতে। সেখানে সুটিংও চলে প্রেমও চলে। তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্ত্রী থাকে কলাবাগানের ফ্লাটে।

গাজী হাসতে হাসতে বলে। কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ। একজন সুখ সাগরে ভেসে বেড়ায় আরেকজন দু:খ সাগরে ডুবে মরে। আরে দাদা পরকীয়া কী কেউ ভাই বোনদের জানিয়ে করে। পরকীয়ার খবর প্রথমে জানে পরমানুষ তারপর জানে বাড়ির মানুষ।

এভাবেই দিন গড়িয়ে মাস। মাস গড়িয়ে বছর। ব্যস্ত রূপসী বাংলা। সকালের কাজ শুরু হয় রশিদের লাল চা দিয়ে। তারপর ব্যস্ততা। কম্পিউটারে চলে ডাটা এন্ট্রি, কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্লিপ সর্টিংয়ে। কেউ চলে যায় বকেয়া আদায়ের কাজে।

পোখরাজ অবসর নিয়েছেন। সে যে অফিস গুলো রিপ্রেজেন্ট করতো সে সব অফিসসহ ওয়াসা, জাতীয় সংসদও এখন আজম সাহেবের দায়ীত্ব। তিনি এখন ভীষণ ব্যস্ত।

একদিন চৈত্রের দুপুরে আজম সাহেব ফিরে এলেন লাঞ্চ করতে। গম্ভীর, চোখে মুখে চরম বিরক্তি।

কি হয়েছে আজম ভাই। সমর বাবু জিজ্ঞেস করে।

আজম ভাই রেগে ফেটে পড়ে। চোর শালারা সব চোর। শালারা আমাকে চার বার করে পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে উপর নিচ করিয়েছে। একাউন্টস্ অফিসার বসে দোতালায়, গেলাম তার কাছে। আমাকে বলল চেক হয়ে গেছে। পাঁচ তলায় উঠলাম কেরানি বলে হয় নাই। নিচ তলায় এক্সেন এর রুমে গেলাম। সে বলে আমিতো বিল এপ্রূভাল দিয়ে দিয়েছি। আবার গেলাম পাঁচলতায় সিড়ি বেয়ে যেয়ে দেখি কেরানী বাসায় চলে গেছে। বলেন সহ্য হয়।

গুপ্তদা ঘটনা শুনে বলে কি করবেন আজম ভাই। ও একটু তেল চুরির ভাগ চায়। ও দেখে ড্রাইভার ভাগ পায়, এক্সেন ভাগ পায়, এজি অফিস ভাগ পায় । ও দোষ করল কী।

সমর বাবু লাঞ্চের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আলম সাহেবও প্রস্তুতি নিল লাঞ্চ করার। গাজী ঘরে ঢুকল একটি খবরের কাগজ হাতে নিয়ে। ব্যানার হেড লাইনে খবর, শের আহম্মেদের বিবাহ বিচ্ছেদ। সমর আড় চোখে তাকায় আজম সাহেবের দিকে। আজম সাহেব ইশারায় জানিয়ে দেয় ঘটনা সত্য।

নিশ্চুপ সমর। ভাবনা এসে ভর করে তার উপর । বিয়ে হচ্ছে শরীর আর মনের এক যুগপৎ বন্ধন। ভিতরে মনের শক্ত বন্ধন আর শরীরটা উপরের কংক্রিটের প্রলেপ। সুতোর বন্ধন যখন ঢিলা হয়ে যায় শরীর সে বন্ধনকে আগলে রাখে। আর কংক্রিটের প্রলেপ যখন দুর্বল হতে থাকে মন তখন বেঁধে রাখে। এদের দুটোই এক সংগে ক্ষয়ে গেছে।

রবিবার। শুরু হয়েছে নতুন সপ্তাহ। আজম সাহেব অফিসে ঢুকলেন। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ।।

সমর জিজ্ঞেস করে। আজম ভাই, শরীর টিক আছে তো। আপনাকে এমন লাগছে কেন?

- ব্লাড প্রেসার টা বেড়ে গেছে দাদা। কমছে না। দুদিন ঠিক মত ঘুম হচ্ছে না। আজম সাহেব জানায়। শুক্রবার রাতে বাসায় গিয়ে মেপে দেখে প্রেসারটা হাই। সেদিন পাঁচতলা ভবনে ওঠানামা করাটা সহ্য হয়নি। তাছাড়া বারে বারে কেরানির ব্যবহারটা মনে পড়েছে। রাগটা কমাতে পারছি না। আজকে যদি কেরানিটা আবারও ফাজলামি করে তাহলে মনে হয় মেজাজটা ধরে রাখতে পারব না।

রশিদ লাল চা দিয়ে যায় টেবিলে। শেষ হতে না হতে গাজী ঢুকে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে। মেলে ধরে একটা খবর। নতুন করে ঘর বাঁধছেন শের আহম্মেদ আর মেঘলা। আজম সাহেব চা শেষ করে সমরের পিঠে হাত দিয়ে বলে দাদা মন খারাপ করবেন না। একটা কথা মনে রাখবেন প্রেম এবং যুদ্ধ কোন আইন মানেনা। আমি ওয়াপদা অফিসে যাচ্ছি, লাঞ্চ করবেন না আমি আশা পর্যন্ত। আপনার ভাবি কাঁচাকলার চপ বানিয়ে পাঠিয়েছে। এক সাথে লাঞ্চ করব। আজম সাহেব বেরিয়ে যায় চেক আদায়ে।

দুপুর একটা। গুপ্তদা লকার রুমে টাকা গুনছে। সমর বাবু ব্যস্ত কম্পিউটার নিয়ে। আজম সাহেব
ফিরে এলে লাঞ্চ হবে। দোতালা থেকে রশিদ নেমে এসে জানায়, বড় সাহেব বলেছে পুরাণ ঢাকা থেকে হাজীর বিরিয়ানী আসছে। একটু দেরী করে লাঞ্চ করবেন।

রশিদ বেরিয়ে যেতেই ঘরে ঢুকে রাফী সাহেব। দাদা ওয়াপদা অফিস থেকে ফোন করেছিল। আলম সাহেবের স্টোর্ক করেছে। ওরা আম্বুলেন্স ডেকে পিজি হাসপাতালে পাঠিয়েছে।

খবর শুনে উপর থেকে নেমে এলেন বড় সাহেব। গাজীকে পাঠালেন খবর আনতে ।

গাজী ফিরে এলো বিকাল সাড়ে চারটার দিকে । আজম সাহেব পাঁচ তলায় কেরাণির সংগে তর্ক করছিল। এ অবস্থায় মাথা ঘুরে পড়ে যান। তারপর নাক দিয়ে শুরু হয় ব্লিডিং। এটা নাকি তার থার্ড স্টোর্ক। আই সি ইউ তে আছে। বাহাত্তর ঘন্টা না গেলে ডাক্তাররা কিছু বলতে পারছে না।

বুধবার খবর পাওয়া গেল আজম সাহেবের কোন উন্নতি হয়নি। বৃহস্পতিবার সপ্তাহ শেষে অশঙ্কা নিয়ে শুরু হয়ে গেল সাপ্তাহিক ছুটি।

রবিবার একে একে সবাই ঢুকল অফিসে। রশিদ একে এক চা দিয়ে গেল সকলের টেবিলে । আজম সাহেবের টেবলটা খালি। ব্যাগটা তখনও নিচে। গুপ্তদার টেবিলে বেজে উঠল ফোন।

গুপ্তদা ফোন নামিয়ে জানাল। আজম সাহেব আর নেই। গাজী পাশ থেকে পাঠ করে উঠল ”ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন”।

রশিদ আজম সাহেবের ব্যাগটা তুলে আনল টেবিলের উপর। ওটাকে ফেরত পাঠাতে হবে পরিবারের কাছে।

ব্যাগের ভিতর একটা টিফিন ক্যারিয়ার, ছোট একটা ডায়েরি। ডায়েরির প্রথম পাতা উল্টাতে বের হলো একটা ছবি। মেঘলার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে লেখক শের আহম্মেদ। টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার পচে গেছে।