ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » শিল্প-সাহিত্য » বিস্তারিত

রামায়ণ অবলম্বনে প্রবাসী লেখক বিশ্বজিত বসুর নাটক 'অকাল বোধন' : পর্ব- ৫

২০১৭ নভেম্বর ১৯ ১৭:০২:৪৭
রামায়ণ অবলম্বনে প্রবাসী লেখক বিশ্বজিত বসুর নাটক 'অকাল বোধন' : পর্ব- ৫

পূর্ব প্রকাশের পর পঞ্চম দৃশ্য

(প্রথম অংক)

(নেপথ্যে কন্ঠে রামায়ণের সুরে পাঠ চলে)

শোকের উপরে শোক শোক যায় সাথে
দিকে দিকে ছুটে রাম, সীতাকে খুঁজিতে।

(সীতাকে ডাকতে ডাকতে মঞ্চে প্রবেশ করে লক্ষণ)

লক্ষণ: বৌঠান, বৌঠান ও বৌঠান বৌঠান ।

(এরপর রাম সীতাকে ডাকতে ডাকতে মঞ্চে প্রবেশ করে)

রাম: সীতা, জানকী, সীতা

(উল্টো দিক দিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করে হনুমান।)

রাম: (হনুমানকে) তুমি আমার সীতাকে দেখেছ?

হনুমান: সীতা! সীতা কে গো! সীতার কি হয়েছে। আমিতো ভেবেছিলাম তুমি বালি রাজার চর। কিন্তু তোমাকে দেখেতো সেটা মনে হচ্ছে না।

লক্ষণ: ইনি অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্র। সীতা ওনার স্ত্রী। জনক রাজার কন্যা জানকী।

রামঃ (হনুমানকে) তুমি কে ভাই। তুমি কি আমার সীতার খোঁজ এনে দিতে পারবে ?

হনুমান: আমি পবন নন্দন, বীর হনুমান। রাজা সুগ্রীবের সচিব।

লক্ষণ: তোমরা বনে কি করছ ?

হনুমান: বালী অন্যায়ভাবে সূগ্রীবকে রাজ্যচ্যুত করে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা এখন বনে বনে পালিয়ে বেড়াই।

রাম: তাহলে তো তোমাদের অবস্থা অনেকটা আমারই মত। আমি পিতৃসত্য পালনে আজ বনবাসী।

হনুমান: তাহলে তুমিই কি সেই রাম যে কদিন আগে খর আর দুষণকে পরাজিত করেছে ? তাদের চৌদ্দ হাজার সৈন্যকে নির্মূল করেছে ।

রাম: হ্যাঁ, আমি সেই রাম।

লক্ষণ: তোমরা কি সীতা উদ্ধারে আমাদের সাহায্য করতে পারবে? জটায়ু পাখি বলল রাবণ তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে।

হনুমান: আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু আমরাও তোমাদের সাহায্য চা্য়।

রাম: কি সাহায্য বল, যদি সম্ভব হয় অবশ্যই করবো ?

হনুমান : বালিকে পরাজিত করে সুগ্রীবকে সিংহাসনে বসাতে হবে।

রাম: অন্যায় ভাবে করলে অবশ্যই সাহায্য করবো।

(হনুমান ইশারা দিয়ে অন্য বানর সৈন্যদের মঞ্চে আসতে বলে, অন্য বানরদল মঞ্চ ঢুকে)

হনুমান: জয় রাম চন্দ্রের জয়

সমবেত বানরদল: জয় রাম চন্দ্রের জয়।

হনুমান: জয় রাম চন্দ্রের জয়

সমবেত বানরদল: জয় রাম চন্দ্রের জয়।

হনুমান: এই সৈন্যরা শোন। তোমরা সীতার খোঁজে যাও।

সকল বানর: জয় বীর হনুমানের জয়। জয় বীর হনুমানের জয়।

হনুমান : (বানর সেনাদের) তোমরা পুর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষীণ চারিদিকে ছড়িয়ে যাও। খুঁজে দেখ রাবণ কোথায় সীতাকে বন্দী করে রেখেছে। আমি রাম চন্দ্রকে রাজা সুগ্রীবের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।

(বানর সৈনরা মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায়।)

হনুমান : (রামচন্দ্রকে) চলুন দেব। সুগ্রিবের সংগে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিই।

(হনুমান আগে তারপর রাম তার পিছনে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায় লক্ষণ যায় পিছনে পিছনে। মঞ্চে আলো নিভে যায়। নেপথ্যে রামায়নের সুরে পুখি পাঠ শুরু হয়)

সূগ্রীব হয়ে যায় শ্রী রামের মিতা
বানর সৈন্যরা যায় খুজিতে মা সীতা।
গরুড় পাখির কন্যা নামেতে সম্পাতি
সীতার সন্ধান সে জানায় শ্রীঘ্র গতি।
অশোক কাননে বন্দী রাম জায়া সীতা
মহা কষ্টে আছে সেথা জানকী সুমাতা।

পঞ্চম দৃশ্য

(২য় অংক)

(শোকের গান এবং নাচ)

আকাশ কাঁদে, বাতাস কাঁদে, কাঁদে পশুপাখি
মা সীতা মা সীতা বলে ভাসায় দুটি আঁখি।
রাম কাঁদে, লক্ষণ কাঁদে, কাঁদে গাছের পাতা
কোথায় গেল কোথায় গেল, কোথায় প্রাণের সীতা।
সাগর কাঁদে, পাহাড় কাঁদে, কেঁদে বাক্যহারা
কন্যাকে হারিয়ে মাটি হয় যে দিশাহারা।
বৃক্ষ কাঁদে, শাখা কাঁদে, কাঁদে ফুল আর ফল
চোখের জলে নোনা হল গোদাবরীর জল।

সীতা: রাম চন্দ্র আমার রাম চন্দ্র , কোথায় তুমি রাম চন্দ্র। (উল্টা দিকে মুখ করে।)

(হনুমান মঞ্চে প্রবেশ করে)

হনুমান: এই কি রাম জায়া সীতা। রাম চন্দ্রের নাম মুখে নিয়ে কান্নাকাটি করছে। হতে পারে। পিছন থেকে দেখেতো মনে হচ্ছে রাজরানী দেখি আরেকটু পরখ করে । কারা যেন এদিকে আসছে। যাই আড়ালে গিয়ে দেখি কি হয়।

(হনুমান মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায় । উল্টো দিক দিয়ে মঞ্চে প্রবেশ রাবণ, সাথে সূর্পনখার এবং মন্দোদরি)

রাবণ: সীতা! আমার প্রিয়তমা।

সীতা: কে! ও তুমি! কি চাই এই মধ্যরাতে।

রাবণ: আমি তোমাকে আমারঅঙ্কশায়িনী হবার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। তুমি রাজি হওনি। তাই আমি নিজেই এসেছি আজ।

সীতা: রাম চন্দ্র আমার স্বামী। তাকে ভিন্ন অন্য কাউকে কল্পনা করাও মহাপাপ।

রাবণ: রামের কথা ভুলে যাও দেবী। সে একজন সাধারণ মানুষ, বনবাসী। কোনদিন তাকে রাক্ষসে খেয়ে ফেলবে। আমি রাজা। তোমার জন্য রয়েছে অবিনশ্বর জীবন। অফুরন্ত সুখ। এই দেখ কি সুন্দর মাদুলি কাঞ্চন। (মন্দোদরীকে) দাও দাও ওকে পড়িয়ে দাও।

সীতা: তিনি স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু। তাঁর বিনাশ করতে পারে এমন শক্তি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে নাই। তুমি দুর হও, এখন যাও এখান থেকে।

মন্দোদরি: তুমি রাজি হয়ে যাও সীতা, এমন সুখ আর কোথাও পাবে না। (মালা পড়াতে যায়)

সীতা : আমাকে ছোবে না। নারী হয়ে তুমি নারীর সর্বনাশ করতে এসেছে। তোমার লজ্জা করে না?

রাবণ: এমন করে বলোনা দেবী। তোমার বিহনে আমি যে মরে যাচ্ছি প্রিয়ে। অধমকে গ্রহণ করে আমাকে উদ্ধার করো। এই দেখ তোমার জন্য এই রত্নহার এনেছি।

সীতা: তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি রাবণ। আমাকে রামের কাছে পৌঁছে দাও। আমার কিছু হলে তোমার বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে ।

রাবণ: তাহলে আমার কথায় রাজি হচ্ছোনা, না ।

সীতা: না তুমি যাও এখান থেকে।

রাবণ: তবেরে, (রাবণ খড়গ নিয়ে উদ্যত হয়) তোকে মেরে রাক্ষস দিয়ে খাওয়াবো। আমার বোনের নাক কান কাঁটার প্রতিশোধ নেব।

মন্দোদরি: মেরোনা মেরোনা। আরেকটু সময় নাও। ওতো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। দেখা যাক রাজি করানো যায় কিনা।

রাবণ: ঠিক আছে আমি শয়ন কক্ষে চললাম। তুমি এসো আমার সাথে । সূর্পনখা, দেখ ওকে রাজি করাতে পার কিনা। (সীতাকে) আমি দুই মাস সময় দিলাম এর মধ্যে রাজী না হলে তোমকে টুকরো টুকরো করে কেটে রাক্ষস দিয়ে খাওয়াবো।
(রারণ আর মন্দোদরি বেরিয়ে যায় )

সূর্পনখা: আমার নাক কান কাটার মজা বুঝেছিস। রাবণ দাদার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যা। নইলে ....
সীতা: আমাকে রামের কাছে পৌঁছে দিতে বল। নইলে তোর নাক কাঁটা গেছে। এবার তোদের বংশও ধ্বংস হয়ে যাবে।

সূর্পনখা: হাতি ঘোড়া গেল তল, আর মশা বলে -------
(সূর্পনখা বেরিয়ে যায়। আলো নিভে যায়)

পঞ্চম দৃশ্য

(তৃতীয় অংক)

সীতা: হায় রামচন্দ্র। আমাকে উদ্ধার করো।

(অপরপাশ থেকে হনুমান প্রবেশ করে)

হনুমান: জয় মা সীতা।

সীতা: তুমি আবার কে!

হনুমান: আমি আপনার দাস বীর হনুমান।

সীতা: একবার পাপীষ্ঠ রাবণ আমাকে ছল করে তুলে নিয়ে এসেছে। তোমার আবার কী ছল।

হনুমান: আমি ছল করতে আসিনি মা। রামচন্দ্র আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার খোঁজে। আমাকে বিশ্বাস করুন মা।

সীতা: তুমি যদি সত্যই রামের চর হও তবে তোমাকে আমি এই বর দিচ্ছি তুমি অমর হবে কিন্তু কিভাবে বিশ্বাস করবো।

হনুমান: আপনার জন্য স্বর্ণমৃগ ধরতে গিয়েছিলেন রাম। আর আপনার দুর্বাক্যে ঘর ছেড়েছিল লক্ষণ। শূন্যঘর পেয়ে রাবণ আপনাকে আপনাকে তুলে নিয়ে এসেছে।

সীতা: হায় লক্ষণ তোমাকে ভুল বুঝে আমার আজ কি হলো।

হনুমান: আমি যে সত্যই রামের চর সেটা প্রমাণের জন্য রামচন্দ্র আপনাকে এ ঘটনাটা বলতে বলেছেন।

সীতা: আর কোন প্রমাণ।

হনুমান: এই দেখুন তাঁর আংটি। আপনাকে দিতে বলেছেন।

সীতাঃ আংটি (আংটি হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পরে) ।

হনুমান: কান্না করবেন না মা। ধৈর্য ধরুন, আমি গিয়ে খবর দেবার পরেই দেখবেন ভগবান রামচন্দ্র আপনাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবেন।

সীতা: বিভিষণ কন্যা সানন্দা এসেছিল একদিন। তার কথায় যা বুঝেছি তাতে যুদ্ধ ছাড়া আমাকে উদ্ধার করা রামের পক্ষে সম্ভব নয়।

হনুমান: বেটার সবংশে নির্বংশ হবার ইচ্ছা হয়েছে।

সীতা: তাড়াতাড়ি কিছু করতে বল হনুমান। অত্যাচার আর সহ্য করতে পারছি না (কান্নায় ভেঙে পরে।)

রাবণ মাত্র দুই মাস সময় দিয়েছে। এর মধ্যে উদ্ধার করতে না পারলে আমাকে কেটে খন্ড খন্ড করে ফেলবে।

হনুমান: তাহলে আপনি আমার পিঠে চড়ুন মা । আমি আপনাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাই।

সীতা : সেটা সম্ভব নয় হনুমান। যদি পার রাবণকে ধ্বংশ করে আমাকে নিয়ে যাও।

হনুমান: ঠিক আছে মা তাই হবে। আমি যাই রামচন্দ্রকে আপনার খবর পৌঁছে দিতে হবে।

সীতা: শীঘ্র যাও হনুমান। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

হনুমান: আমাকে এমন একটা কিছু দিন যাতে রামচন্দ্র বিশ্বাস করেন যে আমি সত্যই আপনার দেখা পেয়েছি।

সীতা: এই নাও আমার মাথার মনি। এটা রামকে দিও।

হনুমান: আর কোন বিশেষ ঘটনা।

সীতা: তুমি রামকে জয়ন্ত কাকের ঘটনা বলবে। জয়ন্ত কাক আমাকে আক্রমণ করেছিল। রামচন্দ্র তীরে বেঁধে সেই কাককে ধরে এনেছিল। এই কথা রাম আর আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। তুমি এই কথা রামকে জানালে রাম বিশ্বাস করবে তুমি সত্যই আমার দেখা পেয়েছে।

হনুমান: জয় মা সীতা।

সীতা: লক্ষণকেও আমার সংবাদ জানিও।

হনুমান: ঠিকে আছে মা । আমি তবে এখন যায়। জয় রাম চন্দ্রের জয়। জয় মা সীতার জয়।

(জয়ধ্বনী দিতে দিতে হনুমান মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায়।)

সীতা: নিমি কুলে জন্ম গ্রহণ করেছি। সূর্য়বংশে বিবাহ। রামচন্দ্র আমার স্বামী। তারপরও আমার কপালে এত দুঃখ। প্রতিদিন রাক্ষসদের হেন অপমান সহ্য করতে হচ্ছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

(আলো নিভে যায়।)

পঞ্চম দৃশ্য শেষ - চলবে

(ওএস/এসপি/নভেম্বর ১৯, ২০১৭)