ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » সম্পাদকীয় » বিস্তারিত

কানে হাত না দিয়েই চিলের পিছনে দৌড়াবে পুলিশ!

২০১৭ ডিসেম্বর ১৫ ২০:২৯:৫৮
কানে হাত না দিয়েই চিলের পিছনে দৌড়াবে পুলিশ!

প্রবীর সিকদার


একদল লোক পাগলের মতো চিৎকার করে বলল, চিলে কান নিয়ে চলে গেছে! পুলিশ নিজের কিংবা ওই পাগলদের কারো কানের দিকেই না তাকিয়ে চিলের পেছনে ছুটল। চিলকে পাকড়াও করতে না পারলেও পুলিশ পাকড়াও করতে সমর্থ হল বিষ্ণু কুমার মালো নামের এক তরুণকে। পাগলরা বলল, এই সেই চিল; আর যায় কোথায়, ৫৭ ধারার একটি মামলা পয়দা করে ওই নিরপরাধ তরুণকে একেবারে লাল দালানে ঢোকানো হল। দেড় মাস ওই তরুণটি লাল দালান তথা কারাগারেই রয়েছে; ৫৭ ধারা বলে কথা; তাও আবার ধর্মের অবমাননা!

ঘটনাটি ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার হাট কৃষ্ণপুরের। জেলে সম্প্রদায়ের ক্ষিতীশ চন্দ্র মালোর দুই ছেলে বিষ্ণু কুমার মালো ও প্রাণকৃষ্ণ মালো। বিষ্ণু বাবার মাছ ধরা ও বিক্রির ব্যবসা ছেড়ে হাট কৃষ্ণপুর বাজারেই কম্পিউটার কম্পোজ ও প্রশিক্ষণের দোকান দিয়েছে। পারিবারিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তার এসএসসি পাশ করা হয়নি। হাজারো প্রতিকূলতা মাথায় নিয়েই প্রাণকৃষ্ণ ঢাকার সোহরাওয়ার্দি মেডিক্যাল কলেজে বিডিএস পড়ছে।

বিপত্তি ঘটিয়েছে বিষ্ণু কুমার মালোর নামে একটি ভুয়া ফেসবুক আইডি। বিষ্ণুর নিজেরই একটি ফেসবুক আইডি রয়েছে Rahul Bishnu নামে। কে বা কারা যেন Bishnu Kumar Malo নামে একটি ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে পোস্ট দেওয়া শুরু করে। ওই আইডিতেও ব্যবহার করা হয় বিষ্ণুরই ছবি। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ওই ভুয়া আইডিটি খোলা হয় গত ২ সেপ্টেম্বর। গত ৯ সেপ্টেম্বর এটা জানতে পেরে বিষ্ণু ও তার শুভানুধ্যায়ীরা ওই ভুয়া ফেসবুক আইডিতেই মেসেজ পাঠিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং সেটি বন্ধের দাবি করেন। তারা ফেসবুক অথরিটির কাছে ওই ভুয়া আইডি বন্ধে রিপোর্ট করেন। এতে কাজ না হওয়ায় তারা ওই ভুয়া ফেসবুক আইডি বন্ধের লক্ষ্যে ফেসবুক বন্ধুদের প্রতি অনুরোধ করেন, তারা যেন ওই আইডি সম্পর্কে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করেন। গত ১০ সেপ্টেম্বর বিষ্ণু কুমার মালো নিজের ফেসবুক আইডি Rahul Bishnu ব্যবহার করে ওই ভুয়া আইডির কর্মকাণ্ড নিয়ে ফেসবুক বন্ধু তথা ফেসবুক দুনিয়াকে বিস্তারিত জানান। এই ভুয়া ফেসবুক আইডির বিরুদ্ধে বিষ্ণু কুমার মালো ও তার শুভানুধ্যায়ীদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের প্রমাণও রয়েছে ফেসবুকের তথ্য ভাণ্ডারেই।

গত ১ নভেম্বর রাতে ওই ভুয়া ফেসবুক আইডিতে বিকৃত একটি ছবি ব্যবহার করে একটি বিশেষ ধর্ম বিশ্বাসকে কটাক্ষ করে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করা হয়। আর সেই স্ট্যাটাসকে উপলক্ষ করে পরদিন একদল লোক বিষ্ণুদের বাড়ি ও বিষ্ণুর দোকানে হামলা ভাংচুর ও লুটপাট চালিয়ে বাড়ি ও দোকান মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। এই ঘটনায় হতভম্ব হয়ে যায় বিষ্ণু ও তার পরিবার। বাবা মা ও শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে ওই দিনই অর্থাৎ ২ নভেম্বর বিষ্ণু সদরপুর থানা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে পথে পা বাড়ায়। থানায় পৌঁছার আগেই একদল দুর্বৃত্ত বিষ্ণুকে আটক করে নির্মম গণপিটুনি দেয়। পরে সদরপুর থানা পুলিশ রক্তাক্ত বিষ্ণু কুমার মালোকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। পরে মুন্সি ইসারত নামের এক ব্যক্তি সদরপুর থানায় ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলাতেই বিষ্ণুকে আটক দেখিয়ে বিষ্ণুকে আদালতের মাধ্যমে ফরিদপুর জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। সেই থেকে জামিন বঞ্চিত বিষ্ণুর ঠিকানা ফরিদপুর জেলা কারাগার। পুলিশ কোনও যাচাই বাছাই না করেই বিষ্ণুকে আটক করে কারাগারে পাঠালো। অথচ ওই ভুয়া আইডি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য বিষ্ণু ও তার শুভানুধ্যায়ীরা সদরপুর থানা পুলিশকে দিলেও সেটা নিয়ে পুলিশের তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি।

একজন অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অবশ্যই জরুরি। তার মানে তো এই নয় যে, আইনের অপপ্রয়োগ করে যে কাউকে ফাঁসিয়ে দেওয়া যায়! ৫৭ ধারার বিতর্কিত মামলাগুলো যেন যে কাউকে শায়েস্তা করবার একটি হাতিয়ার আর কী! বিষ্ণুর নামে খোলা ভুয়া ফেসবুক আইডি কবে কখন কারা খুলেছে সেটি জানা খুব কঠিন কাজ নয়। এটা পরখ না করেই একটি দল বা গোষ্ঠীকে খুশি করতে আইনের এই অপপ্রয়োগ মোটেই গ্রহণ যোগ্য নয়। মিথ্যা ভিত্তিহীন অভিযোগে বিষ্ণু ও তার পরিবার যে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হল, এর দায় কে নিবে! অবশ্যই এর দায় সরকার তথা রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার অবশ্যই আইন নয়। এমনই একটি বেআইনি মামলায় ফরিদপুর জেলা কারাগারে দেড় মাস আটক রয়েছে ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার হাট কৃষ্ণপুরের তরুণ বিষ্ণু কুমার মালো। চরম নিরাপত্তাহীনতায় খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে ক্ষিতীশ চন্দ্র মালো ও লক্ষ্মী রানী মালোর পরিবার। আমি আশা করছি, একই সঙ্গে দাবিও করছি, আইনের শাসন প্রমাণ করতেই অবিলম্বে বিষ্ণু কুমার মালোকে মুক্তি দিতে হবে, তার পরিবারের যে আর্থিক ও মানসিক ক্ষতি হয়েছে, সেটা প্রশমিত করতে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে এবং হাট কৃষ্ণপুরের ওই মালো পরিবারের দোকান ও বাড়িতে যেসব দুর্বৃত্ত হামলা ও লুটপাট করেছে তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। এটি যতো তাড়াতাড়ি হবে ততোই মঙ্গল হবে স্থানীয় প্রশাসনের, সরকারের, রাষ্ট্রের।