ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

অস্থির সময়ে যেখানে আমাদের স্বস্তি

২০১৮ জানুয়ারি ১৩ ১৫:২২:৫৫
অস্থির সময়ে যেখানে আমাদের স্বস্তি

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন


দৈনন্দিন ব্যস্ততা বা দৌঁড়ঝাপ বলে দেয় এই সময়টুকু চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার। পথের ভিক্ষাপ্রত্যাশী ব্যক্তি থেকে শুরু করে সমাজ-রাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিটি প্রত্যেকেই আপন আপন বলয়ের মাঝে নিজের মতো করে প্রতিযোগিতামুখর। সকাল থেকে শুরু করে রাতঅবধি চলে সেই প্রতিযোগিতা পূর্বগুলোর যবনিকা।

সমাজের প্রতিটি স্তরে স্তরে সেই প্রতিযোগিতার ধারাপাত প্রবাহিত। কোনো প্রতিযোগিতা নিময়নীতির মধ্য দিয়ে হয়তো পরিচালিত। আবার কোনোটা বা অসুস্থ, নিয়মনীতিহীনভাবে ক্রমশ পরিচালিত। জনমনে দুঃখ জাগিয়ে সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতার চর্চা সমাজের নানাস্তরে সংক্রামিত হয়ে গিয়েছে।

প্রতিযোগিতা প্রসঙ্গের পালা শেষ। এবার আসি প্রতিযোগিতা পরবর্তী অবস্থায়। কাঙ্খিত-অনাকাঙ্খিত প্রতিযোগিতার চোরাবাতিতে ডুবে গিয়ে যতটা আপাদমস্তক কাঁদাময় হয়ে যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি অস্থিরতা অনুভূত হয় শরীরে-মনে। বলা যেতে পারে অস্থির সময়ের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে স্থিরতাহীন, স্বস্তিহীন চেতনার বিকলাঙ্গ রূপ জেগে ওঠে।

শিক্ষা জীবন, কর্ম জীবন, সংসার জীবন, প্রেম জীবন, দাম্পত্য জীবন প্রভৃতিতে সেই কর্মমুখর ক্লান্তির চরম অবসাদ। অস্থিরতা। যার তীব্রতায় দগ্ধ হতে হতে কেবল অঙ্গারের পালা। তাহলে এর থেকে পরিত্রাণের উপায়! অস্থির এ সময়ে কোথায় স্বস্তি আমাদের?

কোথায় যেন পড়েছিলাম ‘দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, বদলে যাবে জীবন।’ কী গভীর তাৎপর্যপূর্ণ কথাটা। ছোট্ট এক লাইনের একটি বাক্য – অথচ, কিন্তু কী হৃদয়গ্রাহী! আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সামাজিক বিভিন্ন পেক্ষাপটে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে থাকে।

আমাদের সমাজে এখন আর শিক্ষিত লোকের অভাব নেই। অভাব রয়েছে সচেতনতার। অভাব রয়েছে পুনরায় ‘মানুষ’ হয়ে উঠার। অভাব রয়েছে সচেতন ব্যক্তির। অভাব রয়েছে সচেতন মনোভাবের। সচেতন দৃষ্টিভঙ্গিতে খরা দেখা দিয়েছে। সেই খরা সমাজকে খুব দ্রুত নষ্টের শেষসীমায় পৌঁছে দিচ্ছে।

খুব সহজ করে বলতে গেলে – আমরা আমাদের সমাজের নারীদেরকে মানুষ মনে করি না। মনে করি জীবন্ত একটা ভোগ্যবস্তু। কিছু কিছু পুরুষেরা এই বিকৃত ধারণাটি আজীবনের জন্য গেঁথে রেখেছেন মননে। ধিক্কার তাদের। নারীরা যে একজন মানুষ আমরা অনেকেই তা অনুভব করিনা বা করতে চাই না। এ পর্যায়ে অসুস্থ মানসিকতার প্রমাণ দিয়ে যাই বারবার। তখন ঘৃণা জাগে সবিস্ময়ে।

শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য মানুষ হিসাবে গড়ে উঠা। কর্মজীবনের মাঝেও এই শিক্ষার একটা স্বচ্ছ বর্হিপ্রকাশ ঘটনার কথা। কিন্তু কোথায় কি? শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য ম্লান হয়। যখন দেখা যায় শিক্ষিত কোনো লোকের মাঝে তার সহকর্মীর প্রতি বর্বরতার লোলুপদৃষ্টি। অনৈতিক বিবেকহীন মানসিকতার পরিচয়। এছাড়াও বিভিন্ন অফিসের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা কালো অর্থ উপার্জনে অস্থির সময়ের চর্চা করে নিজেকে, পরিবারকে, প্রিয়জনকে এবং সমাজকে নানাভাবে বিষিয়ে তুলছেন।

সমাজের প্রতিটি সেক্টরে, রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রতিটি শাখায় এভাবে আজ অস্থির সময়ের চর্চা। অসুস্থ প্রতিযোগিতামুখর মানুষ। শুধু অফিস আদালত নয়, নিজের সাংসারিক গেরস্থালি কাজকর্মেল মধ্যেও রয়েছে সংসারের অপর লোকজন কর্তৃক অপমান আর বদনামের জ্বালা। তিরস্কার।

কোথায় তবে স্থিরতা? অস্থির সময়ের যাতাকলে পিষে যেতে যেতে মানসিক সুস্থতাটুকু, মানবিক গুণের চর্চাগুলো আজ বড় আশ্চর্যভাবে মরে যেতে বসেছে। ‘ইগো’ ‘দম্ভ’ ‘আমিত্ব’ শব্দগুলো ব্যক্তিত্বটিকে বিশালতা দান করার বিপরীতে তাকে বন্ধুহীন ও অসুস্থ মানুষে পরিণত করে ফেলেছে। সেই বিষণ্ণতাময় জীবন যেন অস্থির সময়ের বিকলাঙ্গ এক সন্তান।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বিখ্যাত গান “আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে”। এই গানটির শেষাংশে দারুণ একটি উপলব্ধি লুকায়িত : ‘স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি কোমল করে প্রাণ।’ এগুলোর চর্চাই জীবনে চির স্বস্তি আনে। চির শান্তি আনে। স্নেহ, প্রেম, দয়া কিংবা ভক্তি এই শব্দগুলো প্রতিটি ইতিবাচক জীবনের ক্ষেত্রে এতোটাই শক্তিশালী এবং মঙ্গলময়! কারণ শব্দগুলো মানবিক এবং মনুষ্যত্বের মুকুটে অভিনন্দিত।

আসুন, এই চারটি শব্দের মধ্যে যে কোনো একটি শব্দকে আগে নির্বাচন করি। তারপর সেই নির্বাচিত শব্দটিকে বুকে ধারণ করে কোনো এক বিপন্ন মানুষের পাশে নিঃস্বার্থভাবে দাঁড়াই। তাহলে, অস্থির সময়ের কার্বন-ডাই-অক্সাইডগুলো পরিবর্তিত হয়ে হৃদয়ের গহিনে অক্সিজেন দানের মাধ্যমে স্বস্তি কিংবা স্থিরতা ছড়াবেই।

লেখক : লেখক ও সাংবাদিক।