ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত

চলে গেলেন মুক্তির কথা চলচ্চিত্রের মইফুল বিবি

২০১৮ জানুয়ারি ১৬ ২২:০৮:৪৭
চলে গেলেন মুক্তির কথা চলচ্চিত্রের মইফুল বিবি

নিমাই সরকার, নগরকান্দা (ফরিদপুর) : চলে গেলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের মূক্তির কথাচলচ্চিত্রের আলোচিত মইফুল বিবি। আজ মঙ্গলবার সকাল ৯ টায় ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার ছোট পাইককান্দী গ্রামের নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেছেন ( ইন্নালিল্লাহি---- রাজিউন) ।মৃত্যুকালে বিধবা পুত্রবধু, তিন নাতি এবং ১ নাতনি রেখে গেছেন। বাদ মাগরিব নিজ বাড়ীতে নমাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

মইফুল বিবি সম্পর্কে কিছু কথা

দিনটি ছিলো ২০০১ সালের ১৯ এপ্রিল। তৎকালিন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসেছিলেন গ্রাম্য বিধবা মইফুল বিবিকে দেখতে তার ভাঙ্গা ঘর আলো করে। তারপর কেটে গেছে ১৫টি বসন্ত। কিন্তু মইফুলের ভাগ্য বদলায়নি এতটুকুও বরঞ্চ কষ্টের মাত্রা আরো বেড়েছে নিদারুনভাবে। অতি কষ্টে দিন এনে দিন খায়। এভাবেই চলছে অভাবের সংসারটি। মইফুলের বয়স এখন ৭৫ বছর। বৃদ্ধা মইফুল বিবি ৪ জন এতিম নাতি নাতনী আর বিধবা পুত্রবধুকে বুকে আগলে রাখতে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন অবিরত জীবন যুদ্ধে। যেনো শত অভাব অনটন হার মানাতে পারেনি মইফুলকে। মইফুল কি রকমভাবে বেঁচে আছে তার খবর এখন কেউ রাখেনা। মইফুল দুঃখ করে বলেন, ‘শেখের বেটি শেখ হাসিনাও আমার খোঁজ আর নিলো না।’

বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা যখন মইফুলের বাড়ি এসেছিলেন তখন তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তিনি এখনো প্রধানমন্ত্রী আছেন। মইফুল বিবিও তখন যেমনটি ছিলেন এখনো তেমনটিই আছেন, অভাবে অনটনে জর্জরিত এক বয়স্ক বৃদ্ধা। সেদিন মইফুল ভেবেছিলো এবার হয়তো তার দুঃখ ঘুচবে। কিন্তু না, সেটি হয়নি গরীবের বেদনা আরো বেড়েছি বৈ কমেনি। মইফুল বিবিকে নিয়ে নির্মিত খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘মুক্তির কথা’ প্রামান্য চিত্র দেশে বিদেশে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করলেও জীবন যুদ্ধে ছুটে চলা মইফুলের ভাগ্য বদলায়নি আজও এতটুকুও।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভালবাসায় ধন্য আর খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘মুক্তির কথা’ প্রামান্য চিত্রের সেই মইফুল বিবি এখন কেমন আছে, কিভাবে বেঁচে আছে তার খবর এখন কেউ রাখেনা। কষ্টের সীমাহীন যন্ত্রনা বুকে চেঁপে স্বামী সন্তান হারা বৃদ্ধা মইফুল এখনো ভাঙ্গা ঘরে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটায়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া স্বামীর সম্মানী ভাতাটুকু আজও ভাগ্যে জোটেনি এ হতভাগীর। ঘরটিতে বাতাস দোলায় এপাশ থেকে অন্যপাশ।

আমরা ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কোদালিয়া শহীদনগর ইউনিয়নের ছোট পাইককান্দি গ্রামে ছোট কুঁড়ে ঘরে মইফুলের কথা বলছি। স্বামী জলিল মোল্যা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন। স্বামীকে হারিয়ে মাত্র দেড় বছরের শিশু সন্তানকে গভীর মমতায় বুকে আগলে রেখে বড় করেন। সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে আর বিয়ে করেননি তিনি। তারপর অনেক দুঃখ বেদনায় সময় বয়ে গেছে কালের গর্ভে অনেক। একমাত্র সন্তান জাফর মোল্যাকে বড় করেছেন গভীর মমতায় সব ঝড় বুকে ঠেলে। আদর করে সন্তানকে বিয়ে দিয়েছেন। মইফুল বিবি ৪ জন নাতি-নাতনীর দাদি হয়েছেন । সবার ধারণা এবার হয়তো মইফুলের শেষ জীবনে সুখ শান্তি উপচে পড়বে।

সবাই বলে দুঃখের পরে নাকি সুখ আসে। কিন্তু মইফুল বিবির কপালে হয়তো বিধাতা সুখই লেখেননি। ২০০৯ সালে হঠাৎ একদিন একমাত্র সন্তান পৃথিবীর মায়া ছেড়ে এবং মায়ের বুক শূণ্য করে শেষ বিদায় নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। একমাত্র অবলম্বন সন্তান জাফরকে হারিয়ে, ছোট ছোট ৪ জন নাতি আর বিধবা পূত্রবধুকে নিয়ে আবার নতুন একটি যুদ্ধে সংগ্রামে অকুল সাগর পারি দিতে যন্ত্রনাময় পথে হাসি মুখে সবাইকে বুকে আগলে রাখছেন বয়সের শেষ প্রান্তে আসা মইফুল বিবি। ভিটেবাড়ি আর জমি সব মিলিয়ে সম্বল মাত্র ৪০ শতাংশ জায়গা। ৬টি পেট এই সামান্য জমি, সংসারের আয় রোজগারের জন্য নেই কোন পুরুষ মানুষ। কিভাবে চলছে মহিফুলের সংসার কেউ জানেনা, কেউ খবর রাখেনা, কেউ খবর রাখেনি।

নগরকান্দা উপজেলার কোদালিয়া শহীদনগর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার ও রাজাকারদের হাতে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের কথা এবং গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি নিয়ে প্রামান্য চিত্র নির্মাণ করেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ। তার চলচ্চিত্রে উঠে আসে মইফুল বিবি। সে দিন তারেক মাসুদের কাছে খুলে বলে তার সব কষ্ট সব না বলা কধাধ। আক্ষেপ করে মইফুল বিবি সেদিন বলেছিলো, ‘আপনের কাছে আমার দুঃখের কথা কইয়া কি লাভ ? যদি শেখের বেটি শেখ হাসিনারে আমার সামনে পাইতাম, তাইলে তারে আমার দুঃখের কথা খুইল্যা কইতাম।’

তারেক মাসুদের নির্মিত প্রামান্য চলচ্চিত্র ‘মুক্তির কথা’ দেশ-বিদেশে ব্যাপক ঝড় তোলে। মইফুল বিবির সেদিনের কথা ‘মুক্তির কথা’ প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় দেশ-বিদেশে সর্বত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ ছবিটি দেখেন, প্রধানমন্ত্রীকে নিজ গ্রামের স্বামীর ভিটায় বসে মইফুল বিবির এক নজর দেখার স্বপ্ন সেদিন জানতে পারেন শেখ হাসিনা।

মইফুল বিবির স্বপ্নকে সত্যি করতে ২০০১ সালের ১৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসেন নগরকান্দার ছোট পাইককান্দি গ্রামের এক অসহায় বিধবা মইফুলের ভাঙা ঘরে। সেদিন পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেনো আলো হয়ে মইফুলের চোখে ঘর বেঁধেছিলো। মইফুলকে সেদিন বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন গভীর মমতায়। গরীব অসহায় এ মহিলাকে নগদ ১০ হাজার টাকা, কিছু কাপড় ও চাল-ডাল সাহায্য হিসেবে দিয়েছিলেন সেদিনের ও আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী আছেন, সেই মইফুল বিবিও বেঁচে আছেন। কিন্তু মইফুল বিবি এখন কেমন আছে, কিভাবে বেঁচে আছে কেউ খবর রাখেনা। স্বামী হারা, সন্তান হারা মইফুল বিবি আজও যুদ্ধ করছে ভাগ্যের সাথে। শরীর বয়সের ভাড়ে এখন আর আগের মত চলেনা। তবু বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বিধবা পুত্রবধু আর ৪ জন নাতিকে নিয়ে কষ্টের সীমাহীন যন্ত্রনা বুকে চেপে রেখে কাঁচা মাটির ভাঙা ঘরে কোন রকমে দিন কাটাচ্ছেন হতভাগা নারী মইফুল বিবি।

খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘মুক্তির কথা’ প্রামাণ্যচিত্রে উঠে আসা আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভালবাসার সেই মইফুল বিবি বলেন, ‘আমার এহন অনেক বয়স হইছে। শেখের বেটি সেদিন নেতাগো কইয়া গেছিলো আমার খবর নিতে। কিন্তু সবাই যার যার কাম কাজে ব্যস্ত। তারা কেও আমার খবর নেয় না। এই বয়সে আমার কিছু চাওয়ার নাই। শুধু একটাই দুঃখ, আমি মরার আগে আমার বিধবা পুত্রবধু আর নাতিগুলার জন্য একটা ভাল ঘর আর খাইয়া পইড়া বাঁইচা থাকার ব্যবস্থা করতে পারলাম না। শেখের বেটি শেখ হাসিনা যদি আমার নাতিগো একটু দেখতো, তাইলে আমি মইরাও শান্তি পাইতাম। ’

মইফুল বিবি তার মৃত্যুর আগে দেখে যেতে চায়, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া তার স্বামীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, অন্য সবার মত তার পরিবারের সদস্যরা যেনো ভাল ভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পায়, তার বিধবা পুত্রবধু ও নাতী নাতনীর জন্য এতটকুু আশ্রয়।

মইফুলের এ সামান্য চাওয়া কি খুবই অযৌক্তিক মনে হয়? বৃদ্ধা মইফুলের নিরব কান্না আর না পাওয়ার বেদনা বার বার এ প্রশ্নটি সবার দ্বারে দ্বারে আজ রাখছেন। আজও স্বপ্ন দেখে মইফুল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই একদিন তার ডাক শুনবেন, গভীর মমতায় পাশে এসে দাঁড়াবেন। সেদিন হয়তো বদলে যাবে মইফুলের জীবনচিত্র, দুঃখ বেদনা আর না পাওয়ার সব ব্যাথা যন্ত্রনা। মইফুল বিবি আর কোনদিন কোন কিছু দাবি করবেনা। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। সরকার বা কোন হৃদয়বান ব্যাক্তি যদি মইফুল বিবির অকালে চলে যাওয়া একমাত্র ছেলের বিধবা স্ত্রী এবং ৪ টি সন্তানের পাশে দাড়ান তাদেরকে সহযোগিতা করেন তাহলে তার আত্মা শান্তি পাবে । আল্লাহ যেন মইফুল বিবিকে জান্নাত নছিব করেন।

(এনএস/এসপি/জানুয়ারি ১৬, ২০১৮)