ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » শিল্প-সাহিত্য » বিস্তারিত

জুলি রহমান’র গল্প

২০১৮ জানুয়ারি ৩১ ১৪:১৬:২৮
জুলি রহমান’র গল্প







অবচেতন মনের খেলা

টাঙ্গাইল জমিদার বাড়ি দেখার উদ্দেশ্যে ছুটছে হায়েস। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল। চৌদ্দজন যাত্রী তাতে। প্রত্যেকেই শিল্পী, কবি, নাট্যকার, অভিনেতা গীতিকার ও লেখক।গাড়ি গড়িয়ে চলছে সবুজের সমাহারে। পুকুর প্রান্তর খেলার মাঠ। সরিষা, ধান, কাউনের ফসলী জমি। কখনো বিরাণ ভূমি। বৃক্ষের তাবেদারীতে কাঠ গাছ সারিসারি! গুঁত করে নোঙর করলো গাড়িটি। খোলা প্রান্তর সবুজ মাঠের ঘন ঘাসের কার্পেটে।

সবাই নেমে পড়লো । কে কোথায় ছিটকে পড়লো কে জানে? কেউ ওয়াশ রুমে। কেউ টি স্টলে। কেউবা বসে গ্যাছে গানের সরঞ্জাম নিয়ে। তরিকুল একা হয়ে গেলো। সে জমিদার বাড়ির অন্তে প্রবেশ করে। কতো পুরনো জীর্ণ বাড়িটির গতর। কাঠের ফ্লোরে পা ফেলতেই মচমচ করে উঠলো। পেঁচানো সিঁড়ির ভাঁজ।তরিকূল উঠছে তো উঠছেই। নিচ থেকে কেউ একজন বলে ওঠে-আর উপরে যাবেন না। নামুন!
তরিকূল সিঁড়ির ভাঁজে দৃষ্টি গাঁথে। কই কেউ তো নেই। তবে কার কন্ঠ? হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। হ্যালো বলতেই আমিনূলের কন্ঠ ভেসে আসে। কইরে তুই কোথায় হাওয়া হয়ে গেলি? খাবো আমরা চলে আয়।নিচে নামতেই তমা।

বাহব্বা পারিস বটে। কই একটু ছবিটবি তুলবো সে লা পাত্তা।

তরিকূল হাসে। আসলাম তো জমিদার ভবনটা দেখতে এটাই তো আসল কাজ।

তমা-আর আমরা বুঝি নকল? হ্যা দেখবো! খেয়ে দেয়ে সবাই মিলে। চল ক্ষুধায় পেট একবারে চুঁ চুঁ করছে।

খাবার আয়োজনে নাজিমূলের জুড়ি মেলা ভার। সাহায্যের নিপুন হাত অমার।অমা কঠিন দৃষ্টিতে তরিকূলকে দেখে নিলো। আগে তো পেট পূজা। তারপর ব্রম্যচারী হও।লুট করো সাম্রাজ্য! শরীরে শক্তি তো করে নাও।

তরিকূল নমিত ভঙ্গিতে বলে জু হুকুম রানী মাতা।

অমা এবার আগুন।ভালো হবে না বলছি।তরিকূল দুহাত এক করে বলে গুস্তাকী মাফ করবেন মাহাতারা মা।

এবার অমা উঠে দাঁড়ায়! খাবোই না! যা খুশি তাই কর তোরা।

আমিনূর এবার বলে বেড়াতে এসে রাগ করতে নেই। তাহলে এনজয় দূরে থাক বদ হজমে পাকস্থলির বারোটা বাজবে। জানিস তো আমাদের কেউ একজন ও ডাক্তারি বিদ্যায় পারদর্শী নই।

খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই আবার দল ভাঙার প্রস্তুতি। কে কোথায় এবার ছিটকে পড়লো কে জানে। তরিকূল এবার জমিদার বাড়ির পুকুরে এসে পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো।বরফের মতো ঠান্ডা জল। চারপাশে প্রাচীর বেষ্টিত পুষ্করিনি লাল দিঘী নামে সবাই জানে। পুকুরের একপাশে লাল শাপলা ফুটে আছে আয়ত পাতা সহ।একটু একটু কাঁপছে পদ্নপাতার মতো শরীর সেই সাথে ফুল গুলোও। তরিকুলের দৃষ্টি পিনদ্ধ হয় ঐ কুমুদে।ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে তাল সুপোরী নারিকেল গাছের চিড়ল পাতায়। নাম না জানা হরেক রঙের বাহারী ফুলেবাতাসের মৃদু দোলায় হেসে হেসে গলে গলে পড়ছেযেনো । হঠাৎ একটি মুখ অর্ধ ডুবন্ত জলের ভেতর।দীঘল নাসারন্ধ্রে মতির ফুল পরন্ত বিকেলের সোনা রোদে সপ্ত আলো ছড়িয়ে পুকুরের শান্ত জলে অতি কিরণ প্রভার সন্চার করলো।অবাক তরিকূল ,অমা!

এই অমা? তুই কখন জলে নামলি রে? আয় উঠে আয় বলছি। দ্যাখ ভাই আমি ভালো সাঁতার জানি না।শেষে বিপদ হবে। উঠে আয় বলছি।

অমা এবার তাঁর হীরায় খচিত চুড়িতে পূর্ণ দু হাত যথা সাধ্য পানির উপরে তোলে। মুখটা তাতে পানির গর্ভে বিলীন হতে থাকে। চুড়ির নিক্কনে পুকুরের চারপাশ মধুর আওয়াজে ভরপুর হয়ে উঠে। তরিকূলের মনে হলো যে, এস্রাজে কে বা মিহি সুর তুলেছে। পরক্ষণেই অমার মুখটি তার মনের ভেতর পায়চারী করে বেড়ায়।অমা কী ডুবে যাচ্ছে? ও কখন এলো? আমি তো একাই এসেছিলাম।

তরিকুল ভুলে যায় সে সাঁতার জানে না। এবার অমাকে উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে । কিন্তু অমা কোথায়?কেউতো নেই!

পাড়ে থেকে তমা চিৎকার করে । এই সন্ধায় কেউ স্নানে নামে।লোকে যে বলে তুই একটা বাউলা ঠিকই ই বলে। উঠে আয় বুদ্ধু কোথাকার।গেলাম আমি।এই অমা কই রে? দিয়েছিস তো ক্ষেপিয়ে এবার ঠেলা সামলাও।

তরিকুল পাড়ে এসে বসে। কিন্তু তার পরনে পোশাক তো ভেজা না। অমার কথা কাউকে বলাই যাবে না।তাহলে ওরা আমাকে আস্ত ছিঁড়ে খাবে। মাগরিবের আযান পড়ছে।বাঁশিতে ফুঁক। দ্বার রুদ্ধ হবে। এখনই বেরিয়ে যাবে সবাই। পুকুরটি প্রাসাদের পেছন দিকে।একদম অন্দরে। তরিকুল উঠে দাঁড়ায়।বন্ধুদের খুঁজে।কোথাও কেউ নেই।

জোড়ে লোহার গেইট লাগলো এমন শব্দ কানে এলো । একবার ! দু বার ! তিন বার ! চারবার। তরিকুল দ্রুত পা চালায়। গাছে গাছে জোনাক আর মৌমাছি গুন্জন তুলে। দালানের গলি ঘুঁপচি মাড়িয়ে চিপা গলিতে পরতেই একটা চিকন মিহি সুর তাঁর দুকান ছাপিয়ে সুরের ইন্দ্রজালে যেনো তাকে লতার মতো পেঁচিয়ে নিচ্ছে। সেই সুর ধরে ধরেইতরিকুল অগ্রসর হতে থাকে। এবার যেনো সুরবাণী উভয়ের খেলা চলে-

তুমি যে আমাকে গিয়েছো ফেলে চিরতরে।
আলেয়ার আলো আমি এই আঁধারে
ভুলতে পারিনি কোনদিন আমি তোমাকে
যে তুমি ছিলে আমার মনের গভীরে--ঐ

প্রদ্বীপের কাছে জেনে নিও কোনো ক্ষণে
পতঙ্গ কেনো পুড়ে মরে আগুনে
ধূপের ধোঁয়ার আড়ালে গন্ধ বিলাপ
তাজা খুনে বেদীতে বিলায় যে ফুলেরে---ঐ

হতে পারিনি দেবী কোন দেবতার!
প্রেমের অর্ঘে তাই সাজে নাই জীবন আমার।
আজ এই ক্ষণে দেখে তোমায় নিজেকে পেলাম ফিরে---ঐ

বাতাসের কোষে কোষে কে যেনো অধরা হয়ে শূণ্যে মিলে যাচ্ছে। মুখ তাঁর বহু যুগের চেনা।কন্ঠ তাঁর কান্নার বেহাগ। অতি দূর থেকে ধীরে ধীরে সন্নিকটে ।

একি অমা? তুমি এখানে? তুমি এতো ভালো গাইতে পারো?আগে তো শুনি নি।
অমা এক রহস্যময়ী হাসি টেনে বলে শোনার সময় হয়নি তাই শোন নি। হঠাৎ অন্ধকার যেনো উভয়ের পৃথিবী ঢেকে দিলো।তরিরুল চিৎকার করে উঠে।

কোথায় তুমি অমা? আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না । এতো অন্ধকার কেনো?ওরা সবাই কোথায়?

একটা নরম বাহুর স্পর্শ পেলো তরিকুল। ইরানীগোলাপের সুগ্নধে মধুরতা ছড়ালো চারপাশ।

হঠাৎ হাজার বাতির ঝালরে সমাদৃত মহলে তরিকুলের প্রাদুর্ভাব। গজল পরিবেশন করছেন ওস্তাদ শমসের।তার সেই মধুর কলতানে মন্ত্র মুগ্ধের মতোই ক্রমোজম গীতের রসাস্বাদনে ব্যাপৃত মন তরিকুলের। ঘুঙুরের কিঙক্কিনি বেজেই চলেছে অমার সোনা রঙ পায়ে।

এক সময় ক্লান্ত দেহ লুটিয়ে পড়ে তরিকুলের কোলে। অমা আঁখি খুলে। সে চোখের দৃষ্টিতে তরিকুলের নজর বন্দী হতেই এক সন্মোহনী সূধা রসে সিক্ত হলো তাঁর দেহ ও মন। কী এক অজানা মোহে সিন্চিত শরীর গভীর আবেগে ঘন ঘন কাঁপতে থাকে সুখের পরশে। তরিকুলের মনে হলো জন্ম তাঁর সার্থক আজ এমন অবলা সুশীল রমনী পরশে।কী যাদু আছে তাঁর সঙ্গ সূধায়?

তরিকুল? ডাকে অমা। এতোদিন পর তুমি এলে?আমাকে এই প্রাসাদে জমিদারের কাছে মাত্র ক টা টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিতে পারলে তুমি? ভালোবাসা হীন জীবন যে কতো দুর্বিসহ যন্ত্রনার তুমি কী করে বুঝবে?

এক বৃদ্ধের কাছে যৌবনা মেয়ের অর্ধমৃত জীবন যাপন; না পাওয়ার গভীর বেদনা তুমি কী একটু ও উপলবদ্ধি করেছো? করোনি। তা-ছাড়াও ঐ জমিদারের ছিলো চার বৌ।

তাঁরা প্রতিরাতে অপেক্ষার পাথর সময় কাটাতো। জমিদার পড়ে থাকতো মক্ষী বাঈ ঘরে। একরাতে জমিদার আমাকে এই বাঈ ঘরে নিক্ষেপ করে আমি অপরুপা তাঁর জমিদারীতে ধন বাড়ানোর হাতিয়ার করে আমাকেই। বিভিন্ন দেশ থেকে জমিদার গন আসতেন তাদের মনোরন্জনে। আমি হলাম তাঁদের নিত্য রাতের দোসর। কচি বয়সে তারা আমার দেহটাকে ছিঁড়ে ছুবড়ে তুলে নিতে চায়। কিন্তু না আমি যে শুধু তরিকুলের।এই দেহ মন সবই যে তাঁর। আমি যে শুধু তার আমানতদার! এই দেহ পূঁত পবিত্র রাখা যে আমার কর্তব্য।তাই প্রতিরাতে তাদের সরাবে অতিমাত্রার নিকুটিন ঢেলে তাদের মাতাল করাই ছিলো আমার কাজ।নিজেকে রক্ষা করার আর কোন পথই খোলা ছিলো না।

একদিন প্রাসাদে প্রাসাদে এলার্ন হতে থাকলো পারশ্য থেকে আসছে এক অপরুপা বাঈ। তাঁর সাথে পাকিস্তানের যুবা জমিদার দৌহিত্র।উভয়েই উভয়ের প্রাণের দোসর। তাঁরা এক সপ্তাহ অতিথি শালায় অবস্থান করে জমিদারের কাচারী ঘরে বৈঠকে বসবে বানিজ্য কর্মে। যথা সময়ে সেই দিন এলো।

ঘোড়ার গাড়ি থেকে পারশ্য নারী বেরহলো জমিদার দৌহিত্রের হাত ধরে। আমাদের প্রাসাদের জমিদার আমাকে তাঁর সেই বন্ধুর পানি প্রার্থী করার অভিপ্রায়ে বৈঠক খানায় বসলেন। আমার দিকে নজর পড়তেই পাকিস্তানী জমিদার দৌহিত্র ধীরে ধীরে পারশ্য রমনীর হাত ছেড়ে আমার হাত ধরে। এতে জমিদার ধনন্জয় সুখের ঢেকুর তোলে যাক কাজ বাগিয়ে নেবার শ্রেষ্ট উপায় এখন তাঁরই ছোট রাণী।

রাত্রি গভীর থেকে গভীরতর। ঝিঁঝিঁ পোকারাও নিঃশব্দ। ধনন্জয় বাহির থেকে তালা বন্ধ করেছে আমাদের।কারণ আমি ধনন্জয়েকই ধরা দেইনি কোনদিন। এবার বুঝি আর বাঁচার উপায় নেই। দৈর্ঘ্য প্রস্থে একুশ বর্গ গজের প্রকোষ্ঠে জমিদার দৌহিত্র আমাকে নিয়ে রঙ্গ তামাশায় মেতে উঠে। সে আমাকে বসন মুক্ত করে।আমার দেহ সৌষ্ঠব চোখের দ্বারা লেহন করতে থাকে। তাঁর জীবনে সে না-কি এতো নিটোল দেহ আর দেখেনি। সে আমার স্তনকে সুউচ্চ পর্বতের সাথে তুলনা করতে করতে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। সে আমার অধরে অধর গুজে দেবার চেষ্টা করে বার বার ব্যর্থ হতে থাকে। গো-ধূলির সপ্তরঙা আলোকিত প্রভা আমার অধর। নরম শিমুল তুলো তাঁর স্পর্শ সূধা। জঠরস্থ মোহরসে তাকে ভিজাতে থাকে। চিতোর চিকুর কপোলে ঠোঁট লাগিয়ে শিউরে শিউরে উঠে।

আমার উঁড়ুতে তাঁর উড়ার বাঁধন তৈরী করার বহুবিধ চেষ্টার নিষ্ফল আর্তনাদ ঘরময় বিরহের শ্বাস ছড়াতে থাকে। কী ধন চাও তুমি সব সব এনে দেবো তোমার পায়। জমিদার দৌহিত্র হাপাতে থাকে। একসময় আমার নগ্নদেহটা তাঁর নগ্নদেহে লেপ্টে যেতে থাকে। দেহের কামে তাপে সে অধীর পাগল হয়ে ওঠে। আমার ভেতরও কী এক অজানা সুখ না দুঃখ । না কষ্ট । না, না পাওয়ার যাতনা। সুখ হয়ে বিবশ চিত্ত কেঁপে কেঁপে ওঠে। পুরুষ শরীরের প্রথম স্পর্শ এমন ? আমারও ছিলো অজানা। সমস্ত রাত্রির এই শরীর যুদ্ধের অবসান ঘটলো।

রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। সেখানে দৃষ্টি ফেলতেই চাঁদের কালিমায় নিজের দেহটাকে অসূচি মনে হতে থাকে। নারী জন্মের গ্লানি এক জমিদারের গৃহ লক্ষী অন্যের সহ্যা সঙ্গীনি। একদলা থুতু উগলে উঠতে চাইলো। ভাবনায় এলো আজ পাকিস্তান, কাল কাশ্মীর পরশু ভারত? আমি হয়ে যাব দেহ পশারিনী।নিত্যদিনে পুরুষের মনোরঞ্জনকারী। বার বার তরিকূল তোমার মুখটাই মনে পড়তে থাকে। আজ এই জোড়পূর্বক সম্ভোগে তোমার থেকেও বিচ্ছন্ন যখন তখন বেঁচে থাকার আগ্রহটা হারিয়ে ফেলি। বিষ পান করি। মৃত্যু যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে ভোরের সূ্র্য ওঠার আগেই ঐ পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

ঐ অতৃপ্ত মৃত্যু আমাকে শান্ত করেনি। বাড়িয়েছে অস্থিরতা। জগতে অতৃপ্ত আত্নার মৃত্যু নেই ধ্বংস নেই।থাকে সম্ভোগ প্রিয়তার এক মোহ। টান! যার থেকে তাঁর মুক্তি নেই। তাই প্রতি চাঁদনি রাতে একটু ভালোবাসার জন্য আমার প্রাণটি ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সেই না পাওয়ার ধনকে কাছে পাবার প্রবল তৃষ্ণা আমাকে পাগল করে তুলে।

এই পৃথিবীতে আমার অতৃপ্ত আত্নার ঘোরাফেরা।আজ তোমার দেখা পেয়ে খুশিতে আমি আত্নহারা। কিন্তু তোমার সাথে তো আমার দেহের মিলন হতে পারে না। তোমাকে আমার কাছে নিতে হলে যে তোমাকেও আমার পথেই আসতে হবে। তাই তোমাকে ঐ পুকুরে ফেলে মেরে ফেলেছি। এখন তুমি আমার। কেউ কোনদিন তোমাকে আমাকে আলাদা করতে পারবে না।

তরিকূল ভয়ে পিছাতে থাকে এ তুমি কী বলছো অমা! তুমিতো আমার বন্ধু অমা।

না আমি অমা নই। আমি এতোদ এলাকার গরীব কৃষকের কণ্যা নবীতুন। আর তুমি সেই গ্রামের ছেলে তরিকুল। একদিন জমিদারের পাইক পেয়াদা জোর করে আমাকে তুলে নিয়ে আসে। জমিদার ধনঞ্জয় আমাকে বিয়ে করে। কিন্তু আমাদের প্রেম?আমার তরিকুলকে আমি ভুলতে পারি না। দিনের পর দিন মানষিক অত্যাচার চলে আমার উপর। এই দ্যাখো চাবুকের আঘাত; বলেই অমা তার পিঠ উন্মুক্ত করে।তাঁর দুধে আলতা পিঠে কাঁটা কাঁটা দাগ। তরিকূলের মায়া হয়।

অমা এবার হাসে। তাঁর হাসিতে যেনো মুক্তো ঝরে।

অমা আমার আর কোন দুঃখ নেই।তুমি আমার পাশে আছো।

তরিকুল এবার ডাকে অমা ওরা কোথায়? তমা আমিনূল রশিদূল জবা ওরা কোথায়?

অমা এবার রেগে ওঠে তুমি কী ভুল বকছো। আমি নবীতুন।তোমার নবীতুন। তরিকূল আমতা আমতা করে বলে-নবীতুন? কোনোদিন তো এমন নাম শুনি নি। অমা তরিকূলকে অন্যমনস্ক দেখে কোলের উপর ফেলে ডাগর নয়নে অপলক চেয়ে থাকে। আর সে চোখের ভেতর রাজ্যের মায়া।তরিকুল ডুবে যেতে থাকে নবীতুনের চোখের সাম্রাজ্যে । তরিকুলের চোখে অমাই ঘুরছে সারাক্ষণ।তরিকূল অমাকে ছাড়া আর কিছুই দেখছে না।

নবীতুন তাঁর মখমলি সুগন্ধী মাখা আঁচলে তরিকুলের চোখ ঢেকে দেয়।ঘনঘোর বর্ষার গর্জন । প্রাসাদ ময় বাতি জ্বলে ওঠে। বাইরে বিদ্যুতের তীব্র হুংকার।ঘরে মজলিসে সুরের ঐকতান! অহির ভায়রু ক্ষণে ক্ষণে খাম্বাজ উর্দু হিন্দি মিশেল ক্লাসিক ধ্রুপদ।


ভিজে হাওয়া কী মেদুর শ্রাবণ ধারা
একেলা যায় না থাকা বাসর ছাড়া!
দক্ষিণা বলে কথা বাতাসের কানে কানে
প্রিয় মোর এসেছে ঘরে বয় সুখের ধারা--ঐ

বিরহ কেটেছে মোর যামিনী উছলা
হায় !বাজুবন্দ বেজে বেজে উতলা!
প্রিয় মোর সহে না যাতনা দূরে থাকার
আজ এই বরষা ভরা ভাদরা---ঐ

কাটেনা প্রহর আর মোহ মায়া
জড়ায়ে কাজরী দেখি শুধু প্রেম ছায়া
বৃথা নয় এ রজনী প্রিয় ওগো প্রিয় মোর
খোলো আঁখি পাতা ডেকে হই সাড়া--

তরিকূল নবীতুন নাম্নী অমার শরীরে লেপ্টে পড়ে আছে। সুরের ঐন্দ্রজালিক মায়া মোহ তাকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোথায়? কী সুখ ? অনন্তের এ সুখের ফল্গুধারা বর্ণনায় আনা যায় না। তরিকূল যেনো স্বর্গের সোনার পালকে শুয়ে ষোলো কলা সুর সঙ্গীতে মুগ্ধ! সকল রাগিনী তাকে বশ করে ফেলেছে। মেঘের ঘন ঘোর আলিঙ্গনে বৈরী আবহাওয়া ভোগের মোহের অন্তরায় হয়ে দঁড়িয়েছে।

অমা তাঁর দীঘল ডানার চোখের কোনে স্বপ্নতুলির ক্যানভাস আঁকে। যে ছবিতে তরিকূল ভিন্ন জগতের অন্ন কোন বস্তুদৃশ্যত নয়। জড়তার সকল নাগপাশ ছিন্ন করে দোঁহার প্রেমে দোঁহে বন্দী হতেই বৈলাপুরের ট্রাকের বিকট সাইরেন তন্দ্রাচ্ছন্ন তরিকূলের দেহে প্রবল ঝাঁকুনী তোলে। অমা তমা আমিনূল সবাই এক সঙ্গে বলে ওঠে তুই পারলি এমন একটা ঘুম দিতে? হাঁদারাম মফিজ্জা।

তরিকূলের তখনো স্বপ্নের ঘোর কাটেনি।সে অপলক অমার দিকেই চেয়ে আছে। আমিনূল মাথার পেছনে থাপ্পর মেরে বলে এই নাম ব্যাটা। নইলে তোরে নিয়েই চলে যাবো। পরে বাসে ঝুলে ঝুলে বাসায় যাওয়ার মজাটা টের পাবি।

তরিকূল নেমে পড়ে গন্তব্যে। চলে যাওয়া বন্ধুদের গাড়িটির দিকে তখনো সে চেয়ে আছে। এ যাবৎ ঘটে যাওয়া অবচেতন মনের খেলার কথা ভাবতে ভাবতে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধূপছায়া বৃক্ষের গতরে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়! রাতের অন্ধকারের চাদর তাকে এবার সত্যিই আড়াল করে নিলো।

(ওএস/এসপি/জানুয়ারি ৩১, ২০১৮)