ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » সম্পাদকীয় » বিস্তারিত

আজ আমার ১৭তম পুনর্জন্ম বার্ষিকী!

২০১৮ এপ্রিল ২০ ০০:০২:১৩
আজ আমার ১৭তম পুনর্জন্ম বার্ষিকী!

প্রবীর সিকদার
আজ ২০ এপ্রিল ২০১৮। আজকের এই দিনটি হতে পারতো আমার ১৭তম মৃত্যু বার্ষিকী। কেউ আমাকে ফুল দিয়ে স্মরণ করতো কিনা জানি না। তবে এটুকু হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, আমার স্ত্রী-সন্তানেরা বিপর্যস্ত জীবন যুদ্ধের মধ্যে থেকেও চোখের জলে আমাকে স্মরণ করতে কোনই ভুল করতো না। কিন্তু সেটা হয়নি! আর সেটা না হওয়ায় আজ আমি পালন করতে পারছি আমার ১৭তম পুনর্জন্ম বার্ষিকী!

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাবা, কাকা, দাদুসহ হারিয়েছি অনেক স্বজন। বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে রাজাকারেরা। তাঁর লাশও পাইনি। একাত্তরের উদ্বাস্তু ও বিপর্যস্ত জীবন নিয়ে আমি আজও বাবার লাশ খুঁজে বেড়াই। বাবার লাশ খুঁজতে খুঁজতে আজ আমার কাছে পুরো বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে আমারই বাবার কবরস্থানে। সেই কবরস্থানের মর্যাদা রক্ষার লড়াই করি নিরন্তর। আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল থাকা সেই নৃশংস 'একাত্তর' আমি ভুলি কি করে!

২০০১ সাল। আমি তখন আমার গ্রাম কানাইপুরে দারুণ ব্যস্ত বেগম রোকেয়ার নামে আমার প্রতিষ্ঠা করা বালিকা বিদ্যালয় পরিচর্যায়। একই সাথে আমি তখন কাজ করি দৈনিক জনকণ্ঠের ফরিদপুর প্রতিনিধি হিসেবে। দৈনিক জনকণ্ঠে তখন বহুল আলোচিত সিরিজ রিপোর্ট 'সেই রাজাকার' প্রকাশ পাচ্ছিলো। সেই সিরিজে ঠাই পেয়েছিলো হাল আমলে দেশের প্রথম ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত দুর্ধর্ষ পলাতক যুদ্ধাপরাধী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, মুসা বিন শমসের ওরফে রাজাকার নুলা মুসাসহ কয়েক দুর্ধর্ষ রাজাকারের একাত্তরের ভয়ংকর ইতিবৃত্ত নিয়ে আমার অনুসন্ধানি রিপোর্ট। আর ওই রিপোর্ট লেখার অপরাধে(?) ২০০১ সালের ২০ এপ্রিল ফরিদপুরের বদরপুরে আমার ওপর হয়েছিল নৃশংস হামলা। বোমা মেরে, গুলি করে, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আমার মৃত্যু নিশ্চিত করেই রাজাকারের ভাড়াটে দুর্বৃত্তরা সেদিন পালিয়েছিল। বদরপুর থেকে প্রথমে আমার রক্তাক্ত দেহ নেওয়া হয় ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে; সেখান থেকে ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, পঙ্গু হাসপাতালে। পরে ঢাকা থেকে আমাকে পাঠানো হয় সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতাল ও মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, দৈনিক জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ, সারাদেশের সাংবাদিক সমাজ ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতা, সহমর্মিতায় দীর্ঘ চিকিৎসায় আমি জীবন ফিরে পেলেও আমাকে হারাতে হয়েছে একটি পা। স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারায় আমার একটি হাত। শরীরে চিরদিনের মতো ঠাই করে নেয় বোমার অনেক স্প্লিনটার। কৃত্রিম পায়ে ভর করে চলে আমার নতুন জীবনযুদ্ধ। সেই যুদ্ধ চলাকালেই ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট এক প্রভাবশালীর ইশারায় কোনো অভিযোগ ছাড়াই আমাকে আটক করে ঢাকার ডিবি পুলিশ। পরে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় আমার বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা হয়। নাটকীয়ভাবে সেই মামলায় আমাকে আটক দেখিয়ে ফরিদপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। ফরিদপুরের ওই থানায় ১৭ আগস্ট দিনভর চোখ বেঁধে আমার ওপর নির্যাতন চালানো হয় ও সন্ধ্যায় আমাকে ফরিদপুর জেলা কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৮ আগস্ট ফরিদপুরের আদালতে পুলিশ আমার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। ওই সময় ফরিদপুরের কোনো আইনজীবীকেই আমার পক্ষে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। শেষ মুহূর্তে আলী আশরাফ নান্নু নামের এক সাহসী আইনজীবী প্রভাবশালীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে আমার পাশে দাঁড়ান। আদালত পুলিশের আবেদনে সাড়া দিয়ে আমার ৩দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মজার বিষয় হল, পুলিশ আর আমাকে রিমান্ডে নেওয়ার সময় পায়নি। আমার গ্রেফতারের নিন্দা ও অবিলম্বে মুক্তির দাবিতে দেশে বিদেশে তীব্র আন্দোলনের মুখে পরদিন ১৯ আগস্ট আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

কৃতজ্ঞতা জানাই সাংবাদিকসহ সারা দেশবাসীকে, যারা আমার পাশে থাকায় আমি বার বার এমন যুদ্ধ করতে পারছি। আর সেই যুদ্ধ করতে পারছি বলেই ২০ এপ্রিল ২০১৮ দিনটি ১৭তম মৃত্যু বার্ষিকী না হয়ে হয়ে উঠেছে আমার ১৭তম পুনর্জন্ম বার্ষিকী। আর সেই সঙ্গে জানিয়ে রাখি, জামিন পেলেও মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। ঢাকার সাইবার আদালতে আমার বিচার চলছে। একদিন হয়তো আমাকে ৫৭ ধারার মামলায় সাজা দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে কারাগারে! তবু কষ্ট নেই, সকলের ভালবাসার সামনে ওই সাজার পরোয়া আমি আর করতে চাই না। এর চেয়ে বরং পুনর্জন্ম নিয়েই থাকি আনন্দে।

১৭তম পুনর্জন্ম বার্ষিকীতে সকলের প্রতি রইলো আমার কৃতজ্ঞতা ও স্যালুট; কেননা সকলের ভালোবাসা পেয়েছি বলেই তো আমার এই বেঁচে থাকা শুধু নয়, অর্থপূর্ণ বেঁচে থাকা সম্ভব হচ্ছে।