ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » আনন্দ বেলা » বিস্তারিত

কাজী হালিমা আফরীন’র গল্প

২০১৮ মে ১৫ ১০:০৩:৪৪
কাজী হালিমা আফরীন’র গল্প







রেশমীর "মা" দিবস

বাসার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে গেলেন সালমা খালা। সালমা খালা দরজা খুলেই হাঁফ ছেড়ে বললেন, বাবা আইসা গ্যাছো? রহিম সাহেব ঘরে ঢুকে সালমা খালাকে বললেন, রেশমী কোথায়? এইডা তো বলবার লাগছিলাম বাবা কথাগুলো একনাগাড়ে বলে ফেললেন সালমা খালা!

রহিম সাহেব ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে আবারো বললেন, রেশমী কোথায়? সালমা খালা খানিকটা দম নিয়ে এবার বললেন, রেশমী স্কুলে যায় নাই আজ। সারাদিন কিছুই খাইও নাই। দাদু আমার বারান্দার এক কোণে বসে কি যেন একটা আঁকাআঁকি করতাছে! সারাদিন ও কি যেন বলতাছিল; মা দিবস না কি জানি একটা কিছু! আমি এসবের কিছুই বুঝিনা বাবা। সালমা খালা রহিম সাহেবের পিছনে যেতে যেতে কথাগুলো বলছিলেন।

রহিম সাহেব বারান্দায় গিয়ে দেখলেন, রেশমী একটা আর্ট পেপারে কাউকে আঁকছে। মুহূর্তে অমাবস্যার আঁধারে রহিম সাহেবের মুখটা ঢেকে গেল। । রেশমী যাঁর ছবি আঁকছে, তাঁকে সে কখনোই দেখিনি।‌

রেশমীর জন্মের সময় হাসপাতালেই তার মা না ফেরার দেশে চলে যায়। তারপর তিনি মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দ্বিতীয় বিয়ের দিকে আর পা বাড়াননি! রহিম সাহেবের চোখে জল চলে এলো! কাল রেশমীর জন্মদিন। এক এক করে নয়টি বছর চলে গেল। এবারের জন্মদিনটি রেশমীর জন্য একেবারেই অন্যরকম। আগামীকাল "মা" দিবস। জন্মদিন ও মা দিবস দুটিই যেন তার কাছে স্পেশাল। যদিও মা ছাড়া মা দিবসটা তার কাছে শুধুই কল্পনার!

রেশমী বড় হয়েছে। সে অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। সে যখন ছোট ছিল, মায়ের কথা জানতে চাইলেই বাবা তাকে বলতেন; তোমার মা চাঁদের দেশে গেছে। তুমি খেলে, ঘুমালে মা এসে তোমার কপালে চুমু দিয়ে যাবে!

কিছুদিন আগেও সে এ কথা বিশ্বাস করে ঠিকঠাক মতো খেয়েছে, ঘুমিয়েছে। এখন আর সে নিজেকে ছোট ভাবে না । সব কিছুই সে বুঝে ফেলেছে। সে এটাও ঠিক করেছে, সে সব কিছু বুঝে ফেলেছে এটা সে বাবাকে বুঝতে দিবে না। জন্মের সময় সে মাকে হারিয়েছে, মায়ের মুখের আকৃতিটাও তার জানা নেই। রেশমী তার বাবাকে হারাতে চায় না!

রহিম সাহেব বাঁ হাতে নিজের চোখ মুছে নিলেন আর ডান হাতটা মেয়ের মাথায় রাখলেন! সালমা খালা দূরে খন্ড মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে অতীতের সব স্মৃতিগুলো মাঝে হারিয়ে গেলেন! সেই শৈশবেই রহিম সাহেব তাঁর বাবা মাকে হারিয়েছেন। সালমা খালাই তাঁর আরেকটি ছেলের মতই বুকে পিঠে করে বড় করেছেন।

রহিম সাহেব খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তরতরিয়ে ভালো রেজাল্ট করে একেবারে ডাক্তারের খাতায় নাম লেখালেন। সালমা খালার গ্ৰামে ধনী আইনুল চেয়ারম্যান এমন ছেলেকে হাতছাড়া করলেন না। সালমা খালাও সম্মতি জানালেন। রহিম সাহেব আমিনাকে বিয়ে করে ঢাকায় চলে এলেন।

রেশমীকে একা করে আমিনার চলে যাওয়ায় রহিম সাহেব আঁধারে হারালেন জীবনের অর্ধেকটা। বাকি অর্ধেকটা মেয়েকে সম্বল করেই বেঁচে থাকা।

রহিম সাহেব ঢাকায় চলে যাওয়ার পর সালমা খালা স্বামীকে হারান। বাড়ি, সম্পত্তি সব সালমা খালার নামে থাকলেও একই বাড়িতে ছেলে ও ছেলের বউ এর সাথে থাকা সম্ভব হয়নি সালমা খালার। ছেলে ও তার বউ সাফ জানিয়ে দিয়েছে হয় তারা ঐ বাড়িতে থাকবে না হলে সালমা খালা।

সালমা খালা এক কাপড়ে বেরিয়ে এসে সোজা রহিম সাহেবের বাসায় উঠেন। মা হারা ছোট্ট রেশমীকে বুকে তুলে নেন। রহিম সাহেবেও আঁধারের মাঝে এক টুকরো সূর্যের আলো দেখলেন। অন্তত মেয়েটা তার দাদীর ভালোবাসা পাবে।

এরপর আর কোনো চিন্তা করতে হয়নি রহিম সাহেবের। রেশমীর খাওয়ানো, গোসল করানো থেকে শুরু করে স্কুলে নিয়ে যাওয়া সবই সালমা খালা গুরু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

রহিম সাহেব রেশমীর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, সোনা মা তোমার মন খারাপ কেন? তোমার কাল জন্মদিন; তুমি, আমি আর দাদী মা আমরা অনেক দূরে বেড়াতে যাবো! তোমার স্কুল থেকে আমাকে ফোন করেছিল। তুমি আজ স্কুলে যাওনি বলে।

রেশমী বাবার বুকে মাথা রেখে বললো, আজ স্কুলে "মা" দিবস উপলক্ষে মায়েদের জন্য আয়োজন ছিল। মায়েদের জন্য বিশেষ গিফটের ব্যবস্থা ছিল। আমার তো মা নেই। মা দিবস আমার জন্য না। আমার ফ্রেন্ডরা ইনজয় করেছে। আমি বাসায় বসে মায়ের ছবি এঁকেছি! সালমা খালা রেশমীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রহিম সাহেব চোখের জল সামলাতে ভেতরের ঘরে পা বাড়ালেন!!