ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

এ কেমন জাতীয় ঐক্য, কিসের ঐক্য?

২০১৮ সেপ্টেম্বর ২৪ ১৫:৩৩:৩৫
এ কেমন জাতীয় ঐক্য, কিসের ঐক্য?

সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মা


আমি কোন নামিদামি কলাম লেখক না, লেখার অভ্যাসও তেমন নেই। উপজেলা পর্যায় থেকে সমকালসহ বিভিন্ন স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় এলাকার সমস্যা, উন্নয়ন, দুর্নীতি, সম্ভাবনা নিয়ে লেখালেখি করি। এতদিন জেনে এসেছি এবং শুনে এসেছি জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। দেশে যখন কোন দূর্যোগপূর্ণ মূহুর্ত আসে সে সময় জনগণ উজ্জিবিত হয় সেই উজ্জিবিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোন না কোন নেতার আহবান লাগে। শনিবার ঢাকায় একটি জাতীয় ঐক্যের সভা হয়েছে। এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ গণফোরাম নেতা ড.কামাল হোসেন, বিকল্পধারার সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দুজা চৌধুরী, জাসদ নেতা আ.স.ম আঃ রব, নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরী। তাদের ঐক্যের সভায় বিশেষ সুবিধা আদায়ের জন্য যোগ দিলেন বি.এন.পির ব্যর্থ মহাসচিব হিসেবে খ্যাত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

আমার প্রশ্ন এ কিসের জাতীয় ঐক্য, কেমন ঐক্য? দেশে এমন কি দূযোর্গপূর্ণ মূহুর্ত এসেছে, যার জন্য জাতীয় ঐক্য করে এই দেশের সরকার ব্যবস্থাকে জাগ্রত করতে হবে বা শুধরিয়ে নিতে হবে ? অথবা এই ঐক্যের সঙ্গে দেশের জনগনের কতখানি সমর্থন আছে ? শনিবার ঐক্যের সভা হয়েছে ঢাকায়, রবিবার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ও অনলাইনে, টেলিভিশনে এই সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই জনমনে চলছে নানামুখী আলোচনা সমালোচনা।

সাধারণ পাঠক ও সাধারন মানুষের মুখ থেকে আলোচনায় বেড়িয়ে আসছে দেশেতো কোন দূর্যোগ নেই, কোন সমস্যাও নেই তবে কেন ড.কামাল হোসেনের মতো লোক জাতীয় ঐক্যের ডাক দিলেন ? তাদের প্রশ্ন এই জাতীয় ঐক্যের সঙ্গে দেশের মোট জনসংখ্যার ১০০ ভাগের ১ ভাগ লোকের সমর্থন আছে কি ? আমার মনে হয় না। কারণ জনগণের কোন সমস্যা নেই বলেই তাদের সমর্থন জাতীয় ঐক্যে নেই। যারা জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে বিশেষ সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছেন, তাদের এই চেষ্টাটি জনগণ যদি সঙ্গে না থাকে সেই ঐক্য বিএনপির মহা সচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য এতদিন শুধু বিবৃতি দিয়ে যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন সেটির মতোই হবে।

বিএনপি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। আওয়ামীলীগ বিরোধী যত শক্তি আছে সবই এখানে গিয়ে মিশেছে। খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপি সারা দেশে আন্দোলনের ডাক দিয়ে কোন জাগরণ সৃষ্টি করতে পারেনি। এখন জাতীয় ঐক্য করে বিএনপির নেত্রীকে মুক্ত করে আগামী সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পরিকল্পনায় যে ঐক্য তা কিন্তু জনগণ বুঝে ফেলেছে। বিএনপির আন্দোলনে জনগনের সাড়া না দেওয়ার কারণ একটাই। জনগণ জানে এবং দলের নেতাকর্মীরাও জানে আদালতে আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই খালেদা জিয়া কারাগারে অন্তরিন আছেন। এখানে শেখ হাসিনা জোর করে তার দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে বের করে কারাগারে ঢুকিয়ে রেখেছেন এমন ঘটনা যদি হতো তাহলে নিশ্চই জনগণ মাঠে নেমে পড়ত এবং বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামেও সাড়া দিত। খালেদা জিয়ার মুক্তি ডাকে জনগণতো দূরের কথা দলের সব নেতাকর্মীরাই মাঠে মিছিল মিটিং এ নামেন নি। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে মাঠে নামলেই তো মামলা হয়।

এর উত্তরে আমি বলব, ১৯৭১ সনের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে ডাক দিয়েছিলেন এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সেদিন লাখ লাখ মানুষ মুক্তির সংগ্রামে ঝাপিয়ে পরেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা দিতে পেরেছিল, কয়জনকে গ্রেফতার করতে পেড়েছিল? এই যুদ্ধে আমাদের ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছে, ২ লাখ মা বোন ইজ্জত সম্ভ্রম হারিয়েছে। বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা ও লাল সবুজের পতাকা।

বর্তমানে এরকম জাতীয় ঐক্যের কোন বিষয় হলে, ঐক্যের ডাক দিলে, জনগণ নিশ্চয়ই জাতীয় ঐক্যের ডাকে সাড়া দেবেন। কিন্তু নিজেদের স্বার্থে কোন ঐক্য গঠনের চেষ্টা করলে জনগণ তাতে সাড়া দেবেনা। এই যে জাতীয় ঐক্য করা হয়েছে, এই ঐক্য জনগণের মতে, আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে ঐক্য, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ঐক্য, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ঐক্য। এর কারণ এই, ১৯৭১ সনে ড. কামাল হোসেন মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি, তিনি তখন পরিবারের সকলকে নিয়ে পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন। এটা কিন্তু দেশের সব মানুষ জানেন। বঙ্গবন্ধু তাকে প্রথম বারের মতো ক্ষমা করে দিয়ে তার মেধার জন্য, তার উঁচু মাপের যোগ্যতার জন্য কাছে টেনেছিলেন। কিন্তু ড. কামাল হোসেন তখন কি করেছেন তা তিনি নিজেই নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে দেখুন। এর পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালো রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিপারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো। আন্তর্জাতিক মানের একজন আইনজীবী হিসেবে সে সময় কি ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে কোন জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন? বা কোন পত্র-পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করে কোন বিবৃতি দিয়েছিলেন? আমার মনে হয় না। এর পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনিদের যখন বিভিন্ন দুতাবাসে চাকরি দিয়েছেন পুনর্বাসন করেছেন বিভিন্ন ভাবে। সে সময় কি ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন? দেন নি।

ড. কামাল হোসেনের মতো ঐক্যের ডাক দেন নি বি. চৌধুরী, আসম আ. রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরীও। ২০০৪ সালে ২১ আগষ্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে যখন গ্রেনেট হামলা চালিয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য হামলা হয়েছিল সে হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমান সহ আরো অনেকেই নিহত হয়েছিলেন। তাছাড়া ২০০৫ সালে ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ভয়াল দিন।

২০০৫ সালের এ দিনে জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) একযোগে ৬৩ জেলার ৪৩৪ স্থানে বোমার বিম্ফোরণ ঘটায়। সরকারী মদদে জঙ্গিবাদের বাংলাদেশ আর চাই না। বিএনপি জামায়াতের শাসন আমল (২০০১ থেকে ২০০৬) এ সরকারী এমপি মন্ত্রীদের মদদে সারা বাংলাদেশে শক্ত অবস্থান তৈরি করে জঙ্গিরা। মুছে যায় বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনা। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট মুন্সিগঞ্জ জেলা ছাড়া দেশের ৬৩ টি জেলায় মোট ৪৩৪ টি স্থানে বোমার বিষ্ফোরণ ঘটে। ওইদিনের ঘটনায় দু’জন নিহত এবং অর্ধশত আহত হন। দেশে এরপর শুরু হয় জেএমবির আত্মঘাতি বোমা হামলা।

পরবর্তী সময়ে কয়েকটি ধারাবাহিক বোমা হামলায় বিচারক ও আইনজীবীসহ ৩০ জন নিহত হয়। আহত হয় ৪ শতাধিক। ওই বছরের ৩ অক্টোবরে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর এবং লক্ষীপুরের আদালতে জঙ্গিরা বোমা হামলা চালায়। এতে তিনজন নিহত এবং বিচারকসহ কমপক্ষে ৫০ জন আহত হন। এর কযয়েকদিন পর সিলেটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক বিপ্লব গোস্বামীর ওপর বোমা হামলার ঘটনায় তিনি এবং তার গাড়িচালক আহত হন। ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে বিচারক বহনকারী গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালায় আত্মঘাতি জঙ্গিরা। এতে নিহত হন ঝালকাঠি জেলা জজ আদালতের বিচারক জগন্নাথ পান্ডে এবং সোহেল আহম্মদ। এই হামলায় আহত হন অনেক মানুষ।

সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে ২৯ নভেম্বর গাজীপুর বার সমিতির লাইব্রেরি এবং চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে। গাজীপুর বার লাইব্রেরিতে আইনজীবীর পোশাকে প্রবেশ করে আত্মঘাতি এক জঙ্গি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এই হামলায় আইজনজীবীসহ ১০ জন নিহত হন। নিহত হয় আাত্মঘাতি হামলাকারী জঙ্গিও।

একই দিন চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে জেএমবির আত্মঘাতি জঙ্গিরা বিষ্ফোরণ ঘটায়। সেখানে রাজিব বড়–য়া নামের এক পুলিশ কনস্টেবল এবং একজন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। পুলিশসহ আহত হন প্রায় অর্ধশত।
১ ডিসেম্বর গাজীপুর ডিসি অফিসের গেটে আবারো বোমা বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সেখানে নিহত হন গাজীপুরের কৃষি কর্মকর্তা আবুল কাশেম। এই ঘটনায় কমপক্ষে ৪০ জন আহত হয়। ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় ভয়াবহ বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটে। নেত্রকোনা শহরের বড় পুকুর পাড় উদীচী শিল্প গোষ্ঠীর অফিসের সামনে বোমার বিষ্ফোরণ ঘটায় আত্মঘাতি জঙ্গি দল। সেখানে স্থানীয় উদীচীর দু’নেতাসহ ৮ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক।

১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় ঢাকা মহানগর ছাড়া সারাদেশে দায়ের করা হয় ১৩৮ টি মামলা। হামলার ঘটনার সাথে জডড়িত সন্দেহে ১ হাজার ৪০০ জন গ্রেপ্তার হয। পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই করে ৯৮১ জনকে বিভিন্ন মামলায আসামি করা হয়। এছাড়া, রাজধানীর ৩৩ টি স্পটে বোমা হামলার ঘটনায় ১৮ টি মামলা দাযয়ের হয়। এই ১৮ টি মামলার মধ্যে ৫ টি মামলার বোমার বাহককে এখনও খুঁজে পায়নি পুলিশ।

আমার প্রশ্ন এই স্বাধীন বাংলাদেশে এতো দূর্যোগপূর্ণ ঘটনা ঘটেগেল সে সময়ে আজকের এই জাতীয় এক্যের নেতারা কোথায় ছিলেন? ড. কামাল হোসেনের মতো এ রকম একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজীবী যিনি বাংলাদেশের সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনিই কেন জাতির এতগুলো দূর্যোগপূর্ণ মূহুর্তে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেননি। আর আজকে দেশেতো কোন সমস্যাই নেই, কোন দূর্যোগও নেই, তবে আজ কেন জাতীয় ঐক্যের ডাক।

আমি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলতে পারি তাদের এই তামাশা জাতীয় “জাতীয় ঐক্যের” ডাকে এ দেশের জনগনের কোন সমর্থন নেই থাকবেও না কোন দিন। তারা জাতীয় ঐক্যের মঞ্চে বসে ঘুমুতে পারবেন, ষড়যন্ত্র করতে পারবেন কিন্তু জাতির জন্য দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারবেন না। তাই বলছি, এ কেমন জীতয় ঐক্য ? কিসের জাতীয় ঐক্য ?

লেখক : সমকাল সাংবাদিক, সভাপতি কেন্দুয়া উপজেলা প্রেসক্লাব