ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

হাজার বছরের ভাবনা ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা

২০১৮ অক্টোবর ১২ ১৫:৪৩:০৯
হাজার বছরের ভাবনা ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা

কবীর চৌধুরী তন্ময়


প্রতিটা মানুষের আলাদা আলাদা স্বপ্ন, চিন্তাধারা, বিচার-বিশ্লেষণ ও কর্মপরিকল্পনা থাকে। যার উপর নির্ভর করে ব্যক্তির সফলতা। খোকা থেকে মুজিব ভাই, মুজিব ভাই থেকে শেখ মুজিবুর রহমান এবং ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমান থেকে নেতা, বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনক হওয়ার প্রতিটি ধাপে ধাপে একেকটি গল্প, একেকটি ইতিহাস রচনা হয়েছে। কখনো সুখের আবার কখনো দুঃখের। কেউ ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে আবার কেউ দেশদ্রোহী, বিচ্ছিন্নতাবাদী বলেও তিরস্কার করেছে। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতনের মধ্যে জীবের সোনালী সময়টুকু অন্ধকার কারাগারে নিমজ্জিত করেছিল পাকহানাদার বাহিনী।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিঁনি তাঁর চিন্তা-চেতনা আর স্বপ্নের ঘরে ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন। এমনকি, পাকিস্তানীদের খোড়া কবর দেখেও বঙ্গবন্ধুর মুল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি, বাঙালি জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। তিঁনি ১৯৪৭ থেকেই কর্মপরিকল্পনা নিয়ে একটু একটু করে নিজ লক্ষে এগিয়ে গেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ; প্রতিটি মাঠ-ঘাট আর স্লোগান সাজিয়েছে নিজের একান্ত স্বপ্ন থেকে, চিন্তা-চেতনা থেকে। মুক্তির সনদ খ্যাত ৬ দফার পক্ষেও তখন অনেকে দ্বিমত পোষন করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৬ দফাই হয়ে উঠে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা।

সম্প্রতি প্রকাশিত, ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অফ দা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইটিতে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা এবং সর্বপরি তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান কখন কোথায় কীভাবে কী অবস্থানে ছিল; তার তথ্য প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়।

কোটা পদ্ধতিতে ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উপহার স্বরুপ মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রথা চালু করেন। এখানে অনেকেই বলে থাকেন, এটা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অপমানজনক। আবার অনেকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর বলেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু করেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখার যৌক্তিকতাও অনেকে তুলে ধরেন।

এখন প্রশ্ন করতে পারেন, বঙ্গবন্ধুর উপহার অপমানজনক হবে কেন? আর উপহার কি অপমান করার জন্য প্রদান করা হয়ে থাকে? নিশ্চয় নয়। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান-এটা শুধু মৌখিকভাবেই নয়, এটাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে তোলার জন্য, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান নিশ্চিত করার লক্ষে বঙ্গবন্ধুর সুদূর চিন্তাভাবনা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক স্তরে অন্তর্ভূক্ত করেন। কারণ, এই দেশকে মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে আর কেউ বেশি ভালোবাসতে পারে না যা তাঁরা মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়ে এটা প্রমাণ করেছেন।

মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর-এটার সাথে আমি অনেকাংশে একমত। আমার পরিবারের কথাই যদি বলি, আমার বড় কাকার সাথে আমার যুবক বাবা কুমিল্লার গোমতী নদী পাড়ি দিয়ে ভারতের সোনাইমুড়ি দিয়ে আগারতলায় ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। বড় কাকার প্রথম সন্তান মেয়ে জন্মের খবরে গভীর রাতে এক নজর নবজাতক মেয়েকে দেখতে আসলে স্বাধীনতাবিরোধী-রাজাকার টের পেয়ে যায়। একদল পুরো বাড়ি ঘিরে রাখে, আরেক দল ভিতরে ঢুকে বড় কাকাকে টেনে-হিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে হত্যা করে। বড় কাকার মরদেহ কোথায় লুকিয়েছে তা আমরা আজও জানতে পারিনি। আমার অবিবাহিত বাবা তখনও আগারতলায়...। মুক্তিযুদ্ধের আগেরকার সময়ে আমার বাবা ছিল একজন বড় ব্যবসায়িক। গুড়, আটা ও লবণের তিন তিনটে আড়ৎ-এর মালিক। প্রভাব-প্রতিপত্তি, টাকা-পয়সাসহ সকল ধন-সম্পদের দিকে না তাকিয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে বড় কাকার সাথে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন।

লেখাটা বেশি লম্বা না করতেই সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরে বলতে চাই, আপনিও আপনার নিজগুনে একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন- যেখানে কন্যা সন্তানকে দেখতে এসে বড় কাকা নির্মমভাবে হত্যা শিকার হতে হয়েছে সেখানে আমার অবিবাহিত যুবক বাবার তিন-তিনটে আড়ৎ ও অর্থ-সম্পদের কী হাল হতে পারে?

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শুধু ভিটে বাড়ি ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। আমার বড় ফুফু বড় কাকার মরদেহের সন্ধানে দিন-রাত এখানে-সেখানে গিয়েছে। বিচারের আর্জি নিয়ে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পর্যন্ত এসেছে। বঙ্গবন্ধু বাবার পিঠে বাহবার আর্শীবাদ আর ছোট ফুফুকে ১০ টাকার একটা নোট দিয়ে বড় কাকার মরদেহ খুঁজে বের করার জন্য, যথাযথ বিচারের উদ্যোগ নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়ে একটি চিঠিও দিয়েছিল।

পাঠক! আমার বড় কাকা, বাবা, মুক্তিযোদ্ধারা কখনো এক টুকরো কাগজে মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতির জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি। মুক্তিযোদ্ধা কোটার জন্যেও মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েননি। মুক্তিযুদ্ধ কী, স্বাধীনতা কী, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কী হবে-এটাও তাঁরা জানত না। শুধু জানত, বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিল, ঘরে-ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। রক্ত দিয়ে হলেও পাকিস্তানীদের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে মুক্ত হতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মকে শত্রুমুক্ত করতে হবে।

আমি বাবার মুখে শুনেছি স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তাঁর জীবন যুদ্ধের আরেক অধ্যায়ের করুন গল্প। এক শহর ছেড়ে অন্য শহরে এসে রিকশা চালিয়ে বাড়িতে টাকা পাঠিয়েছে। ধনী পরিবারে জন্ম নেওয়া আমার মাকে বুঝতে দেয়নি ওই শহরে কী কাজ করেছে! কত রাত না খেয়ে ছিল, কত রাত রাস্তার ফুটপাতে ঘুমিয়েছে; কথাগুলো বলতে না চাইলেও বাবার চোখের ভাষায় স্পষ্ট বুঝা যায়। যে যুবক নিজে গাড়ি চালিয়ে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়েছে, যে যুবক তিন বেলায় তিনটে পোশাক পড়েছে; সে যুবক মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন দেশে এক পোশাকে কত দিন, কত যে রাত কাটিয়েছে; তার হিসেবও তিঁনি করতে পারেনি।

স্বাধীনতার ৪৭ বছরের এই সময়ে এসেও পত্রিকার পাতায় পাতায় শোভা পায় মুক্তিযোদ্ধার জীবন-যাপনের করুন গল্প। আবার সার্চ ইঞ্জিন গুগলে ‘মুক্তিযোদ্ধার জীবন’ দিয়ে সার্চ দিলে বেরিয়ে আসে, ‘মুক্তিযোদ্ধার জীবন চলে রিকশা চালিয়ে’, ‘মুক্তিযোদ্ধার জীবন চলছে টিউশনি করে’!

বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের চিন্তা-চেতনা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অন্তর্ভূক্তিকরণ করেছেন। তিঁনি ইচ্ছে করলে তখন সংবিধানেও মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে একটি লাইন সংযুক্ত করতে পারতেন। তিঁনি জানেন, সম্মান সবার উপরে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া উপহার সবাই সম্মান করবে, মর্যাদা দিবে। আর এই সম্মানস্বরুপ মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা প্রথায় নিয়ে আসেন।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে বঙ্গবন্ধু সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন একমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাত দিয়েই সম্ভব। তাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতিটি স্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের সমান অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষেই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভূক্ত করেন। কারণ, দেশ ও দেশের স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব, ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষের বেশি সম্ভ্রমবিনাশে নারী মুক্তিযোদ্ধার লাল-সবুজের পতাকা একমাত্র মুক্তিযোদ্ধার হাতেই নিরাপদ।

একটি কথা প্রায়ই শুনি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ না করলে বাংলাদেশেরও জন্মলাভ হতো না। কথাটি শুধু কথা কিংবা কয়েকটি শব্দের বাক্য নয়, এটি চিরন্তন সত্য উপলব্ধি। আর সেটা আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর রক্ত কণিকা থেকে।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় অনেকে তীর্য ভাষায় বলে থাকে, মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের সম্মান-শ্রদ্ধা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু তাঁদের সন্তান ও নাতিপুতিদের অবদান কী? রাষ্ট্র কেন তাদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে?

কথাটি একেবারেই অমুলক এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নয়। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর মুক্তিযোদ্ধাদের কী অবস্থা হয়েছিল? শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর নাম প্রকাশ্যে কয়জনে উচ্চারণ করতে পেরেছে? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিভাবে বিকৃত করে জাতির কাছে তুলে ধরা হয়েছিল?

মুক্তিযুদ্ধের সন্তানদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্র কেন নিশ্চিত করবে-এই প্রশ্নে উত্তর খুঁজে পাবেন বঙ্গবন্ধুর রক্তকণিকায় জন্ম নেওয়া শেখ হাসিনার কর্মকান্ড থেকে।

বাংলাদেশে নারী সরকার প্রধান খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার শাসনামল একটু পর্যবেক্ষন করুন। জিয়াউর রহমানের পরে খালেদা জিয়া পরিকল্পিতভাবে রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধীদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে শুধু প্রতিষ্ঠাই করেনি বরং ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষেরও বেশি সম্ভ্রবহানী নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অর্জিত লাল-সবুজের পতাকা যুদ্ধাপরাধীদের হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে পবিত্র সংসদকে অপবিত্র করেছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে পাকিস্তানী ভাবধারায় পরিচালিত করেছে। বাঙালি জাতিকে জিম্মি করার লক্ষে ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা, বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের নেতার নেতৃত্বহীন করতে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, পাঁচ-পাঁচবারের মতন দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র করার ষড়যন্ত্র করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ত্রিশ লক্ষ শহীদের সংখ্যা নিয়ে বির্তক সৃষ্টি করাসহ এমন কি নেই যে খালেদা জিয়া করেনি? পাকিস্তান যা চেয়েছে খালেদা জিয়া তাই করেছে। এমনকি, স্বামী জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচার তো দূরের কথা, বিচারের কথাও কখনো বলেনি!

আর অন্যদিকে শেখ হাসিনা- সকল প্রতিকূলতা, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে জাতির জনকের খুনীদের বিচার করা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অশুভ ছায়া-অভিশাপ রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের শুধু বিচারের ব্যবস্থাই করেনি, বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রায়ও কার্যকর করেছে এবং বিচারকাজ এখনো চলমান রেখেছে।

পাঠক! পাঁচবারের দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশকে আজ মর্যাদার বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে-একমাত্র শেখ হাসিনার সুদীর্ঘ পরিকল্পনা যার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের রক্ত-আদর্শ বিদ্যমান। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী প্রজন্ম শেখ হাসিনা ছিল বলেই এজাতি ফিরে পেয়েছে তার নিজেস্ব সত্ত্বা, নিজেস্ব ইতিহাস এবং মর্যাদার বাংলাদেশ।

আরেকটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আপনিও খুঁজে পাবেন, বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনার মাঝেও নেতা, নেতৃত্ব, মানুষ-মানবতা এবং স্বাধীন-সার্বভৌম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ নিয়ে হাজার বছরের চিন্তা-ভাবনা বিদ্যমান। বঙ্গবন্ধু যে চিন্তা-চেতনা থেকে কোটা প্রথায় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভূক্তি করেন ঠিক একই চিন্তা-চেতনা থেকে শেখ হাসিনাও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অন্তর্ভূক্ত করেন।
এখানে সন্তানদের ভূমিকা কী-এটা খুঁজতে গেলে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের সন্তানদের দৃশ্যমান কর্মকান্ড আপনাকে পর্যবেক্ষন করতে হবে। ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত রাজাকার কাদের মোল্লা থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী আবার আজীবন সাজাপ্রাপ্ত রাজাকার গোলাম আযম থেকে দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর সন্তানদের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র, ঔদ্বত্য প্রকাশ; আপনাকে স্পষ্ট ভূমিকা নির্ণয় করতে সহায়তা করবে।

তাহলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নাতিপুতি কেন অন্তর্ভূক্ত করলেন-এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে গেলেও আপনাকে দৃশ্যমান নাতিপুতির দিকে তাকাতে হবে। আপনার বাড়ির পাশে অনগ্রসর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিপতিকে নিয়ে একটু সময় অপচয় করে একান্তচিত্তে পর্যবেক্ষণ করলে আপনিও খুঁজে বের করতে পারবেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিপতিদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র কেন অঙ্গীকারবদ্ধ। এখানে মুক্তিযোদ্ধার পারিবারিক আর আদর্শগত শিক্ষা এবং সর্বপরি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ¯্রােতধারা ধরে রাখতেই সন্তানের পরে নাতিপুতিদের অন্তর্ভূক্তিকরণ; শেখ হাসিনার হাজার বছরের চিন্তা-ভাবনার মহাপরিকল্পনা।

পিতা-মাতার কাছে সন্তান কানা-লোলা কিংবা প্রতিবন্ধি হলেও সে প্রিয় সন্তান আবার ভাই-বোনের কাছে প্রতিবন্ধি হলেও সে সবার আগে প্রিয় ও মুল্যবান। ঠিক তেমনি মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-নাতিপুতির কাছে বাংলাদেশ সবার আগে প্রিয় ও যত্মবান। যা স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের বংশধরদের মাঝে খুঁজেও পাবেন না।

স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের দোসর মহল ১৯৯৭ সাল থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সন্তানদের অন্তর্ভূক্তি নিয়ে মাঠে-ঘাটে আন্দোলন করে আসছে। তখনও মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরোধীতা করেছে এবং তার ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান রেখেছে। তারা জেনে ও বুঝে-শুনে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যাচার ছড়িয়েছে যে, মুক্তিযোদ্ধা কোটার কারণে মেধাহীনরা এগিয়ে যাচ্ছে আর মেধাবীরা পিছিয়ে পড়েছে। সকল পরিক্ষায় পাস করার পর কোটার সুযোগ শুধু মৌখিক পরিক্ষার ক্ষেত্রে প্রদান করা হয়-এটাকে আড়াল করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে গুজব ছড়িয়েছে। কারণ, তারা জানে- কখনো রাজাকার সাঈদীকে চাঁদে দেখানোর কথা বলে এজাতিকে বিভ্রান্ত করা যায়। আবার হিন্দুর মেয়ে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির করা হবে বলেও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে আতঙ্কিত করা যায়। তাই একুশ বছরের বিকৃত ইতিহাসের বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করা সহজ হয়ে পড়ে এবং তারা তাই করে থাকে।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে যারা সংবিধানের দোহায় দিয়ে থাকে, কোটা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হয়েছে বলে যারাই বিভ্রান্ত ছড়াতে উঠে-পড়ে লেগে আছে; এই তাদের অনেকে আদর্শগত কারণে, কেউ ব্যক্তিস্বার্থের লোভে একুশ বছরের বিকৃতি ইতিহাসের বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠীকে ডাল হিসেবে ব্যবহার করার ষড়যন্ত্র করছে।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা কারো করুণার দান কিংবা ভিক্ষা নয়। এটা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাজার বছরের চিন্তাভাবনার ফসল। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তাদের নাতি-পুতিও শেখ হাসিনার হাজার বছরের চিন্তা-ভাবনার স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে রাষ্ট্রের উচিত হবে, কঠোর হাতে রাজাকার ও রাজাকারের বংশধরদের দমন করা এবং দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগসুবিধা হতে বঞ্চিত করা। আর শুধু এককভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটার মাধ্যমেই নয়, বিশেষ আইন করে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার বংশধরদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠাসহ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পৃষ্ঠপোষকতা করা।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)।