ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » ফিচার » বিস্তারিত

নোয়াখালীর দক্ষিণে জেগে উঠছে সম্ভাবনার নতুন বাংলাদেশ

২০১৮ অক্টোবর ২৫ ১৫:৩১:৫৯
নোয়াখালীর দক্ষিণে জেগে উঠছে সম্ভাবনার নতুন বাংলাদেশ

ইমাম উদ্দিন সুমন : নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার মেঘনা নদীর বুকে জেগে উঠা বাংলাদেশের মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি উপকূলীয় দ্বীপ হাতিয়া। ২১০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত এ দ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। চারদিকে অথৈ জলের রাশি আর উত্তাল তরঙ্গের মাঝে ভাসমান এ দ্বীপ এবং তার আশপাশে জেগে ওঠা ১৯টি চর নিয়ে হাতিয়া। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে জেগে ওঠা এ দ্বীপের উত্তর ও পশ্চিম পার্শ্বে প্রবাহিত মেঘনা নদী এবং পূর্ব ও দক্ষিণ পার্শ্বে বয়ে চলেছে বঙ্গোপসাগর। নদীর অব্যাহত ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়–জলোচ্ছাস ইত্যাদি প্রকৃতির বৈরীসুলভ আচরণে আজ ক্ষত-বিক্ষত হাতিয়ার জনজীবন। বর্তমানে ‘হাতিয়ার দুঃখ’ নদীর ভাঙন। ২২০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা থেকে হাতিয়া হারিয়েছে ১০০ বর্গ কিলোমিটার। হাতিয়া ভাঙছে, আবার গড়ে উঠছে নতুন নতুন চর। নিঝুমদ্বীপ হাতিয়ার অলঙ্কার। নিঝুমদ্বীপসহ জেগে উঠা চরাঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠতে পারে সম্ভাবনার আরেক নতুন বাংলাদেশ।

হাতিয়াকে ঘিরে বিশাল বিশাল আয়তনের চরগুলো জেগে উঠার বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে এবং নদী ও ভূ-বিশেষজ্ঞ দ্বারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাতিয়ার ভাঙনের মাত্রা কমানো গেলে নিকট ভবিষ্যতে গোটা বাংলাদেশের চেয়েও অনেক বিশাল এক ভূখন্ড সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। ১৫০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের নিঝুমদ্বীপের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে বন বিভাগের সুন্দরী, কেওড়া, গেওয়া, গোলপাতা, কেশড়ী ইত্যাদি বাগান । এখানে অনায়াসে গড়ে তোলা যায় সুন্দরবনের মত আরেক সবুজ প্রান্তর।
নৌ-পথই হাতিয়ার সাথে মূল ভূখন্ডের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। হাতিয়া হতে নোয়াখালী জেলা সদরে যাতায়াতের জন্য বিআইডব্লিউটিসি’র দু’টি সি-ট্রাক রয়েছে যাতে যাত্রীদের বসা দূরের কথা দাঁড়ানোরও জায়গা ও থাকে না। তাই বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে ট্রলারে নদী পারাপার হতে হয়। ফিটনেস বিহীন ট্রলারে যাতায়াত করতে যাত্রী সাধারণকে বিভিন্ন কৌশলে বাধ্য করা হয়। এ যাবত অনেকগুলো ট্রলার দুর্ঘটনায় ব্যাপক যানমালের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পরও উন্নত জলযানের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই এ পথে। জোয়ারভাটার উপর নির্ভরশীলতা হাতিয়ায় যাত্রীদের দুঃখ। ডুবোচরে সি-ট্রাক ট্রলার আটকে গিয়ে ভোগান্তি এখনও আগের মতই রয়ে গেছে।

অব্যাহত নদী ভাঙনে ভিটেমাটি ও সহায়সম্বল হারিয়ে হাতিয়ার দু’লাখেরও বেশি মানুষ উদ্ভাস্তুর মত মানবেতর জীবন যাপন করছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী হাতিয়ায় গড়ে প্রতি বছর ১২০০ থেকে ১৫০০ পরিবার সর্বস্ব হারাচ্ছে। ভূমিহীন এ মানুষগুলো বেড়ির পার্শ্বে খালের পাড়, খাস জমি, নিঝুমদ্বীপ, ঢালচর, মৌলভীরচর, বয়ারচর, নঙ্গলিয়া, নলেরচর, কেরিংচর, ভাসানচর ইত্যাদি এলাকায় মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ এবং মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। হাতিয়ার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারগুলো এক সময় ‘স্বপ্নের দ্বীপ’ ছেড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাড়ি জমাচ্ছে। ভাঙনই তার একমাত্র কারণ। হাতিয়া নৌ-ঘাটগুলোতে পল্টুন নেই। হাতিয়ার অভ্যন্তরীণ রাস্তা ঘাটের উন্নতি হলেও নৌ-পথে নিঝুমদ্বীপ, ঢালচর, মৌলভীর চর, রামগতি, নলেরচর, ভাসানচর ইত্যাদিতে ফিটনেসবিহীন নৌকা এবং ট্রলারই একমাত্র মাধ্যম। নিঝুম দ্বীপের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। হাতিয়ার সাথে দেশের সরকারি ডাক যোগাযোগ, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হলেও গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, এয়ারটেল টেলিকমন কোম্পানিগুলো টাওয়ার নির্মাণ করে হাতিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। এ দ্বীপে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত হলে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নতি আসবে। ছোটখাট শিল্পকারখানা স্থাপন করে বেকারত্বের হার কমানো যাবে।

হাতিয়া থেকে নিঝুম দ্বীপকে বিভক্তকারী ১২৫০ মিটার দূরত্বের অগভীর মুক্তারিয়া খালের ওপর একটি ক্রসড্যাম নির্মাণের দাবি হাতিয়াবাসীর দীর্ঘদিনের। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকল্পিতভাবে ক্রসড্যাম প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নিঝুম দ্বীপের পাশে ৩০ লাখ একর জুমি জেগে উঠবে। জাহাজমারা নিঝুম দ্বীপের মধ্যে ক্রসড্যাম নির্মাণের সম্ভাব্যতা নিরূপণকল্পে নেদারল্যান্ড সরকারের একটি বিশেষজ্ঞ দল স্থানীয় ভূমি পুনঃউদ্ধার বিভাগের সহায়তায় দুইবার হাতিয়া-জাহাজমারা নিঝুম দ্বীপের অবস্থান ও ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর উক্ত স্থানে ক্রসড্যাম নির্মাণ করা যেতে পারে বলে জরিপ দলের রিপোর্টে উল্লেখ করেন।
ভাসানচর রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য ইতোমধ্যে বেড়িবাঁধ, বাসস্থান , সাইক্লোন শেল্টার, মসজিদ, আভ্যন্তরীন সড়ক, লাইট হাউজসহ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৮০ ভাগ। তৈরী হচ্ছে ১৪৪০ টি টিনশেড পাকাঘর। প্রতিটি শেডে রয়েছে ১৮টি রুম। শেডের দুই পাশে আছে বাথরুম আর কিচেন। প্রতি ৪ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারকে দেয়া হবে ১ টি রুম। প্রতি রুমে থাকছে দোতলা বিশিষ্ট ২ টি বেড। মেঘনা নদীর বুকে জেগে উঠা এ চরকে ঝড়-জলোচ্ছাস থেকে নিরাপদ করার জন্য নির্মান করা হয়েছে ১৪ কি:মি: বেঁড়ি বাঁধ। ৪ তলা বিশিষ্ট ১২০ টি সাইক্লোন শেল্টার। মাটি থেকে ৪ ফিট উঁচুতে হচ্ছে বাসস্থান। চরটির দৈর্ঘ্য ১২ কি:মি: এবং প্রস্থ্য ১৪ কি:মি:। প্রাথমিকভাবে ১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করা হবে এখানে। বসবাসের উপযোগি করে গড়ে তোলা হচ্ছে বিশাল এ চরকে। এখানে নির্মান করা হচ্ছে থাকার ঘর, খেলার মাঠ, পুকুর, মসজিদ, হাসপাতাল, সড়ক, লাইট হাউজ, গার্ডেন, সাইক্লোন শেল্টার, সোলার সিস্টেম।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ হাতিয়ার ইতিহাসের এক গুরুত্বর্পূর্ণ অধ্যায়। দুর্যোগ হাতিয়াকে বিশ্ববাসীর নিকট সুপরিচিত করে তুলেছে। সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছাসের মতো দুর্যোগে অনেক বারই ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে হাতিয়া। দুর্যোগে মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রধান উৎসগুলো তাৎক্ষণিকভাবে থমকে দাঁড়ায়। জরুরী অবস্থায় বাইরের ত্রাণ সহায়তা ছাড়া বেঁচে থাকার বিকল্প অবলম্বন থাকে না। নানান রোগব্যাধির শিকার হয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে হয়ে পড়ে। হাতিয়ার উপকূল দেশের অন্যতম মৎস্যচারণ ক্ষেত্র। উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণরত ট্রলারগুলো যে পরিমাণ মৎস্য আহরণ করে তা গোটা দেশের আহরিত মৎস্যের ১৭ ভাগ। বঙ্গোপসাগরে যে পরিমাণ মৎস্যসম্পদ রয়েছে তা যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম তবে দেশের সমৃদ্ধির চেহারা অনেকদূর এগিয়ে যেতো। মৎস্য আহরণ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন করা গেলে দেশীয় চাহিদা পূরণ করার পরও ৩০ লাখ মেট্রিক টন মৎস্য রফতানি করা সম্ভব হতো। মৎস্য হ্যাচারী এবং বরফ কলের সমস্যার হাতিয়ার মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব অনেক কমিয়ে দিচ্ছে। সরকারিভাবে হাতিয়ায় একটি বরফকল প্রতিষ্ঠা করা অত্যান্ত জরুরী।

হাতিয়ার মাটি অত্যান্ত উর্বর যা কৃষিকাজের জন্য খুবই উপযোগী। হাতিয়ার কৃষি এবং কৃষকের সমস্যাগুলো হলো উন্নত বীজের অভাব; সার ও কীটনাশকের অভাব, পোকার আক্রমণ, কৃষি ঋণের সমস্যা, অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি, জোয়ার ও জলোচ্ছবাসে ফসলহানি, লবণাক্ততা ইত্যাদি। কৃষি এবং কৃষকের সমস্যাসমূহ দূর করা গেলে হাতিয়া সত্যিই সুজলা-সফলা শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠবে। ধর্মীয় দিক থেকে দ্বীপবাসী দুই ধারায় বিভক্ত মুসলমান এবং হিন্দু। সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আলাদা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ দ্বীপে গড়ে উঠেনি। হাতিয়ার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও শিক্ষার প্রতি অনুরাগী। দ্বীপের হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠীর চলমান জীবন ধারার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত মাদরাসা ও স্কুল শিক্ষার ধারাটি অব্যহত ।

বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, মাত্র ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ের মাধ্যমে নদী ভাঙন রোধসহ বিশাল ভূমি জেগে উঠলে এসব অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে। ক্রসড্যামের ফলে প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি নিঝুম দ্বীপে ব্যাপক হারে পর্যটক ভ্রমণ করতে পারবে যা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। আশা করছি, বাংলাদেশ সরকার দেশ ও জনগণের স্বার্থে সম্ভাবনার আরেক নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন ।

(আইইউএস/এসপি/অক্টোবর ২৫, ২০১৮)