ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » স্বাস্থ্য » বিস্তারিত

এক চিকিৎসক পাল্টে দিলেন হাসপাতাল

২০১৯ ফেব্রুয়ারি ০৫ ১১:৪৩:৫৬
এক চিকিৎসক পাল্টে দিলেন হাসপাতাল

স্বাস্থ্য ডেস্ক : ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, মেঝেতে পড়ে থাকা খাবারের উচ্ছিষ্ট। গাইনি ও শিশু ওয়ার্ডের সামনে মুখে রুমাল দিয়ে যাওয়া। রোগীদের শয্যায় বিড়ালের অবস্থান। এটাই ছিল হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের চিত্র। আয়া এবং এমএলএসএস থাকা স্বত্ত্বেও হাসপাতালের প্রতিটি টয়লেট ছিল ব্যবহারের অনুপযোগী। তবে বিশ্রী অবস্থার মধ্যেও এবার রোগী ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে দেখা দিয়েছে নতুন আশা।

দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের আচরণ ও ফাঁকিবাজি নিয়ে যখন জনক্ষোভ স্পষ্ট তখন জনবান্ধব একজন চিকিৎসক পাল্টে দিয়েছেন হবিগঞ্জ হাসপাতাল। নোংরা-অপরিচ্ছন্ন হাসপাতালটিকে তিনি ঝকঝকে তকতকে করে তুলেছেন। চিকিৎসকরা এখন সময়মতো আসছেন কর্মস্থলে, রোগীরা পাচ্ছেন সরকারি ওষুধ।

এই চিকিৎসকের নাম মিঠুন রায়। আবাসিক মেডিকেল অফিসার হিসেবে তিনি গত ১ জানুয়ারি এই হাসপাতালে বদলি হয়ে আসেন। তবে কাজে যোগ দেন ১৫ তারিখের দিকে। আর দুই সপ্তাহেই তিনি রোগীদের প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়েছেন।

হাসপাতালটিতে সময়মতো চিকিৎসকরা কর্মস্থলে না আসার অভিযোগ ছিল। তবে মিঠুন রায় বিলম্বে এলে সেদিনই রিপোর্ট করে দিচ্ছেন উচ্চ পর্যায়ে। ফলে এখন তারা আর ফাঁকি দিচ্ছেন না।

সরকারি ওষুধ নিয়ম অনুযায়ী বিতরণ না করার অভিযোগ থেকেও মুক্তি পেয়েছে হাসপাতালটি। যেসব ওষুধ আসে, চিকিৎসকরা রোগীদের সেগুলো না দিয়ে অন্য ওষুধের নাম লিখতেন বলে অভিযোগ ছিল।

তবে এখন বিভিন্ন ওয়ার্ডে সরকারের পক্ষ থেকে কী কী ওষুধ পাঠানো হয় তার তালিকা টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর একই গ্রুপে অন্য কোম্পানির কী কী ওষুধ আছে, সেটাও জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে রোগীরা বিনামূল্যে ওষুধ পাচ্ছেন আগের চেয়ে বেশি।

গত দুই বছরে যখম হয়ে হাসপাতালে এলে মেডিকেল সার্টিফিকেট দেওয়া প্রায় বন্ধ ছিল। তিন হাজার মেডিকেল রিপোর্টের আবেদন আটকে ছিল। ফলে মামলা করতে ভুক্তভোগীরা ঝামেলায় পড়েছিলেন। চিকিৎসক মিঠুন রায় দিনে বাধ্যতামূলক ১০০টি মেডিকেল সার্টিফিকেট লেখার বিধান চালু করেছেন। ফলে জমে থাকা আবেদনগুলোর এখন সুরাহা হচ্ছে।

আর হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতার যে কার্যক্রম চালানো হয়েছে সেটাকে অভিনব বলা যায়। শুক্রবার সকাল থেকে শনিবার বিকাল পর্যন্ত সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি হবিগঞ্জ পৌরসভা, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যোগ দেন পরিচ্ছন্নতা অভিযানে।

বিকালে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, অন্যান্য দিনের তুলনায় পরিষ্কার এবং ঝকঝকে অবস্থায়। রোগী ও তাদের স্বজনরা স্বাগত জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগকে।

বানিয়াচং থেকে আসা রোগীর স্বজন নাসিমা আক্তার জানান, তিনি ১৫ দিন ধরে তার মেয়েকে নিয়ে শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি। ময়লা-আবর্জনা এবং দুর্গন্ধের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তারা।

নাসিমার ধারণা, শিশু ওয়ার্ডটি অপরিষ্কার থাকার কারণে রোগীরা কম সময়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন না। শুক্রবার হাসপাতাল পরিষ্কার হওয়ার পর তিনি অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছেন।

আজমিরীগঞ্জের মিতু আক্তার জানান, প্রায় ১০ দিন থেকে তার নবজাতক শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। পাঁচ দিন হাসপাতালে থাকার পর ডায়রিয়া কমে গেলেও তার জ্বর কমছিল না। পরে অন্য এক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তাকে জানানো হয়- অপরিষ্কার পরিবেশে থাকার কারণে ছেলেটির আবার নিউমোনিয়া হয়েছে।

মিঠুন রায়ের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে মিতু বলেন, সব চিকিৎসক তার মতো হলে রোগীরা ভালো সেবা পেত।

চিকিৎসক মিঠুন রায় বলেন, ‘হাসপাতালের মতো জায়গা সব সময়ই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা উচিত। আগামী দিনগুলোতে আমরা সরকারি দায়িত্বের পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে একবার অতিরিক্ত কাজ করে হাসপাতালটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখব। প্রতি সপ্তাহে পৌরসভার পক্ষ থেকে হাসপাতালের আঙিনা থেকে ময়লা আবর্জনা সরানোর ব্যবস্থা করা হবে।’

আরও একটি বড় কাজ করেছেন মিঠুন রায়। হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নেওয়া দালালদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। দালালদের তালিকা তৈরি করে সিভিল সার্জন, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, পুলিশ সুপার এবং সদর মডেল থানায় পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় দালাল নির্মূলে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। তবে আর কোনো কাজ হয়নি। আটকে থাকা সেই কাজটি এগিয়ে নিতে তৎপর হন মিঠুন। ২৮ জনের নাম প্রকাশ করেন তিনি।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক রতীন্দ্র চন্দ্র দেব বলেন, ‘তালিকাটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রেরণ করা হচ্ছে। শিগগির এই হাসপাতাল দালালমুক্ত হবে।’

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, ‘তালিকাটা এখনো আমার হাতে এসে পৌঁছেনি। তালিকা পাওয়ার পর এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

(ওএস/অ/ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৯)