ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

জজ মিয়া যুগে যুগে..

২০১৯ মার্চ ০৪ ১৮:২২:৪২
জজ মিয়া যুগে যুগে..

চৌধুরী আবদুল হান্নান


স্কেপগোট (scape goat) কথাটি আমাদের অনেকের কাছেই পরিচিত। এর উৎপত্তির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রাচীন অতীতে কোনো এক সম্প্রদায়ের লোকজনের দুঃখ-দুর্দশা কিছুতেই কমছে না, বেড়েই চলেছে। সমাজের “বিজ্ঞলোকেরা” বিধান দিলেন পাপ মোচনের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের দেওয়া বিধানমতে এ উদ্দেশ্যে মরুভূমিতে একটি ছাগল বলি দেওয়া হলো। তাতে ওই জনগোষ্ঠির দুর্দশা লাঘব হয়েছিল কিনা বা লাঘব হয়ে থাকলে ছাগল বলি দেওয়ার কারণে কিনা, তা অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়নি।ঘটনা সত্য না, লোক কাহিনী, সেটা বড় কথা নয়, তবে বিষয়টি বড়ই মজার।

এভাবে বিভিন্ন দেশে, সমাজে “ছাগলেরা” একদিকে অন্ধবিশ্বাসের বলি হচ্ছে অথবা অন্যের দায় বহন করে চলেছে। আইনকে ফাঁকি দিয়ে বা হাত করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, সামাজিক পর্যায়ে ক্ষমতাবানেরা এ সুবিধা গ্রহণ করছে। একজন নির্দোষ ব্যক্তির ওপর যখন অন্য কারো অপরাধের দায় চাপানো হয়- এমন বুঝতে “স্কেপ গোট” কথাটি বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

জজ মিয়া কাহিনী দেশে বহুল আলোচিত। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলায় নোয়াখালীর জজ মিয়া নামে এক নিরীহ নির্দোষ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার এক অপচেষ্টা করা হয়েছিল যা “জজ মিয়া নাটক” নামে “টক অব দি কান্ট্রিতে” পরিনত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে থাকা ফিলিপাইনের বিরোধী রাজনৈতিক নেতা বেনিগনো এ্যাকুইনো দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় সরকারি তত্ত্বাবধানে মেনিলা বিমানবন্দরে যখন অবতরণ করেন, সামরিক নিরাপত্তা বেস্টনি থাকা অবস্থায় আততায়ীর গুলিতে ১৯৮৩ সালের ২১ আগস্ট তিনি নিহত হন এবং তাৎক্ষনিকভাবে নিরাপত্তা রক্ষীরা রোনাল্ডো গালম্যান নামে অন্য একজনকে গুলি করে হত্যা করে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী পথের কাঁটা দূর করতে রোনাল্ডো গালম্যানকে “স্কেপ গোটিং” করে ফিলিপাইনের তৎকালীন স্বৈর শাসক ফার্দিনান্দ মার্কোস তার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে চেয়েছিলেন মর্মে বিশ্বব্যাপী অভিযোগ উঠেছিল। পরবর্তীতে আদালত নিহত গালম্যানের ওয়ারিশদের বাইশ হাজার তিনশত ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিয়েছিল।

ভিন্ন মতালম্বী সাহসী সাংবাদিক, সৌদি সরকারের কঠোর সমালোচক জামাল খাশোগিকে তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর হত্যা করা হয়। এ হত্যাকান্ড সৌদি সরকারের রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ড ছিল তা বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট, তবে একজন “জজ মিয়ার” ওপর এর দায় চাপানোর অপচেষ্টা মিডিয়ার সজাগ দৃষ্টির কারণে আজও সফল হয়নি।

একজনের অপরাধ অন্যের ওপর চাপানো, আইনের ফাঁকে বা ক্ষমতা ও অর্থের দ্বারা আইনকে হাত করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার ঘটনাগুলো মর্মান্তিক, মানব সভ্যতার কলংক। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “আমাদের আইনগুলো মাকড়শার জালের মত, এর দ্বারা গরীব ও দুর্বলদের ধরে রাখা যায়, কিন্তু ধনী আর শক্তিমানেরা সহসাই তা ভেঙে বেরিয়ে যায়।”- যা আজও কত প্রাসঙ্গিক।

অষ্টাদশ শতাব্দির একজন ফরাসি দার্শনিক বলেছিলেন, “আইনের ছায়ার তলায় এবং বিচারের আবরণে যে অত্যাচার সাধিত হয়, তার চেয়ে নিষ্ঠুর অত্যাচার আর নেই”।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের এক বাসিন্দা বিনা দোষে ৩৯ বছর জেল খাটার পর যখন জানাজানি হলো, তখন তাকে দুই কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল।

বিনা অপরাধে জেল খাটা আমাদের ফজলু, জাহালামরা কি কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন? ওাষ্ট্র তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করলে, আইনের শাসনের পথে আমরা এগিয়ে যাব। আমাদের দেশে মাঝে মাঝে মিডিয়ার বদৌলতে বিচারহীনতার খন্ডচিত্র পাওয়া যায়, তাতে বুঝা যায় প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। বিনা দোষে শাস্তি ভোগ, অন্যের অপরাধ ঘাড়ে নিয়ে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার ঘটনা কম নয়।

বর্তমান সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। সুশাসনের জন্য গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। আইন যদি ক্ষমতা আর অর্থের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, আইন যদি তার নিজস্ব গতিপথে না চলতে পারে তা হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, সুশাসন তো দূরের কথা।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।