ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » ঘুরে এলাম » বিস্তারিত

বালি ভ্রমণ : পর্ব-৩

মন্দির দর্শনের পথে কফি ফার্মে কফির স্বাদ 

২০১৯ মার্চ ০৭ ১৫:৪৬:৪৯
মন্দির দর্শনের পথে কফি ফার্মে কফির স্বাদ 

মুহাম্মদ সেলিম হক : পাঠকের কাছে আবারো হাজির হলাম। ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের তৃতীয় পর্ব নিয়ে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। ডাচ উপনিবেশের কারণে তাদের দেয়া ইন্দোনেশিয়া নামটি ওই অঞ্চলের জন্য প্রচলিত হয়। ১৯০০ সাল থেকে জায়গাটি ইন্দোনেশিয়া নামে পরিচিতি পায়। প্রায় হাজার হাজার দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত এই দেশটি পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। এর রাজধানীর নাম জাকার্তা।

দেশটিতে মানুষ বসতির ইতিহাস বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো। যাদের বলা হয় জাভাম্যান। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে তাইওয়ান থেকে একটি মানব প্রবাহের ধারা ইন্দোনেশিয়া যায় খ্রিষ্ট জন্মের দুই হাজার বছর আগে।

প্রথম শতাব্দীতে সভ্যতার বিস্তার ঘটে। কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামীণ সমাজ গঠিত হয়। গড়ে ওঠে অসংখ্য শহর-নগর-বন্দর। সমুদ্র উপকূলে বিস্তার ঘটে ব্যবসা-বাণিজ্য। চীনের সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে ইন্দোনেশিয়া হয়ে। এর ফলে দেশটিতে এক দিক থেকে হিন্দু ধর্ম অন্য দিক থেকে আসে বৌদ্ধ ধর্ম। দু’টি ধর্ম জীবন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে।

তবে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলিমদের আগমন ঘটে। উত্তর সুমাত্রা হয়ে ক্রমে মুসলমানরা ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার মাইলের বিস্তৃত ইন্দোনেশিয়ায়। ষোড়শ শতাব্দীতে দেশটির প্রধান ধর্ম হয়ে যায় ইসলাম। ব্রিটিশ আর ডাচরা তাদের সাম্রাজ্য স্থাপন করলেও ধর্ম ও সংস্কৃতিতে তাঁরা কোনো প্রভাব রাখতে পারেনি।
গল্পে আসি এবার। আমার কেন জানি মনে হল ইন্দোনেশিয়া পুরা দেশটা ঘুরতে ৩০ বছর লাগবে! তাও আবার এক জায়গায় একদিন করে বেড়ালে। আয়তনে পৃথিবীর পাচঁটি বড় দেশের বড় তালিকায় নেই এ দেশটি। তবুও এতো বছর লাগবে। এটা আমার কথা নয়, বিখ্যাত ভৌগলিক বিজ্ঞানীদের। কারণ হিসেবে এরা যুক্তি দাঁড় করালো ইন্দোনেশিয়ায় দ্বীপ রয়েছে সাড়ে ১৭ হাজার মতো। এর মধ্যে মানুষের বসবাস করা হয় মাত্র ৫৬৬০টির মতো। বাকি গুলোতে এখনো মানুষের পায়ের চিহ্ন পড়েনি। কি আশ্চর্য্য রুপ তার একেক’টি দ্বীপের।

বালি দ্বীপে বেড়াতে গেলে আপনাকে কমপক্ষে ১৫/২০ দিনের মতো সময় হাতে নিতে হবে। তাহলে পুরাপুরি না হলেও নব্বই ভাগ জায়গায় বেড়ানো যাবে। বালির তৃতীয় দিনে আমরা একেবারে সময় নিয়ে বের হলাম। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া করলাম। ভাড়া নিলো ৬ লাখ রুপিয়া। ড্রাইবার আমাদের গাইডবুক দিলো দর্শনীয় স্থান গুলো দেখার জন্য।

অনেক দর্শনীয় স্পট। যার মধ্যে উবুদ রাইস টেরেস, বাটারফ্লাই পার্ক, তেগেনুঙ্গন ওয়াটার ফল, লুয়াক কফি ফার্ম, মানকি ফরেস্ট, এলিফ্যান্ট কেভ, পুরাউলুন দানুবাটর মন্দির, উলুয়াতু, মাউন্ড বাতুর, তানাহলট মন্দির, কিন্তমানি, বিচের মধ্যে নুসা পেনিদা, নুসাদোয়া, ড্রিমল্যান্ড বিচ, পাদাম পাদাম বিচ, সেমিনিয়াক বিচ, ডাবলংরী বিচ, লেগিন বিচ ও প্যানিডা বিচ।

একটার সাথে আরেকটার দুরত্ব ২০/৩০ কিলোমিটারের মধ্যে। ড্রাইবার জানালো তিনি চারটি স্পট দেখাবেন। যেগুলো দেখতে নাকি সারাদিন যাবে। প্রথমে রওয়ানা দিলাম তানাহলট মন্দির। বালিতে আসার আগে পড়ে। বইতে মন্দিরটার ছবি দেখে আমার যাওয়ার আগ্রহটা বেশি ছিল। সাগরের বুকে এ টেম্পল। কুটা বিচ থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে এই টেম্পল। পৌঁছতে ঘন্টাখানিকের মতো সময় লাগলো।

শহরের বাইরে গ্রামে যাওয়ার পথে নয়নাভিরাম ধানের চাষ। সুবজের পর সবুজের সমারোহ চোখ ফেরানো যায় না। প্রকৃতির পরতে পরতে নিখুঁত সাঁজানো বৃক্ষগুলি দাঁড়িয়ে আপনাকে স্বাগতম জানাবে। মন্দিরে প্রবেশ করতেই বিশাল একটি শিব মূর্তিও চোখে পড়বে। জানিয়ে দিবে মন্দির এর ঐতিহ্যের রূপকথার গল্পের অগ্রিম বার্তা।

আপনাকে ৬৫ হাজার রুপিয়া খরচ করে টিকেট নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হবে। তাদের টাকার মান কম বলে এই অবস্থা। প্রবেশের পথে শপিং করার বিপুল ভান্ডার। এখানে মিলবে বালির ঐতিহ্যবাহী পেন্টিং করা আর কাঠের কারুকার্যে মোড়ানো বহু জিনিসপত্র। দামের হাকঁডাক দেখে কেনার সাহস হলো না। তবে তানাহলট মন্দিরের মূল জায়গায় গিয়ে চোখে বিস্ময়কর অনূভূতি জাগলো। সাগরের ঢেউ আচড়ে পড়ছে মন্দিরে। দেখে মনে হচ্ছে এ বুঝি ডুবে যাচ্ছে সব কিন্তু না..।

ইতিহাস তলিয়ে জানা গেলে প্রায় ২ হাজার বছর পূর্বে তৈরী করা এ মন্দির। হিন্দুদের শিব, কৃষ্ণ আর মহিষুর তিন দেবতা এখানে অবস্থান ছিলো। দেবতাদের সন্তুষ্টির জন্য পূঁজারি আসে দূর দূরান্ত থেকে। মন্দিরে প্রবেশ কেবল তাঁরাই করতে পারে। আমার সফর সঙ্গী সমীর বাবুর দেবতার মিল থাকলেও প্রবেশ করতে পারেনি।

কেবল মন্দির দর্শনে এখানে শেষ নয়। আশপাশের পরিবেশ ও অসাধারণ। পাহাড়ের সাথে সমুদ্র দর্শনে এক মনোমুগ্ধকর সকাল মুখরিত হয় ট্যুরিস্টদের পদচারণায়। বালিতে বেড়াতে গেলে এ মন্দিরটা না দেখলে আপনার সফরের ষোল আনা বৃথা যাবে মনে হয়। ফেরার পথে ড্রাইবার জানালো কফি ফার্ম আছে। টিকেট লাগবে না। কিভাবে কফি তৈরি হয় অগার্নিকভাবে দেখা যাবে। বিনামূল্যে বলায় লোভ-সামলাতে পারলাম না।

কফি ফার্ম এ গেলে আপনার দেখা হবে, কিভবে মসলা আর ফলমূল থেকে তৈরি করা হয় কপি। মারিয়া নামে এক তরুণী আমাদের হাতে-কলমে দেখালো। তারপর আপনাকে নেওয়া হবে বাশঁ আর নারকেল পাতার তৈরি ঘরে। বিভিন্ন স্বাদের ২০টি কফির পেয়ালা দেয়া হবে।

টাকা যেহেতু দিতে হয়নি সব পেয়ালাতে ঠোঁট লাগাতে তবে সুযোগ ও হাতছাড়া করিনি। তবে মারিয়া শেষে জানালো। একটি কফি মাত্র আপনাকে রুপিয়ার বিনিময় খেতে হবে এটা বাধ্যতামুলক। কৌশলটা ভালো মনে হল, রুটি পরাটা সব ফ্রি কিন্তু ডিমের দাম ৩৫ টাকা আর কি! দুই ধরনের কফি আপনাকে অফার দেওয়া হবে। একটি বালি কফি আর একটি লুয়াক কফি। দাম পড়বে ৫০ হাজার রুপিয়া। বাকিটা পাঠকে ভালো বুঝবেন।

তারপর আপনাকে স্বাগতম জানানো হবে এদের বিক্রয় কেন্দ্রে। এখন রয়েছে বিভিন্ন ফ্লেভারের কফির প্যাকেট। চাইলে কিনতে পারবেন। ইন্দোনেশিয়া কফির জন্য সুখ্যাতি রয়েছে। দাম তেমন বেশি নয়। তবে কেনাটা বাধ্যতামুলক নয়। কম টাকায় অনেক পর্যটকেরা কিনে থাকেন।

সকাল গড়িয়ে দুপুর বেলা আমরা রওয়ানা হলাম ‘পাদাম-পাদাম’ বিচের দিকে। ঘন্টা খানিকের পথ মাড়িয়ে পৌঁছলাম এ বিচে। একটু ভ্যাবসা গরম ছিল। সাগরে সাঁতার কাটার আগ্রহের মাত্রা বেড়ে গেল। প্রবেশ জন্য টিকেট গুনতে হবে ২০ হাজার রুপিয়া।

বন জঙ্গলের সত্যিকার বাদর আপনাকে স্বাগতম জানাবে। তবে এদের বিরক্ত করলে খেসারত দিতে হবে। কেড়ে নিতে পারে আপনার চশমা আর টুঁপি। বিনিময়ে দিতে হবে বাদাম। তাহলে মিলবে আপনার হারানো জিনিস। বেশ মজার তো....

‘পাদাম পাদাম’ বিচ একেবারে ছোট। ৫০০ ফুট দীর্ঘ এ বিচ ছোট ছোট পাহাড় আর নীল পানি। সাথে লাল বালির সংমিশ্রণে যেন জীবন্ত একটা ছবি। প্রকৃতি বলেই সব সম্ভব। আগের কুটা বিচের ময়লার বিপরীত এটা। মন না চাইলেও সাগরের নীল পানির লোভে আপনাকে সাগরে নামতে বাধ্য করবে।

এখানে অস্ট্রেলিয়ার ট্যুরিস্টের আধিপত্য অনেক বেশি মনে হয়েছে। আগের কুটা বিচের ময়লা দেখে মন খারাপ হলেও ‘পাদাম পাদাম’ বিচে সমীর বাবু দেখে শিহরিত হয়ে ওঠেন। ঘন্টা খানিক সাগরে সাঁতার কেটে আগে ২০ হাজার রুপিয়া অনেকটা উসুল করে নিলাম। যদিও আমাদের দেশের কক্সবাজার বিচে গোসল করতে টাকা লাগেনা।

লবণাক্ত শরীরের ভরাট গন্ধ দিয়ে রওয়ানা দিলাম। উলুয়াটু মন্দিরের দিকে। পাশাপাশি হওয়ায় ২০ মিনিটে পৌঁছলাম আমরা। মন্দিরের সামনে ট্যুরিস্টদের দীর্ঘলাইন। ৩০ হাজার রুপিয়া দিয়ে উলুয়াতু মন্দিরের ভিতরে যেতে হবে। সাথে মন্দিরের ঐতিহ্যর একটা বেগুনী রুমাল। কোমরে এটা পড়তে হবে। একেক দেশের একেক নিয়ম। ওদের পবিত্র মন্দিরে প্রবেশ করতে গেলে পয়সা। সত্যিই সেক্সপিয়র বলেছিলেন, পৃথিবী একটি নাট্যশালা।

উলুয়াতু মন্দির পাহাড়ের চূড়ায়। সাগর থেকে এর উচ্চতা ১ হাজার ফুট উপর। বাংলাদেশের বান্দরবনের চেয়ে বেশি নয়। নিচে সাগরের ঢেউ আচড়ে পাহাড়’কে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে। সাদা ফেনার আবরণে নীল পানির মিতালী। মনে হল গভীর সম্পর্কটা যুগের পর যুগ।

শত শত ট্যুরিস্ট এখানে ভিড় জমায় সানসেট দেখার জন্য। দেশের কুয়াকাটায় অথচ সুর্য ডুবতে ও উঠতে দুটিই দেখা সম্ভব। কিন্তু আমাদের বিচ গুলো সংরক্ষিত ও সৌন্দর্যময়তা বৃদ্ধি করতে কতৃপক্ষের নজর কম। প্রকৃতির দান হিসেবে গড গিফটেট যেমন পেলাম তেমনি ব্যবহার করছি। ইন্দোনেশিয়ার সূর্যাস্ত দৃশ্যে যেন প্রকৃতির নীরব বিদায়। মন্দির এর কারুকার্য আছে। তবে নেই কোন দেবতার মূর্তি। এতেই সমীর বাবু হতাশ।

দেখতে দেখতে সবুজের পাহাড় আর সাগরের নীল জলের ঢেউ খেলার অবিরাম পথ চলা শেষ। তবুও মনে হলো আরো কিছু দেখার বাকি। পরের দিনের ভাবনায় সন্ধ্যায় পৌঁছলাম কুটা বিচের ইডেন হোটেলে। গাড়িতে চলতে চলতে ড্রাইবার গুষ্ঠি জানালো অনেক জানা অজানা বালির কথা। এ যেন আরব্য উপন্যাস শুনছি। গাড়ি চলছে আর ওনি বলছেন..আমরা শুনছি। শেষ হবে কিনা জানিনা।

চলবে....

লেখক :সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সংগঠক কর্ণফুলী, চট্টগ্রাম।