ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

ডাকসু নির্বাচন ও একটি রাজনৈতিক সমীক্ষা

২০১৯ মার্চ ২৩ ১৬:৪৩:১০
ডাকসু নির্বাচন ও একটি রাজনৈতিক সমীক্ষা

কবীর চৌধুরী তন্ময়


ছাত্ররাজনীতি বা ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সবারই ভিপি হওয়ার আশা-স্বপ্ন থাকে। কিন্তু এই ভিপি পদে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন কী কারণে নুরুল হক নুরুর চেয়ে ১ হাজার ৯৩৩ ভোট কম পেয়েছে-এটি নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে গবেষণা করার চেষ্টা করেছি। ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল-এমন অনেক সাবেক ও বর্তমান ছাত্র নেতার সাথে কথা বলেছি। আবার ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন ছাত্র নেতাদের সাথেও কথা বলেছি, কথা বলেছি সাধারণ শিক্ষার্থীর সাথেও। জানার চেষ্টা করেছি, বুঝার চেষ্টা করেছি কারণ, ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন ডাকসু নির্বাচনে ১৫ হাজার ৩০১টি ভোট পেয়ে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।

তাহলে ডাকসু নির্বাচনে ব্যক্তির জনপ্রিয়তা দেখে ভোট দিয়েছে ? নাকি এখানে অন্য কিছু কাজ করেছে-এটি খোঁজার জন্য আমাকে আরও কিছু গ্রহণযোগ্য নেতাকর্মীর ভিতরে ঢুকতে হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে আমার নিজেস্ব কিছু প্রিয় সংবাদকর্মীর সাথে একান্তভাবে আলোচনা করেও বিস্তারিত বুঝার চেষ্টা করেছি।

জানা যায়, ভিপি পদে ছাত্রলীগের প্রার্থীর পরাজয়ের পেছনে রয়েছে সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, গ্রুপিং-লবিং। যা সাবেক ও বর্তমান অনেক ছাত্রলীগ নেতাই শোভনের পক্ষে তেমনটা কাজ না করে উল্টো পর্দার আড়ালে ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেছে। আবার অনেকে মনে করছে, বর্তমান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হচ্ছে উত্তরবঙ্গের। আর নেতৃত্ব হাতছাড়া হওয়ায় দক্ষিণবঙ্গের কতিপয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুধু মানসিক দূরত্বই সৃষ্টি হয়নি, সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতির অঙ্গনেও। ছাত্রলীগের জন্য সবাই অন্তঃপ্রাণ বলা হলেও মুলত ভেতরে ভেতরে আঞ্চলিকতার কারণে গ্রুপিং-লবিংয়ের কারণে নির্বাচনে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।

আঞ্চলিকতার অভিযোগটি আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে জিটিভি ও সারা বাংলার প্রধান সম্পাদ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে। তিঁনি ফেসবুকে লিখেন, ‘আমাদের সময়ে দু’দুটি ডাকসু নির্বাচন, ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি দেখার অভিজ্ঞতায় জানি-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বরিশাল গ্রুপের কোন নির্দিষ্ট দল নাই’।

অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে এ নিয়ে কথা বললে একজন তার মোবাইল থেকে নব-নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুরুর একটি ভিডিও দেখিয়ে বলেন, কুয়েত মৈত্রী হলে ‘জাল ভোটের ব্যালট পেপার’ উদ্ধার হওয়ার গুজব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মনে ছাত্রলীগ সম্পর্কে তাৎক্ষনিকভাবে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করেছে। শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ায় এবং কতিপয় অনলাইন মিডিয়া যাচাই না করে এই গুজবের তথ্য প্রকাশ করায় এটি ভোটারকে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করেছে।

ভিডিওতে নুরুল হক নুরু নিজে ঘুরতে ঘুরতে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখিয়ে ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, নুরুল হক নুর ক্যাম্পাসে প্রহৃত হয়েছেন-অমন অপপ্রচার-গুজবও শিক্ষার্থীদের মাঝে নুরুর প্রতি ‘সিমপ্যাথি’ জন্ম হয়েছে যা লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকে নুরুকে ভোটদানে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, কোটা সংস্কার আন্দোলনে যেভাবে গুজব ছড়ানো হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবি সিদ্দিককে হত্যা করা হয়েছে মর্মে যেসকল গুজব-মিথ্যাচারের প্রচার ঘটিয়েছে; এখান থেকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কি কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেছে? এই ধরণের গুজব যে ডাকসু নির্বাচনেও করবে না-এটা নিয়েও কি ছাত্রলীগের কোনো প্রস্তুতি ছিল? আবার আঞ্চলিকতার চেয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি দায়িত্ববান হওয়া নিয়ে ডাকসুকে ঘিরে আঞ্চলিক ওইসব নেতাদের নিয়ে আলোচনা, আহ্বান, আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল?

আমাকে কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি- ডাকসুকে ঘিরে ছাত্রলীগের কোনো মনিটরিং টিম ছিল কিনা। গুজবের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তাৎক্ষনিকভাবে সত্য-তথ্য উপাত্ত তুলে ধরার ব্যবস্থা গ্রহণে কী কী পদক্ষেপ ছাত্রলীগ নিয়েছে-এটিও স্পষ্ট করে কেউ জানাতে পারেনি।

ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতা যাঁরা সরাসরি ডাকসুর নির্বাচনে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে, নীতিনির্ধারণী ফোরামে ছিল এবং ডাকসুর নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করেছে তাঁদের সবার একটা কথা ভালো করেই জেনে রাখার দরকার ছিল-গুজব, অপপ্রচার, মিথ্যাচার বর্তমানে এক শ্রেণি মানুষের কাছে বিভ্রান্ত করার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কোটা সংস্কার আন্দোলন আর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে গুজব-অপপ্রচার, মিথ্যাচারকে একটা সময় সত্য তথ্য-উপাত্ত দিয়ে মোকাবেলা করতে পারলেও তাৎক্ষনিকভাবে একটা শ্রেণি বিভ্রান্ত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের অফিসে কথিত ছাত্রীকে ধর্ষণ, হত্যা করে লেকের পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে-এমন মিথ্যাচারে তাৎক্ষনিক বিভ্রান্ত হয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আওয়ামী লীগের অফিসে ঢুকে বিস্তারিত দেখতে বাধ্য করেছিল এই ‘অপপ্রচার’ বা ‘গুজব’।

অর্থাৎ তাৎক্ষনিকভাবে বিভ্রান্ত হলেও ‘গুজব’ ‘একটা সিদ্ধান্ত’ গ্রহণে বাধ্য করে। আর এই বিভ্রান্ত হয়ে তাৎক্ষনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ‘ক’-এর জায়গায় ‘খ’-কে ভোট প্রদান করলে তা আর সংশোধন করার কোনো সুযোগ থাকে না যা ডাকসুর নির্বাচনের অনেক ক্ষেত্রেই তাই হয়েছে। গুজব আর নুরুল হক নুরুর ঘুরে পড়ে যাওয়ার নাটক ছাত্রলীগের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ধরনের রাগ-ক্ষোভ আর ঘৃণার জন্ম দিয়েছে।

ডাকসুর নব-নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুরুকে এখন অনেকেই ছাত্রলীগের কর্মী বানানোর চেষ্টা করছে। আবার স্যোশাল মিডিয়াতে সেই প্রমাণপত্রও ভাইরাল করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি এবং সেই কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে নুরুদের পুরো টিমের আদর্শগত এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেষ্টা করেছি। এবং ২০১৮ সালের ২৯ এপ্রিল জনকন্ঠে ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন॥ টার্গেট কারা?’-শিরোনামে প্রকাশিত লেখায় আমি বিস্তারিত তুলে ধরারও চেষ্টা করেছি।

আমার জানা মতে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাসে সোহাগ-নাজমুলের হাত দিয়ে সৃষ্টি আরেক সোহাগ-জাকির ছাত্রলীগের কমিটি এতোটাই কলঙ্কিত, এতোটাই সিন্ডিকেট নির্ভও হয়ে উটেছিল; যা উপলব্দি করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এই ছাত্রলীগকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছাত্রলীগে ফিরিয়ে নিতে দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছিলেন।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়, ২০১৬ সালে ২১ মে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অফিসিয়াল প্যাডে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন স্বাক্ষরিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদনকৃত স্বাক্ষরে দেখা যায় সহ-সভাপতি মো. রুম্মান হোসাইনসহ আরো কয়েকজন নেতার নামের পাশে ব্র্যাকেট করা ‘ব ব হল’ এবং ফারুক হোসেন তালুকদারের পাশে ব্র্যাকেট করা ‘জিয়া হল’ উল্লেখ করেছে। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আমি এটির প্রতিবাদ করে জানিয়েছিলাম, এটি লজ্জার বিষয়। বঙ্গবন্ধু’র নামের জায়গায় ‘ব ব’ লিখলেও তারা কিন্তু জিয়ার নামের ক্ষেত্রে কেউ ভুল করেনি (!) যা অনেক গণমাধ্যম ওই স্ট্যাটাস নিয়ে আমার অনুমতিক্রমে ‘বঙ্গবন্ধু লিখতে ছাত্রলীগের ‘চরম অনীহা’’-শিরোনামে তখন এটি তুলে ধরেছে।

বির্তক একটি নয়, সোহাগ-জাকির কমিটি কেন্দ্রীয় থেকে আরম্ভ করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, জামায়াত ঘরোনার লোকদের ছাত্রলীগের পদপদবী দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলকের ভাগ্নে, জামায়াতে ইসলামীর পৌর আমিরের ছেলে খালিদ হাসানকে নাটোরের সিংড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত করেছে স্বয়ং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন মঞ্চে উপস্থিত থেকে! বিভিন্ন গণমাধ্যম তখন এই সংবাদকে হেডলাউন বা প্রধান সংবাদ হিসেবে তুলে ধরেছে। ‘নাটোরে জামায়াত আমিরের ছেলে ছাত্রলীগের উপজেলা সভাপতি’-এই শিরোনামে গুগলে সার্চ দিলে এখনো সেই সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তখন কী কারণে এই ধরণের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে? এখানে তদবীর-লবিং ছিল কতটা? নাকি সিনিয়র কোনো নেতার প্রচন্ড চাপ তারা উপেক্ষা করতে পারেনি-এটা সোহাগ-জাকির ভালো বলতে পারবেন।

কিন্তু আমার প্রশ্ন, ছাত্রলীগের কমিটিতে নাম লেখালেই কি তাদের জন্মগত আদর্শ আর রাজনৈতিক দর্শন রাতারাতি পরিবর্তন হবে? বা হওয়া সম্ভব? ইতিহাস কী বলে...?

ডাকসুর ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না শুরুতেই করেছে ছাত্রসংঘের রাজনীতি যা স্বাধীনতার পরে ছাত্রশিবির হয়। পরে ছাত্রলীগ থেকে জাসদ, বাসদ, জনতা মুক্তি পার্টি হয়ে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও হয়েছেন। কিন্তু তিনি কত দিন আওয়ামী লীগের চিন্তা আর রাজনৈতিক দর্শন লালন করেছেন? কতদিন তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা নিয়ে রাজনীতি করতে পেরেছেন-এটা সকলের জানা।
মাহমুদুর রহমান মান্না আওয়ামী লীগ থেকে বিতারিত হয়ে আবারও নিজেস্ব চিন্তা-চেতনা আর ছাত্রসংঘের রাজনৈতিক দর্শনে ফিরে যান। পুরনো রাজনীতির দর্শনে সরাসরি নিজের নাম না লেখালেও তিনি সেই খোলস বা লালন করা আদর্শ থেকে বের হতে পারেননি, বের হননি-এটি তার সকল আলোচনায় প্রতীয়মাণ।

এই তো সেদিনের কথা, পুরো বিশ্ব থেকে আরম্ভ করে শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তান যখন বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে প্রসংশা করছে তখন জাতীয় প্রেস ক্লাবের তখনকার সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মুহম্মদ শফিকুর রহমানের সাথে টকশোতে বসে এই মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলাদেশকে তিরস্কার করে পাকিস্তানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল!

ডাকসুর নব-নির্বাচিত নুরুল হক নুরু কখনোই বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগের আদর্শ ধারণ করেনি, ধারণ করে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় এই নুরু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগত আক্রমন করে কথা বলেছে। ভিন্ন মত আর বাক স্বাধীনতার নামে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কটুক্তি করেছে নুরুর সহযোদ্ধারা। ‘আমি রাজাকার’ বলে তখনই নিজেদের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরেছে।

আমরা জানি, ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালেই এই কোটা ব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারিত করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করেন। নতুন করে যোগ করেন এক শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা। আর তখন এর প্রতিবাদ করেন জামায়াত-শিবির যার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল নুরুল হক নুরুরা।

আর কোটা সংয়স্কার আন্দোলনে তখনকার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ (সোহাগ-জাকির) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কী ভূমিকা ছিল-এটিও আওয়ামী লীগসহ সাবেক ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী ভালো করেই অবগত আছে বলে আমার বিশ্বাস।

ডাকসুর নব-নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুরু ১২ মার্চ বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘ছাত্রলীগ একটা গুজবের সংগঠন। তারা সব সময় শুধু গুজব ছড়ায়’! নুরু ছাত্রলীগ করলে বা ছাত্রলীগের আদর্শ ধারণ করলে নিশ্চয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে জানা থাকতো, পড়াশোনা থাকতো।

কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, এই নুরু গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে উপস্থিত বক্তব্যে বলেন, একটা সময় সেও ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন। শুধু তাই নয়, যে শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটুক্তি করেছিলেন, সেই শেখ হাসিনার মাঝে নুরু তার মায়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাচ্ছে!
নব-নির্বাচিত নুরুর ছাত্রলীগ করার এই দাবিকে আমি দেখছি একটু অন্যভাবে। এই ধরুন, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাও দাবি করতে পারেন তিনিও আওয়ামীলীগার, অনেক বড় আওয়ামীলীগার। কারণ, একটা সময় তিনিও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। আবার অন্যদিকে বর্তমান সরকারের প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের ভাগ্নে খালিদ হাসানও দাবি করতে পারে, সেও বড় ছাত্রলীগার, অনেক বড় ছাত্রলীগার। কারণ, ছাত্রসংঘ পরবর্তীতে ছাত্রশিবিরের রাজনীতি থেকে উঠে আসা মাহমুদুর রহমান মান্না সাহেবও বিভিন্ন পথঘাট ঘুরে একটা সময় আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। আবার প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলকের ভাগ্নে, জামায়াতে ইসলামীর পৌর আমিরের ছেলে খালিদ হাসানকে নাটোরের সিংড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে।

ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না যেমন তার কথায়, বক্তব্যে, কর্মকান্ডে বার বার ছাত্রসংঘের রাজনীতির আদর্শ ধারণ করার প্রমাণ রেখেছে, তেমনি নব-নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুরুও তার সকল বক্তব্যে ও কর্মকান্ডে প্রমাণ করেছে, সে আদৌ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও ছাত্রলীগের মুল চেতনা ধারণ করেনি।

আমাদের বুঝতে হবে, ব্যক্তিগত স্বার্থ আর ক্ষনিকের প্রাপ্তির আশায় শুধু সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদি গোষ্ঠীকেই নয়; একজন বিতর্কিত অক্ষম মানুষকেও সক্ষম করে গড়ে তুললে, বিশ্বাস করলে একটা সময় নিজের জায়গাটাই ছেড়ে দিবে বাধ্য হতে হয়। আর সেথান থেকেই উত্থান হয় মোস্তাকদের আর পতন ঘটে জাতীয় চার নেতার।

নানা আলোচনা-সমালোচনা মধ্য দিয়ে ডাকসু নির্বাচন-২০১৯ সম্পন্ন হয়েছে। এখান থেকে সকল ছাত্রছাত্রী ও ছাত্ররাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছাত্রনেতাদের শিক্ষা নেওয়ার পটভূমি তৈরি হয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থ, আঞ্চলিকতা, গ্রুপিং-লবিং, রাগ-ক্ষোভ-অভিমানের চেয়েও দলীয় স্বার্থ, সংগঠনের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাওয়া হচ্ছে- ছাত্রনেতারা নিশ্চয় এটি বিচার-বিশ্লেষণ করবে এবং সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ২৮ বছর পর নতুন করে ভাবতে, সময় উপযোগি সিদ্ধান্ত নিতে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও ঢেলে সাঁজতে সাহায্য পাবে বলে মনে করছি।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)।