ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » সম্পাদকীয় » বিস্তারিত

আমাকে এতো ভয় কিসের?

২০১৯ এপ্রিল ০৪ ১১:১৬:১৭
আমাকে এতো ভয় কিসের?

প্রবীর সিকদার


আমার ফেসবুক আইডিকে [ Probir Sikdar ] এতো ভয় কিসের, একের পর এক রিপোর্ট করে করে সেই আইডিটাকেই বন্ধ করতে হল! আমার নামে ফেসবুকে ভুয়া আইডি রয়েছে! আমি ও আমার ফেসবুক বন্ধুরা ওই ভুয়া আইডির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছি; কিন্তু ফেসবুক কতৃপক্ষ সেই আইডি বন্ধ করেনি; আজ সেই ভুয়া আইডির লোকেরা আমার ফেসবুক আইডির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করলো, আর আমার আইডি বন্ধ করে দেওয়া হল! বড় বিচিত্র সব নিয়মের বেড়াজাল!

আমি প্রবীর সিকদার, মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছি বাবা কাকা দাদুসহ অনেক স্বজন। সেই সাথে হয়েছি উদ্বাস্তু। মুক্তিযুদ্ধে সব হারানো এক শিশু হিসেবে অনেক লড়াই করেই আমাকে বড় হতে হয়েছে। সেই লড়াই যেন আর থেমে থাকার নয়! শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছি। শিক্ষকতাকে ভিন্নমাত্রা যোগ করতে আমার গ্রাম ফরিদপুরের কানাইপুরে এই উপমহাদেশের নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার নামে প্রতিষ্ঠা করেছি মেয়েদের বিদ্যালয় ‘বেগম রোকেয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’। সেখানে গড়েছি মানসম্পন্ন আরও দুটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এরই এক ফাঁকে জড়িয়ে পড়েছি সাংবাদিকতায়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও রাজাকারের বিরুদ্ধে লেখালেখি করায় ২০০১ সালে আমার ওপর নৃশংস হামলা হয়েছে। বাঁচার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না আমার! তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দৈনিক জনকণ্ঠের সহমর্মিতা ও সহযোগিতায় দেশে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা হয়েছে আমার। এই দেশের লাখ লাখ মানুষ আমার পক্ষ নিয়েছেন, আমার জন্য দোয়া করেছেন। সেই যাত্রায় আমি জীবন ফেরত পেলেও আমাকে হারাতে হয়েছে একটি পা, হারাতে হয়েছে একটি হাতের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা। আমি ভেবে বিস্মিত হই, এক পা ও দেড় হাতের এই প্রবীর সিকদারকে এতো ভয়!

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নানামুখী নিরাপত্তাহীনতায় আমাকে আমার প্রিয় শহর ফরিদপুর ছাড়তে হয়েছে। ছাত্রজীবনে যে ঢাকাকে আমি এক সেকেন্ডের জন্যও ভালবাসতে পারিনি, সেই ঢাকাই হয়ে যায় আমার আশ্রয়দাতা! মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে বিভিন্ন জেলা উপজেলায় গিয়ে তরুণদের সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছি, কথা বলছি। ঢাকায় বড় বড় দৈনিক পত্রিকায় কাজ করেছি, কিন্তু কোথাও স্বস্তি পাইনি। এক পর্যায়ে চূড়ান্ত ঝুঁকি নিয়ে নিজেই উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও দৈনিক বাংলা ৭১ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছি। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ত্রৈমাসিক উত্তরাধিকার ৭১-ও প্রকাশ করেছি। এই কাজে আমার স্বস্তি আছে, কিন্তু পেটে ভাত নেই। তবু থাকি স্বস্তিতেই!

পেটে ভাত না থাকা আমার এই স্বস্তিও যে অনেকের অস্বস্তির কারণ, সেটাও বড় যন্ত্রণা নিয়েই আমি উপলব্ধি করছি। কিন্তু কিছুই করার নেই! জীবনের এতো পথ মাড়িয়ে এসে তো আর নতুন কোনও পথে চলতে পারবো না। আর যেহেতু চলতে পারি না কিংবা পারবো না, সেই ক্ষেত্রে তো আমাকে কঠিন মাশুল দিতেই হয়! আমার লেখালেখির কারণে ২০১৫সালে সাবেক এক মন্ত্রীর রোষানলে পড়তে হয়েছে আমাকে! আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে ৫৭ধারায় মামলা। সেই মামলায় আমাকে সইতে হয়েছে পুলিশি নির্যাতন, ঢুকতে হয়েছে জেলে! কিন্তু দেশ বিদেশের লাখ লাখ শুভাকাঙ্ক্ষী আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন, দৃঢ় উচ্চারণে আমার মুক্তি দাবি করেছেন। মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তড়িৎ হস্তক্ষেপে আমাকে দুই রাতের বেশি কারাগারে থাকতে হয়নি; আমি জামিনে মুক্তি পেয়েছি। এতো কিছুর পরও আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা ৫৭ধারার মামলা চলছেই। প্রভাবশালীদের লম্বা হাত অন্ধকারে ঢুকে যায় বহুদূর; জানি না ওই মামলায় আমার কপালে কী লেখা হচ্ছে! তবু আমি এই দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষেই ছিলাম, আছি, থাকবো।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন সুখি সুন্দর বাংলাদেশ তথা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য; এই দেশটির জন্যই একাত্তরে ৩০লাখ মানুষ জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। সেই দেশটি কারো কারো লুটপাটের কারখানা হতে পারে না। যাদের হাতে কয়েকবছর আগেও একখানি ট্রেড লাইসেন্স ছিল না, তারা এখন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। সরকারি চাকুরে, তারও আছে দেশে বিদেশে বাড়ি,গাড়িসহ হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ-সম্পদ! কোনও অর্থ বিনিয়োগ না করেই সরকারি টেণ্ডার কাজ নিয়ন্ত্রণ করে কেউ কেউ হয়ে যাচ্ছেন হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ-সম্পদের মালিক! কেউ কেউ ভোট ছাড়া ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন! আমার অপরাধ, আমি ওই লুটেরাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করি, কথা বলি। গণমাধ্যম যেখানে ব্যর্থ, সেখানে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক ও অনলাইনে লেখালেখির মাধ্যমেই আমি দেশের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার থাকার চেষ্টা করি মাত্র; এর বেশি তো আমার ক্ষমতা ও দৌড় নেইও! সেটাও যদি বন্ধ করতে হয়, তাহলে আর বেঁচে থেকে লাভ কী! কেড়ে নিন আমার জীবনটাও!

আমি এটা মনে করছি না যে, লুটেরা দুর্বৃত্তরা আমার ফেসবুক আইডি বন্ধ করেই ক্ষান্ত হয়ে যাবে! আমি আশঙ্কা করছি, আমার জীবন কেড়ে নিতে নিয়োগ করা হতে পারে আততায়ী! সেটা ব্যর্থ হলে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা হতে পারে নতুন মামলা, নেমে আসতে পারে পুলিশি ও কারা নির্যাতন! আমি সব কিছু মোকাবেলা করতেই প্রস্তুত। আমার ভরসা শুধুই দেশের সাধারণ মানুষ; আমি তাদের ভালবাসা নিয়েই মরতে চাই।

আমার ফেসবুক আইডি [ Probir Sikdar ] বন্ধ করে কিংবা বন্ধ করিয়ে যারা স্বস্তির ঢেঁকুর তুলছেন, তাদেরকে বলছি, আমার কলম বন্ধ করা গেলেও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে থামানো যাবে না। সময় হলে অবশ্যই জেগে উঠবে ৩০লাখ মানুষের জীবন দিয়ে গড়া মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, এবং সেই জাগরণ হবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই। সেদিন ওই লুটেরা-দুর্বৃত্তরা পালানোর পথ পাবেন না।