ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

মরে নয়, পড়ে বুঝুন

২০১৯ মে ১৬ ১৮:১২:৩৯
মরে নয়, পড়ে বুঝুন

কবীর চৌধুরী তন্ময়


‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নাম দিয়ে কিছুদিন আগে ‘সন্দেহভাজন জঙ্গি সদস্য শনাক্তকরণের (রেডিক্যাল ইন্ডিকেটর) নিয়ামকসমুহ’-শিরোনামে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন আকারে একটা লিফলেট জনগণের মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। ওই লিফলেটে ‘হঠাৎ করে দাড়ি রাখা এবং টাখনুর উপর কাপড় পরিধান শুরু করা’-এটি লেখার কারণে কতিপয় মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে এতোটাই নাকি আঘাত লেগেছে, যার প্রতিবাদে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারে নেমে পড়েছে এক শ্রেণির মানুষ। স্যোশাল মিডিয়াতে নোংরামী ছেয়ে গেছে। কতিপয় অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়াও সেই খবর প্রকাশ করেছে।

খুব ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, কেউ পড়ে বোঝে। আবার অনেকে মরে বোঝে। তবে, গুজবের অপসংস্কৃতিতে কতিপয় মানুষ মরেই যেন বোঝার চেষ্টা করে। মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডিত দেলোওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়া থেকে আরম্ভ করে সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও গুজবের রাজনীতি বা অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজ সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তৃতীয় বিশ্বের আধুনিক এই সময়ে আমাদের এক শ্রেণির মানুষের ধ্যান-জ্ঞান আর শিক্ষা-দীক্ষার গভীরতা স্পষ্ট হয়েছে।

কিন্তু, আমি পড়েই বুঝতে চাই। আমার পাঠক বন্ধুও ভাবিয়া চিন্তিয়া করিবে কাজ, করিয়া নিশ্চয়ই ভাবতে যাবে না। আর আত্মসম্মানবোধ নষ্ট করে অর্থাৎ মরিয়া বোঝার অর্থ নিশ্চয়ই এই লেখার পাঠক অনুধাবন করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

ওই লিফলেটে ‘জধফরপধষ রহফরপধঃড়ৎ’ বা ‘মৌলবাদী সুচক’-এ বুঝিয়েছে, কোনো ব্যক্তির জীবন-যাপনের মধ্যে ‘হঠাৎ’ করে পরিবর্তন শুরু হওয়ার লক্ষণগুলো সন্দেহের তালিকায় রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর এই সন্দেহের তালিকা যে শুধু বাংলাদেশের জন্য তা কিন্তু নয়। জঙ্গিবাদ যেহেতু আজ বিশ্বের জন্য হুমকি তাই, আন্তর্জাতিকভাবে মৌলবাদী সুচকগুলো ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী পর্যায় এভাবেই নির্ণয় করে থাকে। অন্য রাষ্ট্রে শুধু ব্যক্তির আদর্শ, উদ্দেশ্য ও বিশ্বাসগুলো নিয়ে শ্রেণিবিন্যাস হতে পারে।

অনেকে সমালোচনা করতে গিয়ে প্রশ্ন করেছে, জঙ্গিবাদ তো শুধু মুসলমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাহলে এখানে ‘দাড়ি রাখা’ আর ‘টাখনুর উপর কাপড়’-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে কেন?

আমি যতটুকু জানি, ১৯৯৯ সালে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি’র বাংলাভাইদের পরিচালিত দেশের ৬৪টি জেলায় সিরিজ বোমা হামলা, ২০১৬ সালের পহেলা জুলাই ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান হামলাসহ ছোটবড় সব হামলার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল এদেশের ছোট ছোট ইসলামী দল ও গ্রুপ। আর সর্বশেষ ২৯ এপ্রিল ঢাকার গুলিস্তানের ডন প্লাজার সামনের রাস্তায় দায়িত্ব পালনরত পুলিশ সদস্যদের ওপর ককটেল ছুঁড়ে আহত করার ঘটনা এবং হাফেজ মাওলানা কামরুজ্জামান নামক এক ব্যক্তি নিজেকে জেএমবি’র কর্মী পরিচয় দিয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদ ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনে বোমা হামলার হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠানোর বিষয়গুলো ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীর তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। আর এই তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই যাচাই-বাচাই আর গবেষণা করে ওই লিফলেটে ‘শনাক্তকরণ’ কী কী-এটি জনসচেতনতার জন্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

আর এই লিফলেট শুধু বাংলাদেশের সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের প্রেক্ষপট নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। যদিও গণমাধ্যমে পাঠানো ওই লিফলেটে ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ লেখা থাকলেও এটি আহ্বায়ক পীযূষ বন্ধ্যোপাধ্যায়ের ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামক সামাজিক সংগঠনের নয়-এটি ১৬ মে ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ এর আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় আর সদস্য সচিব ডা. মামুন আল মাহতাব ‘সংবাদ সম্মেলন’ করে পরিস্কার করেছেন।

তবে, যারাই ওই লিফলেট গণমাধ্যমে প্রকাশ করে বিস্তারিত তুলে ধরেছে তাদের ধন্যবাদ জানানো উচিত। তাদের উদ্দেশ্য সম্প্রীতি বজায় রাখতে সবার সচেতনতা সৃষ্টি করা। আর ‘শনাক্তকরণ’ করতে ওই লাইনের আগে ‘হঠাৎ’ লেখার পরেও কেন যে এক শ্রেণির মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে এতোটা হালকা করে দেখে বা উগ্রপন্থী আকার ধারণ করে-এটি অবাক করার বিষয়। কেন যে তারা শুধু পড়েই চলে যায়, একটু বোঝার চেষ্টা করে না, বিচার বিশ্লেষণ করে না-এটি নিয়েও মানুষ হিসেবে আমি বিব্রতবোধ করি।

গবার মনে থাকার কথা যে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা তার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ধরে রাখতে না পেরে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে পলাশ আহমেদ নিহত হয়েছে। সেও ওই বিমানে উঠার ২০/২৫ দিন আগে বাসার রুমে একা একা সময় কাটাত। হঠাৎ করেই পলাশ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করেছিল। সেও ধর্মের বাণী দিয়ে পরিবারের বাবা-মাসহ সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার জঙ্গি সম্পৃক্ততা খুঁজে না পেলেও পলাশ কিন্তু বড় ধরনের অপ্রীতিকর সন্ত্রাসী ঘটনার জন্ম দিয়েছে।

দেখুন, এটা পলাশের নিত্য দিনের জীবন যাপন ছিলো না। ‘হঠাৎ’ করেই এমনটা হয়েছে। যার শেষ পরিনতি তার মৃত্যুর বার্তার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন হয়েছে।

মুলত কোনো ব্যক্তির জীবন যাপনে ‘হঠাৎ’ পরিবর্তন যেমন, আগে দাড়ি রাখতো না, এখন রাখে। আগে টাখনুর উপর কাপড় পরিধান করতো না, এখন হঠাৎ করে পড়া শুরু করেছে-এগুলোকে লক্ষণ হিসেবে মৌলবাদী সূচকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।

আত্মঘাতী বোমা নিক্ষেপ ছাড়াও মানুষ মৌলবাদী চিন্তাধারার হতে পারে। আর সেটা যে শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন গোত্র বা বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যেও মৌলবাদী চিন্তা কাজ করে। রাজনৈতিক মৌলবাদ, ধর্মীয় মৌলবাদ, জাতিগোষ্ঠীর মাঝে মৌলবাদের ধ্যান ধারণা লক্ষ্য করা যায়। আবার যেকোনো ব্যক্তিও তার মৌলবাদী চিন্তা শক্তি দ্বারা পরিচালিত হতে পারে। আর তখন ব্যক্তি পর্যায় থেকে গ্রুপ আর গ্রুপ থেকে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে একটা সময় নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে যেকোনো অঘটন ঘটাতে তাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকে।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবে-এই ধরনের কোনও বক্তব্য পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় কখনো দেয়নি। আর ‘দাড়ি’, ‘টাখনুর উপরে কাপড় পরিধান’ নিয়ে কোথাও কোনো আক্রমাত্মক বক্তব্য করেনি। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি। যেহেতু আমার সাথে তার একটা ভালো সম্পর্ক আছে এবং আমি ব্যক্তিগতভাবেও তাকে যতটুকু জানি, তাই কোনো রকমের সন্দেহ ছাড়াই বলতে পারি। আর পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন মুক্তিযোদ্ধা। এদেশের জন্য সেই ১৯৭১ সাল অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিল আর আজ যুদ্ধ করে যাচ্ছে ধর্মীয় মুল্যবোধ, মানবিক সম্প্রীতি, উদার গণতান্ত্রিক স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য। তথাকথিত অভিযোগে যিনি অপরাধী নয়, তার বিরুদ্ধে সমালোচনা করা, ব্যক্তিগত আক্রমন করে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করা কোনো সভ্য মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় বলেই আমি বিশ্বাস করি।

মনে রাখা উচিত, সাদা পোশাকেও পানির দাগ লাগে। তাই না জেনে, না বুঝে অপরকে ব্যক্তিগত আক্রম করে নিজেকে পানির দাগের মতন প্রশ্নবিদ্ধ করা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারেন। কোনো সচেতন ব্যক্তি আদর্শ হতে পারে না।

বরং লিফলেট গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন আকাড়ে তুলে ধরেছে যাতে আমাদের পরিবার পরিজনের মধ্যে এমন কিছুর লক্ষণ দেখা দিলে সেটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার আগেই বোঝাতে সক্ষম হই। ভালোবাসা দিয়ে তাকে সত্যের পথে পরিচালিত করতে পারি।

অনেকেই কেন জানি ‘হঠাৎ’ শব্দটি এড়িয়ে গেল, নাকি চোখেই পড়েনি-এটা আমার কাছে পরিস্কার নয়। আর এই একটি লাইনের জন্য পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়রে ব্যক্তিগত চরিত্র উন্মোচনে যারা নেমেছেন-এই তাদের জন্য আমার করুণা হয়। আর সে সাথে ব্যক্তি পর্যায়ের মৌলবাদী চিন্তা শক্তি দ্বারা আমরা অনেকেই পরিচালিত হয়ে আসছি কিনা-এটিও দেখার বিষয় হয়ে পড়েছে।

একটা কথা মনে রাখা দরকার, প্রকৃতির একটা রিটার্ন আছে। ইতিবাচক বা নেতিবাচক-এটার ফলাফল সময়ে সময়ে বহন করতে হয়।

আমাদের দেশে ওয়াজ মাহফিলগুলোতে কতিপয় আলেম ওলামা যেভাবে নারী, নবী ও ইসলাম নিয়ে বক্তব্য প্রদান করে, যেভাবে হিন্দুদের জড়িয়ে উগ্রতা ছড়াতে চেষ্টা করে-এগুলো মনোযোগ দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করলে আপনিও বুঝে যাবেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কাকে বলে। কীভাবে মানুষের বিপক্ষে মানুষকে শত্রুপক্ষ হিসেবে তুলে ধরছে। মানবতার সম্প্রীতি নষ্ট করতে কীভাবে উদ্বুদ্ধ করছে।

আমাদের পড়েই বুঝতে হবে। নিজের আত্মসম্মানবোধ নিজেকেই রক্ষা করতে হবে। একটা মানুষকে ব্যক্তিগত আক্রম করার আগে একটু বুঝার চেষ্টা করা বুদ্ধিমানের কাজ। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি নির্মূল করার উদ্যোগে সবার আগে আমাদের সচেতন হতে হবে। মানুষ আর মানবতাবোধ নিশ্চিত করতে মানুষের মাঝে ঘৃণা নয়; সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে হবে। আর সেদিকেই আমরা এগিয়ে যাবো-এটাই সকলের প্রত্যাশা।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)।