ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » ফিচার » বিস্তারিত

‘নাউ দৌঁড়ই হামার ঈদ’

২০১৯ জুন ০২ ১৭:৫৯:৪২
‘নাউ দৌঁড়ই হামার ঈদ’

মানিক সরকার মানিক, রংপুর : বহতা নদীর মতই ওদের জীবন। ঠিকানাহীন চলছে তো চলছেই। কুল নেই কিনারা নেই। শিক্ষা স্বাস্থ্য বিনোদন নেই। নেই কোন স্বপ্ন স্বাধও। এমনকি ঈদ-পুজো উৎসবের কোন আমেজও ওদের স্পর্শ করে না। আর তাইতো ঈদ নিয়ে কোন উৎসাহ আগ্রহ নেই ওদের। আছে শুধু অন্ধকারময় অজানা এক ভবিষ্যত। ওরা চরবাসী। অশিক্ষা, কুসংস্কার বাল্যবিয়ে আর অন্ধকারময় ভবিষ্যত নিয়েই তিস্তাপারের চরবাসী এই শিশুরা বেড়ে উঠছে বংশ পরম্পরায়।

ঈদ উৎসব কী তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই কারোরই। মাথা ব্যথা শুধু ‘ঈদের এখান নয়া পিরাণ গাত দিয়া’ (ঈদের একটা নতুন জামা গায়ে দিয়ে) ঈদের ‘নাউ দৌড়’ (নৌকা বাইচ) নিয়ে। ঈদের দিন কি কর, কেমন কাটে বলতেই ৭ বছরের চরের শিশু আলিম জানায় ‘ঈদের দিন বিয়ানোইত (সকালে) ঘুম থাকি উঠি নমাজখান (নামাজ) পড়ি এ্যানা সোমাই খ্যায়ায় যাই নদীর ঘাটোত্। অঁটেকার নাউ দৌঁড়-ই (নৌকা বাইচ) হামার ঈদ’। আর ৯ বছরের জাহিদুলের মতে, ‘হামরা কী আর টাউনের মানুষ, যে হামার এত্তি ঈদ হইবে, নাউ খেলাই হামার ঈদ, হামরা ইয়াতে খুশি’। চরের এসব শিশুদের ঈদের আনন্দটা যেন এমনই।

রবিবার রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার টেপামধুপুর ইউনিয়নের তিস্তা নদীতীরবর্তী প্রত্যন্ত এলাকা চর হয়বত খাঁ, চর গনাই, চর আজম খাঁ, উচ্ছচর গ্রামে গেলেই দেখা মেলে তাদের। বেরিয়ে আসে তাদের জীবন চিত্রের করুণ কাহিনী। এলাকার সমাজকর্মী হানিফ উদ্দিন জানালেন, তিস্তার লাগাতার ভাঙ্গনে এই শিশুদের পরিবারগুলো এখন যাযাবর এ পরিণত হয়েছে। আজ এ চর তো কাল সে চরে। নিজেদের স্থায়ীত্ব না থাকায় অন্ধকারময় এক ভবিষ্যত নিয়েই বেড়ে উঠছে এরা। কাউনিয়া উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দুরে টেপামধুপুর গ্রাম। সেখান থেকে আরও অন্তত ৮ কিলোমিটার দুরের তিস্তার প্রত্যন্ত এই চর এলাকায় ২’শ পরিবারের প্রায় ২ হাজার মানুষের বসবাস। এদের অর্ধেকেই শিশু।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এসব চরাঞ্চল পরিবারের মানুষেরা এখনও পরিবার পরিকল্পনার ধার ধারে না। যে কারণে অনেক পরিবারেই রয়েছে ৪ থেকে ৫ সন্তান। এসব সন্তানদের অধিকাংশই স্কুলে যায় না। পরিবারের কর্তারা প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে জেগেই কাজের জন্য বেরিয়ে পড়েন উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন এলাকায়। গৃহিণীদের কেউবা ব্যস্ত হন নিজেদের গৃহস্থালীর কাজ কিংবা অন্যের বাসায় ঝিয়ের কাজে। আর শিশুরা থাকে খেলায় মত্ত।

দারিদ্রতা, অশিক্ষা, অজ্ঞতা, শিশু শ্রম বাল্যবিয়েই যেন তাদের নিত্য সাথী। অসচেতনা আর অব্যবস্থাপনার মধ্যেই বেড়ে উঠছে এই শিশুরা। এদের কেউই প্রাইমারীর গন্ডি পেরোইনি। তার আগেই মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে কারো। ছেলেরা জড়িয়ে পড়ছে শিশুশ্রম কিংবা নানা কাজের সঙ্গে। পুরো এলাকায় নেই কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র। আছে চর গনাই হয়বত খা স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা নামের একটি মাত্র মাদ্রাসা। ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা কাগজে কলমে প্রায় ২০০ হলেও বাস্তবে ১০ জনও উপস্থিত হয় না বলেই জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক। গোটা চর এলাকাজুড়ে একটি মাত্র মাদ্রাসায় রয়েছে একটি মাত্র টিউবওয়েল। সেই পানিই এই বিপুল সংখ্যক মানুষের একমাত্র ভরসা।

আলিমের দিনজজুর বাবা আব্দুস সামাদ বললেন, একদিন বাড়ি ভিটা সবই ছিল তার। এখন নিঃস্ব। নিজেই চলতে পারেন না ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাবেন কি দিয়ে আর ঈদের চাহিদাই পুরণ করবে কি করে। এভাবে চলতে চলতে শিশুরাও এখন সয়ে গেছে। গনাই মৌজা প্র্য়া সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছে তিস্তায়।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সফিকুল ইসলাম জানালেন, চরবাসী এসব মানুষের অভাবই মুলত শিশুদের স্কুলে না যাওয়ার কারণ। তিনি জানান, ইতোমধ্যে একটি স্কুল নদীতে গেছে। মাদ্রাসাটিও যেকোন মুহূর্তে চলে যাবে। তাই ঈদ পুঁজার আনন্দও এদের স্পর্শ করে না। যেন বহতা এই নদীর মতই এদের জীবন।

(এম/এসপি/জুন ০২, ২০১৯)