ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » জাতীয় » বিস্তারিত

আরও বড় বাজেট আসছে বৃহস্পতিবার

২০১৯ জুন ১১ ২২:০৪:৪৬
আরও বড় বাজেট আসছে বৃহস্পতিবার

স্টাফ রিপোর্টার: ‘সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশ, সময় এখন আমাদের’ শিরোনামে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যা চলতি অর্থছরের বাজেটের আকারের চেয়ে ৫৮ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা বা ১৩ শতাংশ বেশি।

আগামী বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের এ বাজেট উপস্থাপন করবেন তিনি।

নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার দিনই রাজস্ব আদায়ে ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ হওয়ার নির্দেশ দিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার কাছে আগামী (২০১৯-২০) অর্থবছরের জন্য ৩ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব চেয়েছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। তার ছয় মাসের মাথায় আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নকালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আয় ৩ লাখ কোটি টাকা ধরে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারেননি অর্থমন্ত্রী।

৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে গিয়ে এনবিআরের কাছে আরও ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব চেয়েছেন তিনি। যদিও চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পেছনে পড়ে আছে সংস্থাটি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব আয়ে এনবিআর প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। আগামী বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ ও সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি।

নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের ৫৮ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, রাজস্ব আদায় করতে না পারা ও উন্নয়ন প্রকল্পে পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থ খরচ করতে না পারায় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয় ৪ লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেটের আকার চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকারের চেয়ে ৮০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ ও সংশোধিত বাজেটের আকারের চেয়ে ১৮ দশমিক ২২ শতাংশ বড় বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী।

বড় ব্যয়ের বাজেট করতে গিয়ে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা ঘাটতি রাখছেন তিনি, যা ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের পাশাপাশি বিদেশি ঋণ ও অনুদান নিয়ে মেটানোর পরিকল্পনা তার।

বড় আকারের বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আদায়ের ওপর জোর দেয়ার কথা বরবরই বলে আসছেন অর্থমন্ত্রী। ১০ হাজার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে নিয়োগ দিয়ে ছয় মাসে নতুন ৮৫ লাখ করদাতা খুঁজে বের করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।

এ ছাড়া আলোচিত মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে বাজেট ঘোষণার দিন থেকেই। তাতে নতুন করে বাড়তি ভ্যাট ও শুল্ককর আদায়ের আশা করছেন তিনি। যদিও এই ভ্যাট আইন নিয়ে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মধ্যে পণ্যমূল্য বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে দেশের সব বন্দরে স্ক্যানার মেশিন বসানো হবে। এর ফলে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক আদায় বাড়ার পাশাপাশি আমদানি-রফতানির আড়ালে অর্থপাচার রোধ হবে বলে মনে করছেন অর্থমন্ত্রী।

এসব লক্ষ্য সামনে রেখেই নতুন অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরকে তিন লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হচ্ছে।

চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এনবিআরকে দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়। অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সংস্থাটি রাজস্ব আয় করে এক লাখ ৫৩ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে রাজস্ব ঘাটতি রয়েছে ৫০ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আর কোনো আশা না থাকায় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য কমিয়ে দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৪৫ হাজার ৬০০ টাকা বাড়তি লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে এনবিআরকে।

মোট আয় :
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছর মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এটি ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি ও সংশোধিত বাজেটে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এনবিআরের ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এনবিআরবহির্ভূত কর ব্যবস্থা থেকে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এ ছাড়া, সরকারের বিভিন্ন সেবার ফি, হাসপাতালের টিকিট মূল্য, সেতুর টোলসহ বিভিন্ন খাত থেকে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা আদায় করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

অভ্যন্তরীণ আয়ের বাইরে আগামী অর্থবছর বিদেশ থেকে ৪ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা অনুদান পাওয়ার আশা করছে সরকার। অনুদান যেহেতু ফেরত দিতে হয় না, তাই এ পরিমাণ অর্থ পাওয়া গেলে মোট আয় দাঁড়াবে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর ৪ হাজার ৫১ কোটি টাকা অনুদানের আশা করলেও বাজেট সংশোধনকালে তা কমিয়ে ৩ হাজার ৭৮৭ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়।

ব্যয়ের খাত :
৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার মধ্যে নতুন অর্থবছরের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ১০ হাজার ২৬২ কোটি টাকা, যা আগে অনুন্নয়ন ব্যয় হিসেবে উল্লেখ করা হতো। এর মধ্য থেকে সরকারের আবর্তক ব্যয় ২ কোটি ৭৭ লাখ ৯৩৪ কোটির মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে ৫২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা ও বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ৪ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এ ছাড়া, সরকারের মূলধন খাতে ৩২ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

নতুন অর্থবছরে উন্নয়নখাতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। সেখান থেকে ইতোমধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাবদ ২ লাখ দুই হাজার ৭২১ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব অনুমোদন করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল (এনইসি)। এ ছাড়া, এডিপিবহির্ভূত বিশেষ প্রকল্প, স্কিম ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে বাকি অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাব করবেন অর্থমন্ত্রী। সাধারণত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে সরকার। এ খাতে নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা।

ঘাটতি অর্থায়ন
অনুদান না পেলে নতুন বাজেটের ঘাটতি দাঁড়াবে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের ৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে, কোনো দেশের বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে থাকলে তা ঝূঁকিপূর্ণ নয়। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকার ঘাটতি ধরা হয়েছিল, যা ছিল জিডিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। রাজস্ব আয় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জন না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি বাড়িয়ে ১ লাখ ২৫ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা ধরা হয়, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। তবে বিদেশি অনুদান পাওয়া গেলে নতুন অর্থবছর ঘাটতি দাঁড়াবে ১ লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

এই ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে ৭৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সেখান থেকে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় করা হবে ১১ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, নতুন অর্থবছর নিট বৈদেশিক ঋণ নেয়া হবে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। বাকি ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেয়া হবে, যার মধ্যে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংক খাত থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছর ব্যাংকখাত থেকে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।

এ ছাড়া ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে নিট ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হবে, যার মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি ও অন্যান্য খাত থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য থাকলেও উচ্চ সুদহারের কারণে মানুষ এ খাতে বেশি বিনিয়োগ করেছে। ফলে সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়।

জিডিপির আকার
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে জিডিপির আকার প্রাক্কলন করা হয়েছিল ২৫ লাখ ৩৭ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই অর্থবছরজুড়ে দেশে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হবে, তার আর্থিক মূল্য হবে এটি। সংশোধিত বাজেটে জিডিপির আকার কমিয়ে ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ১৭৭ কোটিতে নামানো হয়। নতুন অর্থবছরের জন্য আকার প্রাক্কলন করা হচ্ছে ২৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা।

(ওএস/পিএস/১১ জুন, ২০১৯)