ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

পণ্য ও চিকিৎসার প্রচার প্রসারে বিশ্বাসের শ্রেণী বৈষম্য

২০১৯ নভেম্বর ১২ ২২:২৭:১৩
পণ্য ও চিকিৎসার প্রচার প্রসারে বিশ্বাসের শ্রেণী বৈষম্য

মানিক বৈরাগী


কিশোর গঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার চরপলাশগ্রামে কবিরাজ সবুজ মিয়ার হাজার হাজার লোক জমায়েত করে চিকিৎসা সভা অনুষ্ঠিত হয়।উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যান। কবিরাজের খবর পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার বন্যা বয়ে চলেছে পত্রপত্রিকায়। টিভি টকশো তে।চতুর কলামিস্টদের কলামে পত্রিকার পাতা ভরে যাচ্ছে।সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তোএনিয়ে আমার এক পাঠক আমাকে ইনবক্স করে চুপ থাকার পেছনে কারন কি জানতে চাইলো।তিনি আমাকে প্রশ্ন করলো "ভাই আপনি কতকিছু নিয়ে লিখেন, ফেইসবুকে পোস্ট করেন।

এবার কিন্তু আপনি মাইকে ঘোষণা দিয়ে সমস্ত রোগের মহা ঔষধ কবিরাজ, বৈদ্যের পাণি পড়া নিয়ে ভালো মন্দ কিছুই লিখলেন না কেন? আমার লেখার আগ্রহী পাঠকের উত্তর টা আমি প্রকাশ্য দিবার চাই।

তার আগে একটি উদাহারণ দিয়ে শুরু করি।মজলুম জননেতা পীরে কামেল মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী স্বাধীনতার পূর্বে তিনি নৌকা এক রাজনৈতিক সফরে বের হলেন।মাওলানার বাংলার মেহনতি মানুষের কাছে বিভিন্ন রকমের আবেদন ও পরিচিত আছে এবং আস্থা রাখতেন।তিনি যেদিকেই যেতেন হুজুরের জন্যে আপামর মানুষের ঢ্ল নেমে যেতো। তাঁকে একবার দেখার জন্যে, বিভিন্ন রোগের পানিপড়া জন্যে, ঝাড়ফুকের জন্যে।তিনি পকেটে করে বিভিন্ন রকমের তাবিজ নিয়ে যেতেন।রোগের উপর ভিত্তি করে তাবিজ, পানি পড়া দিতেন।সাথে তাদের হাতে কিছু টাকাও দিতেন। টাকা দেয়ার পর বলতেন যাও পানিপড়া ও তেল পড়ার ব্যবহার বিধি বলে দেয়ার পাশাপাশি এ বলতেন ঐ টাকা দিয়ে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার ও দেখাবে, সাথে ঔষধ কিনে খাবে।

মাওলানা ভাসানী জানতেন তার রোগের চিকিৎসা পীরের কাছে নাই, তবুও হুজুরের প্রতি তার বিশ্বাস তিনি নষ্ট না করে ডাক্তারি চিকিৎসা নেবার কথা বলতেন। ফলে হুজুরের রাজনীতি ও সেবা দুটোই হচ্ছে।এবং তার চিরায়ত বিশ্বাস কে ও তিনি সম্মান দেখালেন। ভারত উপমহাদেশে কবিরাজ, পীর, ফকির, তান্ত্রিক, বৈদ্য, জ্যোতিষ, এসব গুণি মানুষেরা অশিক্ষিত দরিদ্র ভারতে হাজার বছর ধরে তারা গণ মানুষের মনে এক প্রকার আস্থা অর্জন করেছে। তাঁদের যার যার পদ্ধতি অনুযায়ী তারা মানুষের সেবা করে আসছে।

আমি যেহেতু বিজ্ঞানী নই, নই কঠিন বস্তুবাদী, নই কোন পদ্ধতির দীক্ষিত অনুসারী। মুলত এক প্রকার সংশয়বাদী।তাই আমার একটি অনুসন্ধিৎসু মন আছে।তাই এসবের সাথে মানুষের কোথায় কি সম্পর্ক তা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখা ও জানার চেষ্টা করা।

অশিক্ষিত এই ভারতবাসী হাজার বছর যে যার সমাজ সংস্কৃতি ও ধর্মীয় পদ্ধতিতে এসবের প্রতি আস্থা রেখে মনের মাঝে শান্তনা খোজে পেয়েছে। তান্ত্রিক বা বইদ্যের মন্ত্র বা যাদুকরের জাদু মন্ত্র নিয়ে কত হাজার বই লেখা হয়েছে তার কোন হিসাব আমার কাছে জানা নেই। এই যাদু মন্ত্র নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় কত ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে তার হিসাব ও আমার কাছে জানা নেই। পুঁজি ও পুজিবাদের প্রয়োজনে খোদ বস্তবাদী আমেরিকা তাদের চলচ্চিত্র শিল্পে হরর ফ্লীম নাম দিয়ে এই ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। তাদের বহুজাতিক কোম্পানির প্রচার প্রসার ও পুজি আহরণের স্বার্থে যখন যা প্রয়োজন তাই তারা আমাদের মাঝে গেলানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

যেমন ধরুন লিবার ব্রাদার্স কোম্পানি তাদের পণ্যের ব্যবসায়িক প্রচার প্রসারের প্রয়োজনে আধুনিক বিজ্ঞানের সাথেও খুব কৌশলে ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় আচরণ, সংস্কৃতি কেও কাজে লাগাতে বিন্দু পরিমাণ দ্বিধা করেনি। তাদের পোষ্য বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ধর্মীয় গুরু যখন যা ও যাকে,যাদের প্রয়োজন তখন তাদের কাজে লাগিয়েছে। তারাই আবার একদল পোষ্য কে দিয়ে এসবের বিরোধিতা করায়। পক্ষ বিপক্ষ বিতর্ক সৃষ্টি করায়, যাতে তাদের উৎপাদিত পণ্য যত দ্রুত সময়ে গ্রাহকের পৌঁছে। এবং গ্রাহকের মাঝে কৌতূহল ও আগ্রহ সৃষ্টি হলে পণ্যের বেচা বিক্রি বাড়ে ও মনোপলি ব্যবসা করতে পারে। যেমন : ধরুন একজন কৃষাঙ্গ নারী সে যতই তার দেহে ফেয়ার এন্ড লাভলী ব্যবহার করুক না কেন সে কখনো ফর্সা হবেনা। যদি হতো আফ্রিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপাঞ্চলের সকল নারী রাতারাতি ফর্সা হয়ে যেতো। কিন্ত তা হয়নি।একি ভাবে লাক্স সাবান ও তাই।এরকম আরো বহু বহুজাতিক ত্বক ফর্সা করার পণ্য গোটা ভারত বর্ষে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাদের আস্থা অর্জন করে একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানি গুলো যে দেশে যে সংস্কৃতি তাকে পুজি করে ব্যবসা করে যাচ্ছে।

আপনারা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে খোদ লিবার ব্রাদার্সের কয়েকটি পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখবেন হিজাব নিয়ে। হরলিক্স, ওভালটিনের বিজ্ঞাপনে বিশ্বাস করে আপনার শিশুর মেধা ও হাড়গোড় শক্তের জন্যে খাওয়ান।এতে কতটুকু মেধা বাড়ে আমি জানিনা, তবে কোম্পানির পুজি ঠিকই বাড়ে। আমি দেখলাম শহরে ও গ্রামে শিক্ষিত লোকের হরলিক্স,ওভাল্টিন সহ এ জাতিয় খাদ্য খাওয়া বাচ্চাদের আমি দেখলাম তাদের অধিকাংশই মুটিয়ে যাওয়া সন্তান। যারা ঠিক মতোই হাটতে পারেনা। স্কুলে যাওয়ার সময় হাপিয়ে হাটে মোটাতাজা করণের ফলে। আর এখন শিক্ষিত বড়লোকের সন্তানদের জন্য গড়ে উঠা স্কুল গুলো সব বাসাবাড়িতে বা কোন কোন বড় ফ্ল্যাটে। যেখানে বাচ্চারা দলবেঁধে হাটার পর্যন্ত জায়গা নাই।বাচ্চাদের জন্য খেলার মাঠ তো দুরের কথা উঠান যেটা আছে সেখানে ঠিক মতো লাইনে দাঁড়িয়ে এসেম্বলি পর্যন্ত করা যায়না।

আমার সুপ্রিয় কথিত আধুনিক শিক্ষিত পাঠক পাঠকাগণ আপনারা যদি চতুর বহুজাতিক কোম্পানির পণ্যের চালাকি বিজ্ঞাপন কে বিশ্বাস করে নিজের আয় রোজগারের টাকায় ওসব কিনে ব্যবহার করেন।গ্রামের অশিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষ বইদ্য কবিরাজ তান্ত্রিক, পীর ফকিরের পানিপড়া,ঝাড় ফু, তাবিজ কবজে বিশ্বাস করে মনে শান্তি পেলে আমার তো গা চুলকানোর কথা না।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বে সবচেয়ে মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে আধুনিক শিক্ষিত লোকের কাছে।নির্যাতিত হচ্ছে তাদের কাছে।এরাই দুর্নীতি সহ বিভিন্ন কলমি অপরাধ করে যাচ্ছে। কিন্তু গ্রামের একজন কৃষক তার ফসলের জমিতে পানি সেচ দিতে কার্পণ্য করেনা,সার কিটনাষক দিতে দুর্নীতি করেনা।

অথচ আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষিত বিজ্ঞানীরাই মানুষের ক্যান্সার সহ বিভিন্ন মরণঘাতী সার ও কিট নাষক আবিষ্কার করেছে।অশিক্ষিত কৃষক এসব করেনি। তারা তাদের হাজার বছরের প্রকৃতি পদত্ব অর্জিত অভিজ্ঞান কে কাজে লাগিয়ে মানুষের অন্ন সংস্থান করেছে।আর আমরা আধুনিক বিজ্ঞান ব্যবহার কারি শিক্ষিত জনেরা কৃষি ব্যবস্থাপনায় ও দুর্নীতি করি, কৃষক কে ঠকাই।আবার তাদের পানি পড়া,তাবিজ কবজ কে ঘেন্নার চোখে দেখি।

কিন্তু নিজেরাই যে পকেটের অর্জিত অর্থ দিয়ে এসব রঙ ফর্সা করার বিজ্ঞাপনে বিশ্বাস করে প্রতারিত হচ্ছি,আমরা যারা বৈদ্যের ঝাড়ফুক, তাবিজ-কবজ, পানি পড়া যারা নিচ্ছেন তাদের বিশ্বাস কে অবজ্ঞা করা ও এক প্রকার বৈশম্য নয় কি। না বহুজাতিক কোম্পানির প্যান্ট শার্ট কোট টাই সাহেবদের দেখে আমরা মোহান্ধ হয়ে ঐ গ্রামের আমজনতার প্রতি হিংসা বিদ্ধেষ সৃষ্টি করছি। আসুন নিজের অর্জিত বিদ্যা কে শ্রেণী বৈশম্যে সৃষ্টির কাজে না লাগিয়ে নিজেই জ্ঞান কে আরো মানব কল্যান মুখী গড়ে তুলি।

বহুজাতিক কোম্পানির পুজি আহরণের জন্যে তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপনের কাজে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষের কাছে তাদের পণ্য নিয়ে যায়। আর গ্রামের একজন বৈদ্য, তান্ত্রিক, জ্যোতিষের তাবিজ কবজ,পানি পড়া,ঝাড়ফুঁকের জন্যে রেডিও, টিভি, পত্রিকায় টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিতে হয়না। তো মানুষের বিশ্বাসের স্থর কতটুকু গভীর হলে হাজার হাজার মানুষ একটি মাঠে জড়ো হতে পারে। তো আমরা যারা সমলোচনা করছি আমরা তাদের বিশ্বাসের ভাইরাস ভাঙার জন্যে ক'জন কোন দিনে গ্রামে গিয়ে তাদের সচেতন করে গড়ে তুলেছি।আমরা তো আবার সব কিছু সরকার, এনজিও ও রাজনৈতিক দলের উপর ছেড়ে দিয়ে নিজে সুখভোগ করে কথা লিখছি আর বৈশম্যের বিষবাষ্প ছড়াচ্ছি।আর নিজেকেই সুশীল দাবি করে নিজে নিজে আত্মসুখ ভাব নিচ্ছি।

আমরা নিজেরাই তো গ্রাম থেকে উঠে আসা অশিক্ষিত, চাষাভুষা, জেলে কামার কুমারের কষ্টার্জিত অর্থে লেখাপড়া করে তাদের প্রতিই অবজ্ঞা করছি।এটাও একপ্রকার প্রতারণা ও বিশ্বাসের বৈষম্য। আসুন তথাকথিত পুজিস্বার্থের বিশ্বাস পরিহার করে গ্রামের চিরায়ত জনমানুষের মান্ধাতা আমলের অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাস কে বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্বাসে পুণর্গঠন করি।বিশ্বাসের শ্রেণী বৈশম্য নিজেরাই দুর করি। আসুন মানবিক সুখী সুন্দর শ্রেণী বৈশম্য মুক্ত সমাজ গঠনে এগিয়ে আসি।

লেখক : কবি ও নব্বুইয়ের নির্যাতিত ছাত্রনেতা, কক্সবাজার।