ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

পরিবহন আইন বড়ই অসহায়

২০১৯ নভেম্বর ২০ ১৪:৩৪:৫৭
পরিবহন আইন বড়ই অসহায়

রণেশ মৈত্র


ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বারংবার। ১৯ নভেম্বর, নতুন বছর এসেই গেল। তাকে স্বাগত জানানোর নানাবিধ প্রস্তুতি দেশ জুড়ে। চলছে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা সমগ্র বাংলাদেশে শীতের আগমনির সুর ধীর লয়ে বাজছে কিন্তু ঋতু পরিবর্তনের ধাক্কায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-শিশুরা অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে বাৎসরিক ও টেষ্ট পরীক্ষা চলছে। উচ্চ শিক্ষায় নিয়োজিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও পরীক্ষা নেওয়া-দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত। স্কুল কলেজের সাথে, পাশে বা নিকটে ৯৫ ভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকা-ছাত্র-ছাত্রী বাস করেন না। দূর থেকে আসতে হয় তাঁদের সপ্তাহে ছয় দিন। চাকুরিয়াদের কর্মস্থলে যেতে আসতে দূরবর্তী এলাকা থেকেও। জারুরী ক্ষেত্রে রোগী ঢাকায় নিয়ে যাওয়াও একটি নিয়মিত প্রয়োজন।

তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায় কিন্তু তা থেকে বিরত রইলাম সময় ও পত্রিকার স্থানাভাবে।

যে কথাগুলি উপরে উল্লেখ করলাম-তা নতুন কোন গবেষণালব্ধ বিষয় নয়। সকলেরই জানা। পরিবহন মালিক শ্রমিকেরা আরও বেশী করে জানেন। কারণ তাঁদের যানবাহনে চড়েই নিত্যদিন এই হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ নারী পুরুষ নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করে থানে। নিত্যদিন যাতায়াতের কারণে ঐ শিক্ষার্থীদের জন্য খাতির বা কনসেশনের ব্যবস্থা নেই-পৃথিবীর অপরাপর দেশের মত।

পরিবহন মালিক শ্রমিকেরা এও জানেন যে বাংলাদেশে তাঁর একচেটিয়া ব্যবসায়ের সুযোগ পেয়ে থাকেন যা পৃথিবীর খুব কম দেশে বিদ্যমান। তাঁরা জানেন, বাংলাদেশে রেলপথ, রেলপথে যাত্রী সেবা-বিশেষত: উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে নিদারুনভাবে আজও সীমিত। নদীপথ-নৌযানগুলিকেও কবেই না সমাধিস্থ করেছি আমরা। এবং নানাবিধ কারণেই ব্যবসাটা একচেটিয়া।

ব্যক্তি মালিকানা যদি একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ পায়, বিপদ-বিপর্য্যয়ের আশংকার অস্তিত্ব, এমন কি ক্রমবৃদ্ধির আসংকা সেখানে তীব্র। বাস্তবে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ এই ব্যক্তি মালিকানায় পরিবহন সেক্টোরের ব্যবসার অসহায় শিকারে পরিণত আজ নয়-বহুকাল যাবত।

বলছিলাম ২০১৯ সালের বিদায়লগ্নে সকল স্তরের মানুষের বাড়তি ব্যবস্ততার করণে নানাস্থানে যাতায়াতের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধির এই সময়ে ১৯ নভেম্বরের পত্র-পত্রিকায় দেখলেন উত্তর ও দক্ষিনাঞ্চলের ১২ টি জেলায় সেদিন থেকেই পরিবহন ধর্মঘট শুরু। নির্দিষ্ট কোন সময়ের জন্য তাঁরা এই ধর্মঘটের আয়োজন দেন নি তাঁরা বলেছেন তাঁদের দাবী আদয় না হওয়া পর্য্যন্ত এ ধর্মঘট চলবে অনির্দিষ্ট কালের জন্য।

দাবীটি কি? পরিবহন আইনের সংশোধিত বিধানগুলি প্রত্যাহারের দাবীতে। দাবী তাঁদের এই একটাই। সংস্কারকৃত এই আইনের বিধানগুলি কার স্বার্থে প্রণীত? যাত্রী সাধারণ, চালক-মালিক-সবার স্বার্থেই। কিন্তু তাঁরা বাতিল বা প্রত্যাহার চান ততটুকুই যতটুকু যাত্রীদের স্বার্থে প্রণীত। যেমন, অতিদ্রুত চালালে শাস্তি, লাইসেন্স-বিহীন চালক চালালে শাস্তি, ফিটনেস বিহীন যান-বাহন চালালে শাস্তি, মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ী চালালে শাস্তি, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ী চালালে শাস্তি প্রভৃতি। কিন্তু এগুলি কি আমাদের দেশেই শুধু মাত্র নিষিদ্ধ? না, পৃথিবীর সর্বত্র তা নিষিদ্ধ। কিন্তু দাবী মানলে ঐ শাস্তির বিধানগুলিকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে।

প্রত্যাহারের পরিণতি? পথে পথে দুর্ঘটনার আশংকা, অহেতুক নিরীহ যাত্রীদের মৃত্যুর আশংকা বৃদ্ধি। ধর্মঘটে নিয়োজিতরা তা জানেন না-তা নয়। কিন্তু তা সত্বেও এমন সর্বনাশা ধর্মঘট। এই ধর্মঘট কি আইন সম্মত? আমরা জানি দেশে শ্রম আইন বিদ্যমান। সে আইনে আমাদের শ্রমিক সমাজের স্বার্থ পূরোপূরি রক্ষিত হয় নি-এ অভিযোগ শুধু নানা সেক্টরে বাংলাদেশে কর্মরত শ্রমিকদের বা দেশবাসীর তা নয়। এ অভিযোগটি খোদ আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার (আই.এল.ও) ও বটে। সেই শ্রম আইনের বিধান অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন কোন কারণে প্রয়োজনে ধর্মঘট ডাকতে পারবে তবে তার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিত দিয়ে বলতে হবে যে এই এই দাবী এত তারিখের মধ্যে মানতে হবে এবং না মানলে তাঁরা ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হবেন। যদি কর্তৃপক্ষ না মানেন তবেই একটি ধর্মঘটকে বৈধভাবে আশুত বলে বিবেচনা করা হয়।

চলমান ধর্মঘট শ্রম আইনের সেই নিয়ম মেনে করা হয় নি। এটি অ´াৎ আহ্বান করার ফলে এই ধর্মঘট অবৈধ।
আরও এক কারণে ধর্মঘটটি অবৈধ। কোন ট্রেড ইউনিয়ন যদি ধর্মঘট কোন কারণে ডাকতে চান তবে ঐ ট্রেড ইউনিয়নের নির্দিষ্ট পরিমাণ বৈধ সদস্য থাকতে হবে এবং সেই সদস্যদের অধিকাংশ ভোটে যদি ধর্মঘট আহ্বানির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়-তবেই কর্তৃপক্ষের নিকট সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন দাবী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না মানলে ধর্মঘট করা হবে উল্লেখ করে নোটিশ পাঠাতে পারেন। দৃশ্যতই এক্ষেত্রে তেমন কোন কিছুই করা হয় নি।

তাই শ্রম আইনের বিধান অনুযায়ীও এ ধর্মঘটে সম্পূর্ণ বে-আইনী। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়নগুলি (বিশেষ করে পরিবহন শিল্পে) কোনদিইন ঐ আইন মেনে ধর্মঘটডাকেন না। তাই তাঁর কি শ্রম আইন, কি পরিবহন আইন-কোনটাই মানতে চান না মানেনও না। না মানার সাহসটি তাঁরা পান বে-আইনী ঘোষণা করেন না এবং বে-আইনী ধর্মঘটিদের বা তার উষ্কানী দাতাদের বিরুদ্ধে কদাপি কোন শাস্তির ব্যবস্থা করেন না। ফলে এই শিল্পের মালিক, শ্রমিকেরা দুঃসাহসী বেপরোয়া। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, পরিবহন আইন অবশ্যই কার্য্যকর করা হবেএবং কোন চাপেই আইনটির বাস্তবায়ন বন্ধ বা স্থগিত হবে না।

কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন কবে থেকে শুরু হবে তার স্পষ্ট ঘোষণা না থাকায় এইভাবে ধর্মঘট ডেকে যে সরকারের উপর অবৈধ চাপ অহরহ করা হচ্ছে-সে ব্যাপারে সরকাটি নেহাতেই উদাসীন। সমস্যাটা সেখানেইন। এখন ট্রেড ইউনিয়ন বলতে প্রধানত শ্রমিক লীগকে। পরিবহন সেক্টরের শ্রমিকদেরকে পূরোপূরি নিয়ন্ত্রণ করেন পরিবহন শ্রমিক লীগ যা একটি সরকার সমর্থিত সংগঠন। তা হলে এটাও তো স্পষ্ট সরকার সমর্থিত, সরকারি লোকদের দ্বারা পরিচালিত পরিবহন শ্রমিক লীগই সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে নেমেছে- নামছে বারংবার। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলাই যায়, সরকার কি তাঁদেরপ্রণীত এই আইনটির দ্রুত এবং পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে সত্যই আন্তরিক কিনা সে প্রশ্নটিও তোলাই যায় চলমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা বেশ কয়েকটি উত্থাপন করছি এই সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে। সমস্যাটির কোন টোটকা সমাধান নেই বলে আমার ধারণা। তাই বিষয়টির স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে যা যা করা প্রয়োজন তা হলোঃ

এক. বি.আর.টি.সি সরকারি সড়ক পরিবহন পরিসেবার কথা আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছি। জনগণের দাবীতে পাকিস্তান সরকারও ই আর টি সি নামে সংস্থাটি চালু করে প্রদেশের নানা স্থানে বি.আর.টি.সি. বাসের চাহিদা থাকায় তখনও আও বৃদ্ধি করার দাবী উঠেছিল। পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী, কুষ্টিয়া সহ দেশের প্রতিটি জেলাতেই ডিপো স্থাপন করে বেশ ভাল সংখ্যক বাস ডিপোগুলিতে দিয়েছিল। তাদের ভাড়াও ছিল কম এবং যাত্রীসেবাও ছিল উন্নততর। কিন্তু সামরিক শাসক স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতায় এসে এক কলমের খোঁচায় ঢাকা ছাড়া অন্যান্য ডিপোগুলি থেকে বি.আর.টি.সি.র বাসগুলি ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করে নেন। তার প্রতিবাদ ওঠে দেশজুড়ে। পরে ক্ষমতা বদলের পর ডিপোগুলিতে নামমাত্র সংখ্যক বাস সরবরাহ করে সেগুলি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু বেসরকারি বাসগুলির মালিক শ্রমিকদের ধ্বংসাত্মক বিরোধিতার কারণে বা যে সুযোগে ডিপোগুলিথেকে বাসগুলি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। যে কয়টি করে দোতলা বাস ছিল সেগুলিকে বেসরকারি বাস মালিক-শ্রমিকরা ঢিলিয়ে ঘেঙ্গে চুরে দিতে থাকলে দোতলা বাসগুলি পূরোপূরি প্রত্যাহার করে নিয়ে বেসরকারি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের শাস্তি না দিয়ে সরকারই নীত স্বীকার করে অপরাধীদের আরও বেশী বেশী দুঃসাহসী দুর্বিনীত করে তোলেন।

যা হোক, ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার কারণে সরকার অবিলম্বে প্রত্যেক জেলার বি.আর.টি.সি. ডিপোগুলিতে ১০০ করে ভাল (নতুন হলে সর্বোত্তম) বাস ও অন্তত: ৫০টি করে ট্রাক সরবরাহ করে সেগুলি ঢাকা সহ সকল আঞ্চলিক রুটগুলিতে চালু করে এই দীর্ঘস্থায়ী সংকটের যতটা সম্ভব সমাধানে এগিয়ে আসুন;

দুই- অতিদ্রুত পশ্চিমাঞ্চলের রেলপথগুলি আধুনিকায়ন, ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ, বগি, নতুন নতুন ইঞ্জিন সহ সার্বিস চালু করুন। ট্রেনের সংখ্যা ঐ অঞ্চলগুলিতে দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা হোক;

তিন. এবারে বলছি সর্বাংশে নিহত ও সমাধিস্থ নদ-নদীগুলিকে দখলমুক্ত করে, সি.এস. খতিয়ান মোতাবেক সেগুলির দৈর্ঘ্যে প্রস্থে উদ্ধার ও সেগুলি খননের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় গভীরতা নিশ্চিত করে সেগুলিকে সাংবৎসরিক বহমান করে তোলার মাধ্যমে কার্য্যকর নৌ পরিবহন সার্ভিস চালু করা হোক। জনমত শতভাগ এই দাবীগুলির পেছনে রয়েছে, রয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ ও নির্দেশনা।

যে কোন সূত্র থেকেই এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে অবিলম্বে তা বিভিন্ন জেলার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের করছে পৌঁছনো এবং চলমান শুকনা মওসুমটি সে কাজের উপযুক্ত হয়ায় তার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা হোক।

আমাদের স্মরণে রাখা দরকার যে নদী পুনরুদ্ধার শুধুমাত্র নৌপরিবহন চালু করার জন্যই প্রয়োজনীয় নয়। তা ছাড়াও দেশব্যাপী পরিবেশের উন্নয়ন, কৃষিতে স্বল্পব্যয়ে সেচ সম্প্রসারণ, বনায়ন ও মৎস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যও অপরিহার্য্য।
মূল আলোচ্য বিষয়টি হলো পরিবহন ব্যবসাায় উন্নয়ন। এবং তা নিয়েই নিবন্ধটির অবতারণা। সে ক্ষেত্রে নতুন সড়ক আইনের পরিপূর্ণ প্রয়োগ এবং বাধাদান কারীদের ও অমান্য কারীদের কঠোর শাস্তি বিধান ব্যতীত এই মুহুর্তে পরিস্থিতির উন্নয়ন অসম্ভব। তাই চলমান ধর্মঘটকে বে-আইনী ঘোষণা করে অবিলম্বে সকল সার্ভিস চালু করে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো এবং তা না করলে কঠোরতম শাস্তি প্রদানও সুরু করা হোক।

এবারের কৌশলটা নতুন। মালিকরা জানেন না এই ধর্মঘটের ব্যাপার এটা মালিকদের দাবী। ট্রেড ইউনিকরাও কোন সিদ্ধান্তের খবর নেই। কিন্তু ১৪ টি জেলায় ধর্মঘট চলছে। কি করে সম্ভব? সরকারকে সব কিছুই খুঁজে বের করতে হবে। নৈরাজ্যের অবসান হওয়া প্রয়োজন।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।