ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

করোনায় করণীয় এবং সভ্যতায় স্মরণীয়

২০২০ মার্চ ২৪ ১৬:০৭:৪২
করোনায় করণীয় এবং সভ্যতায় স্মরণীয়

রহিম আব্দুর রহিম


পৃথিবীর ১৯৫ টি দেশের মধ্যে ১৬৮ টি দেশেই ‘নোবেল করোনা ভাইরাস’র প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এই ১৬৮ দেশে একযুগে ভাইরাস আক্রমনের বিষয়টি এখন আন্তার্জাতিক ক্রাইসিস হিসেবে পরিগনিত হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক কাঁদা ছোড়াছুড়ি নেই বললেই চলে। তবে চির নিন্দুকরা কিছু বলছে না, তা নয়। সবচেয়ে দুঃখ জনক এবং হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা ইস্যুতে পৃথিবীর কোন দেশে নিত্যপণ্যের দাম না বাড়লেও আমরা বাংলাদেশী বাঙালি হিসেবে পণ্যের দাম বাড়িয়েছি এবং মানুষকে কষ্ট দিয়ে মুনাফা লুটছি। যা সভ্য সমাজে স্মরণীয় হয়ে থাকারই কথা। আবেগ-অভিমানের কথা না হয় পরে বলা যাবে, মূল কথা হচ্ছে, বিশ্ব বাজারে ‘নোবেল করোনা ভাইরাস’ মোকাবেলায় আমাদের করণীয় ও অবস্থান।

২১ মার্চ টুইট বার্তার বরাদ্ধ দিয়ে জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র কিয়ানুশ জাহানপুর বলেন, ‘আমাদের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলতে পারি, করোনা ভাইরাস প্রতি ১০ মিনিটে ১ জনের মৃত্যু হচ্ছে এবং প্রতি ঘন্টায় ৫০ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত টালি থেকে জানা যায়, গত ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি হয়। এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ২লাখ ৪০ হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গিয়েছে ৯ হাজার ৮’শ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার ইতালিতে, এখানে আক্রান্ত হয়েছে ৪১ হাজার, মারা গেছে ৩ হাজার ৪’শ ৫ জন। ২২ মার্চের তথ্য অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে মৃত্যুর সংখ্যার ১৩ হাজার বাংলাদেশে আক্রান্ত ২৪ জন, মারা গেছে ২ জন। দেশে জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। করোনা আতঙ্কে বিশ্বের ১০০ কোটি শিশুর স্কুলে যাওয়া বন্ধ এর মধ্যে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৬৭ লাখ। করোনা ইস্যুতে সৃষ্ট আতঙ্ক এবং মুনাফাখোরদের অব্যাহত উল্লাসের বিষয়টি এখন সমাজের প্রান্তিক মানুষের সচেতনতায়, ‘গুদের উপর ফোঁড়ার বিষ’ হয়ে দেখা দিয়েছে।

‘NOVEL’ শব্দটি বৈজ্ঞানিক পরিভাষা, ‘নতুন’, আর ‘CORONA’ শব্দটি বৈজ্ঞানিক পরিভাষা হচ্ছে ‘সৃষ্ট।’ ‘VIRUS’ শব্দটি ‘জীবানু।’NOVEL CORONA VIRUSএর মিনিং দাঁড়াচ্ছে, ‘নতুন সৃষ্ট ভাইরাস’ ব্যাখ্যাটির বিজ্ঞান ভিত্তিক ভিত্তি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সুদৃঢ় । সেই শিশুকালে স্যারদের কাছে শুনেছি, পৃথিবীর কোন সৃষ্টিই ধ্বংস হয় না, শুধু মাত্র অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। কাঠ পুড়ে ছাঁই হয়, ছাঁই মাটিতে মিশে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, গাছের পাতা মাটিতে পড়ে প্রথমে পঁচে যায় পরে শুকিয়ে যায়, এর পর মাটির ক্ষয়রোধ করে। বিজ্ঞান এমনটিই ব্যাখ্যা করে। একই ভাবে নদী তার একপাড় ভাঙ্গে, অন্যপাড় গড়ে তোলে। অর্থাৎ পৃথিবীর সবকিছুই পরিবর্তনশীল। একইভাবে রোগ-ব্যাধি, জীবানু তার অবস্থার পরিবর্তন, পরিবর্ধন করবে এটাই স্বাভাবিক। ‘নতুন সৃষ্ঠ করোনা ভাইরাস (NOVEL CORONA VIRUS) কোথা থেকে, কিভাবে, কোন প্রাণি অথবা প্রকৃতির কোন জায়গা থেকে পরিবর্তন হয়ে সৃষ্টি হল, তা এখনও বিজ্ঞানিরা আবিষ্কার করতে পারেনি।

তবে নোবেল করোনা ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট রোগটির নাম ‘কোভিড-১৯’ অর্থাৎ ‘কো’ এর পূর্ণরূপ ‘করোনা’, ‘ভি’ এর পূর্ণরূপ ‘ভাইরাস’ এবং ‘ডি’ এর পূর্ণরূপ ‘ডিজিস’ এবং ১৯ দ্বারা বোঝানো হয়েছে রোগটি ধরা পড়েছে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে। রোগ আবিষ্কার করায় বৈজ্ঞানিক সমাজকে মানব মহলের আন্তরিক ধন্যবাদ প্রদানে কোন কার্পূণ্য নেই। শৈশবকালের মহান, আদর্শ ও প্রাজ্ঞ শিক্ষকদের কাছে জেনেছি, ‘ভাইরাস’ নাকি মানুষ কিংবা পশুপাখির দেহে প্রবেশ করে যেমন দেহের সচল কোষকে ধ্বংস করে মৃত্যু নিশ্চিত করে, তেমনি প্রাণ ও প্রাণির মধ্যে প্রতিষেধক হিসেবে অবস্থান করে।

প্রতিরোধ বা প্রতিষেধক ভাইরাসের বড় বৈশিষ্ট্য হল, পশুপাখির দেহে যে প্রতিষেধক ভাইরাস অবস্থান করে তাকে আমরা ‘এ্যানিম্যাল ভাইরাস’ বলে থাকি, আবার মনুস্য দেহের যে ভাইরাস থাকে তাদের বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ‘হিউম্যান ভাইরাস।’ ভাইরাস একটি জীবানু, এই ভাইরাস যে বহন করে বা যার মাধ্যমে ছড়ায় তাকে আমরা ব্যাক্টরি বলে থাকি। আমার এই বক্তব্য বা সংজ্ঞার কোন বিজ্ঞান ভিত্তিক ভিত্তি আছে কি না জানি না, তবে আমার শৈশবের শিক্ষক, যাঁরা প্রকৃতিগত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের জ্ঞানদান করেছেন, তাঁদের এই ব্যাখ্যা আমার কাছে যৌক্তিক এবং বিজ্ঞান ভিত্তিক বলে মনে হয়েছে।

বর্তমান সময়ের সাথে অতীত স্মরণ করলে আমরা সবাই নির্দ্বিধায় বলতে পারি, একসময় এই উপমহাদেশে বা মহাদেশের প্রকৃতির জলে-স্থলে, পাহাড়-জঙ্গলে, বন-বাদরে বহুজাতিক গাছ-গাছরা যেমন ছিল, তেমনি পশুপাখির কলকাকলিতে মূখর হয়ে উঠতো ওই সময়কার ভূস্বর্গ। পশুপাখির অভয়ারণ্য, সবুজ শ্যামলের গাছ-গাছরা, লতা-গুল্ম, জলজ ও স্থলজ কীটপতঙ্গ, পরিবেশ সম্মত ব্যবহার্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আজ কোথায়? মানব সমাজের নির্দয় আচরণই পৃথিবীর অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে চলছে।

এক সময় রোগ বালাই বলে জেনেছি, ‘কলেরা-ডায়রিয়া’, ‘গুটিবসন্ত’, ‘যক্ষা’ সর্বোপরি শুনেছি ‘প্লে’ রোগ। যে রোগটি ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়িয়েছে। এযুগে ওই সমস্ত রোগের প্রতিষেধক ও চিকিৎসা এখন হাতের কাছে। বর্তমান বিশ্বে এমন দেশ রয়েছে যারা সাপ, কুকুর, বাদুর, বানর, বেড়াল, হনুমান, শামুক, ঝিনুক সহ সকল প্রকার কীটপতঙ্গ ভক্ষণ করছে। আর যারা এগুলো ভক্ষণ করছে না, তারা এ ধরণের জীব-বৈচিত্র্য অবাধে মেরে ফেলছে এবং এগুলো যেখানে সেখানে ফেলে দিচ্ছে। এছাড়া সবুজ বৃক্ষরাজি নির্বিচারে কেটে ফেলছে, ফলে এ্যানিম্যাল ভাইরাস বাতাসে মিশে যাচ্ছে, বাতাসে যুক্ত হচ্ছে অপরিকল্পিত কালো ধোঁয়া।

পৃথিবীর পরিবর্তনের সাথে সাথেই জীবানুর পরিবর্তন রোগব্যাধি সৃষ্টি অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। আমরা জানি, পৃথিবীর সকল সৃষ্টিই একে অন্যের পরিপূরক। বিগত ১ বছরের ব্যবধানে পৃথিবীর সভ্যতায় রোগের ধরণ যেমন পাল্টিয়েছে, তেমনি রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিষেধক এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রের পরম উন্নতি হয়েছে। সম্প্রতিকালের করোনা ভাইরাস অর্থাৎ নতুন সৃষ্ট ভাইরাসটি কারা সৃষ্টি করেছেন? উত্তর সোজা সাপ্টা এই ভাইরাস মনুস্য দ্বারা সৃষ্ট এবং কোভিড-১৯ রোগটির জন্য পুরোপুরি দায়ী আজকের সভ্য পৃথিবীর সৃষ্টির শ্রেষ্ট মানবকুলের। জলবায়ুর আবহাওয়া অনুযায়ী পৃথিবী ১৯৫টি দেশের জীববৈচিত্র্য ভিন্ন ভিন্ন। সকল প্রাণের ভেতরে থাকা প্রতিরোধ বা প্রতিষেধক ভাইরাস আজ সারা পৃথিবীতে ছঁড়িয়ে পড়ে নতুন ভাইরাস সৃষ্টি হয়েছে কি না, তা গবেষণালব্ধ আবিষ্কারের বিষয়। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, প্রকৃতির ওপর মনুস্য সমাজের অস্বাভাবিক ও নির্মম আচরণই এই ‘নোবেল করোনা ভাইরাস’ সৃষ্টি হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ থাকার কথা না।

‘নোবেল করোনা ভাইরাস’টি যদি কোন একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হতো তাহলে সেটার ভিন্নতা খোঁজা কঠিন হতো। যখন এই বিষয়টি আন্তর্জাতিক ভাবে সমানহারে বা মাত্রায় প্রচার হচ্ছে এবং দেখা দিচ্ছে তখন নিশ্চিত বলা যায় ‘নোবেল করোনা ভাইরাস’, পরিবর্তনশীল পৃথিবীর জন্য অস্বাভাবিক কোন বিষয় নয়, এটি স্বাভাবিক এবং ক্ষনস্থায়ী যা মোকাবেলায় সতর্ক এবং বিশ্ব নেতৃত্বের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে জীববৈচিত্র রক্ষা, মৃত পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, ইঁদুর, বাদুর মারা যাওয়ার পর তা মাটিতে পুঁতে রাখা এবং হাইএ্যান্ট্রিবায়োটিক খাবার-দাবার বর্জন করা। এই মুহুর্তে পৃথিবীর সকল যোগাযোগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে ভাইরাস মোকাবেলায় যা হচ্ছে তা বিশ্ব সভ্যতায়, সেই বানরের পিচ্ছিল বাঁশ আরহনেরও নামান্তর।

আমরা স্বাভাবিক জ্ঞানে জানি, ভাইরাসের কোন কোষ নেই, এই কোষহীন জীবানু মানব দেহে প্রবেশ করে ওই দেহের কোষকে নির্জীব করে ফেলে, ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। তেমনি ‘এ্যানিম্যাল ভাইরাস’ হিউম্যান বডিতে প্রবেশ করে না বলে জেনেছিলাম, এবার জানলাম ‘করোনা ভাইরাস’ শুধুমাত্র হিউম্যান বডিতে আক্রমন করে। এই ভাইরাসটি তৈলাক্ত ‘নবেল করোনা ভাইরাস’ বাতাসে ছড়ানোর কোন সুযোগ নেই, জীবানুটি কোন পাত্র, বস্তু বা ভূমির উপরিভাগে অবস্থান করার সক্ষমতা রাখে, তবে তাপমাত্রায় তা শুকিয়ে যায়। এ অবস্থায় কোন পাত্র খোলা জায়গায় হাত রাখলে এই জীবানু হাতের মাধ্যমে অন্যের শরীরে মুখ, নাক এবং চোখের মাধ্যমে প্রবেশ করতে পারে। ফলে ব্যবহার্য থালা-বাসন এবং যেখানে সেখানে হাত লাগানো পর হাত ক্ষার জাতীয় পদার্থ (সাবান) দ্বারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখাই এই জীবানু প্রতিরোধের বড় মাধ্যম।

বাস, ট্রাক, স্কুল, কলেজ বন্ধ, শহর-বন্দর লগডাউন বা সাটডাউন এগুলো নতুন সৃষ্ট ‘নোবেল করোনা ভাইরাস’এর মতই পৃথিবীর মনুস্যসৃষ্ট মহা আতঙ্ক বলেই মনে হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক আইনে কি হতে পারে জানা নেই, তবে দেশের প্যানাল কোড-৫০৫/খ ধারা অনুযায়ী অপরাধের শামিল, অপরদিকে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রন ও নির্মুল আইন ২০১৮ অনুযায়ী ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি (কোয়ারেন্টাইনে) আলাদা ও (আইসোলেশন) চিকিৎসায় অবহেলা করলে তাকে এবং তার পরিবারকে জেল এবং জরিমানা করার বিধান রয়েছে।

প্রায় ৬০০ কোটি মানুষের এই পৃথিবীর ১৯৫ টি দেশের মধ্যে ১৬৮টি দেশের ২ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া কোন মহামারি নয়, তবে এই রোগের আতঙ্কে সারা পৃথিবীর সকল মানুষ যেভাবে মানুুসিকভাবে আক্রান্ত হয়েছে তা মহামারির নামান্তর বলেই মনে হচ্ছে। ভারতে কারাগারে কয়েদিদের সাথে কারারক্ষীদের সংঘর্ষ হয়েছে, বাংলাদেশে করোনার পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে একজন খুন হয়েছে। এ কিসের লক্ষণ! ভাইরাস সৃষ্টি হল চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে, তা গেড়ে বসলো ইতালিতে! ‘নোবেল করোনা ভাইরাস’ প্রতিরোধে এক শ্রেণির মানুষ পৃথিবীর মনুস্যকূল রক্ষায় যখন উদ্বিগ্ন, এই অবস্থায় ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে ফায়দালোটা, ষড়যন্ত্র, বিশ্বের সক্ষমতা যাঁচাইয়ের যোগ-বিয়োগ হবার আন্তর্জাতিক মারপ্যাচ চলছে বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে ইঙ্গিত করেছে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে এবং পরিস্থিতি স্থিতিশীলকরণে বিশ্বমানবতার ঐক্যবদ্ধ জেগে ওঠা এখন সময়ের দাবী।

লেখক : শিক্ষক, লেখক, নাট্যকার ও কলামিস্ট।