ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » শিল্প-সাহিত্য » বিস্তারিত

মানিক বৈরাগীর একগুচ্ছ কবিতা

২০২০ এপ্রিল ০৬ ১৭:৪৫:২৩
মানিক বৈরাগীর একগুচ্ছ কবিতা







ধরিত্রীমাতার আহবান

সময় এখন
সময় এখন একা একা নিজের সাথে নিজের কথা বলা
সময় এখন একা একা ফুলের সাথে নিজের কথা বলা
সময় এখন একা একা পাখির সাথে নিজের কন্ঠ মেলা
সময় এখন একা একা বাতাসের সাথে নিজের কান পাতা
সময় এখন একা একা আলোর সাথে নিজের দেহ পাতা
সময় এখন একা একা স্মৃতির সাথে স্মৃতির জাবর কাটা
সময় এখন একা একা মাতামুহুরির কাশবেন লুকিয়ে থাকা
সময় এখন একা একা ঘরের ভেতর ঘরকন্নায় মেতে ওঠা
সময় এখন একা একা বেলকনি থেকে বেলকনিতে উঁকি দেয়া
সময় এখন একা একা তোমাতে আমাতে দূর থেকে দূর থাকা
সময় এখন একা একা আকাশ থেকে আকাশের তারা গোনা
সময় এখন একা একা জোছনা রাতে গুনগুনিয়ে গান গাওয়া
সময় এখন নিঃসঙ্গ নির্জনে ইজেল দাঁড়ায়ে ক্যানভাস হওয়া
সময় এখন একা একা মনের জানালা খোলে আয়নায় দাঁড়া
সময় এখন একা একা নিজেকেই বলা এমন আর "করোনা "
সময় এখন একা একা নিজেকেই বলা অপরাধ আর "করোনা"।


নিঃসঙ্গ জোছনার মায়া

সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে ধবধবে সাদা অন্ধকারে
রাস্তা ঘাট জলমহাল লক্ষ্যারচরের বীল সহ বিরান ভূমি
কোথাও কেউ নেই সুনশান ভূতুড়ে নিরবতা চারদিক
ক'দিন থেকে শুনিনি প্রতিদিনের কাকের ডাক
কর্কশ স্বরে ডাকা কাকও অনির্দিষ্টকালের জন্য ডেকেছে ধর্মঘট
আমাদের বাড়ির উঠোনের গাছে যে পাখিরা আসতো তারাও নাই
ঠিকই চাঁদ ওঠে জোছনা বিলোয়,জোছনায় আসতো মনসার কন্যারা
এই ভরা পূর্ণিমা তিথিকে মনেহয় মরাকাটালের জোয়ার হল্লা দিয়ে আসে
পাড়াকে মনেহয় ভূতগ্রাম ঘরগুলোকে মনেহয় ভূতুড়ে বাড়ি শব্দ শুনি
কোথাও কোন মানুষ দেখিনা
আমি জানালায় বসে আকাশ দেখি।


কাঁচের ঘেরা শুভ্র বসনে

সব কিছু ছেড়ে চলেই তো যাবো
এই সুন্দর আকাশ,সবুজে আবৃত পাহাড়, সাগরের ঢেউ সবই নিয়ম মেপে চলবে
হয়ত বন্ধু তোমার আগে আগেই চলে যাবো বন্ধু
তাড়াতাড়ি চলে গেলাম বলে শোক করোনা বন্ধু স্বজন
অশ্রু সজল চোখে থাকিয়ে দেখো ঘাস ফুল পাখি সুদুর আকাশ
ডেকো না শব্দে শক্তি ক্ষয় হয়, ফুল পাখি অরণ্যের দিকে তাকাও
আমি তোমদের ডাক শুনার প্রতিক্ষায় থাকি অধীর আগ্রহে
আমি শুনি দেখি তোমাদের সব সবই, কিন্তু তোমরা তুমি
শুনতে পাবেনা আমায়।

তুমি বলিবে কিসের অভাব ছিল তোমার
কাওকে কিছু না জানিয়ে
এত সহজে নিরব অভিমানে ছিন্ন করলে
জীবনের সকল পাঠ।
আমি উত্তর করব,
কিন্তু তুমি তোমরা বুঝবে না,
সেদিনের আমার নিরবতার ভাষা।
আমি থাকবো কাঁচের ঘেরা শুভ্র বসনে
আমি তোমাদের হাত নেড়ে কাছে ডাকবো আয় আয় কোরে
কাঁচ-ঘেরা বেড়া তোমরা ডিঙাতে পারবে না
আমি অপলক দৃষ্টিতে তোমাদের অবরুদ্ধ মায়া দেখবো
বন্ধু,
আমি যখন তোমার মত হেসেখেলে
তোমাদের মাঝে ছিলাম,
কতোদিন আমরা আম বাগানে খোঁয়াভাতের উৎসব করেছি
মনে আছে কি তোমার?
আমাদের আড্ডা ও অগুনিত মানুষের সাথে
চা-বিস্কুক বেন্সন সিগারেট পুড়ে পুড়ে কতো সময় গড়িয়ে গেলো
আমরা টের পাইনি।
তোমরা কি ভাবো সেই সব দিনের কথা?
না এখনো একা একা আত্মমগ্ন ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার ভাবনা
বন্ধু স্বজনেরা সবার মাঝে থেকেও তোমরা একা একা ভাবছো নিজের
আমি আলোকিত কাঁচ ঘরে একা একা ভাবছি তোমাদের।

জড়াজড়ির জড়তা ছিলো কতো আমাদের
কতোবার তোরা বলেছিলি অন্তত এবার রোদেলা কে জড়িয়ে ধরে চুমু খা
আমি ভিরু সাহসে কুলোয়নি পারিনি
কিন্তু দ্যাখো দুনিয়া জোড়া বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চলছে আশকারা
করোনা করমর্দন "করোনা " জড়াজড়ি "করোনা "চুমাচুমি
চলো দূরে দূরে ভালোবাসি করো চোখাচোখি উড়ন্ত চুমাচুমি
কাছে এসোনা চুমকি তোমায় দূর থেকে ভালোবাসি।


ধরিত্রী

সুপ্তই ছিলাম লক্ষ লক্ষ বছর
জল রোদে আর শীতলতায়
হটাৎ কোথা থেকে কি হয়ে গেলো
আকাশের জলের তৃষ্ণায় রবির খেয়ালিতে ঘটেযায় বজ্রমেঘের খেলা
বিজলির চমকে বাতাসের ঠমকে বনেবাদাড়ে জ্বলে দাবানলের হল্কা
ধরিত্রীর মায়ায় গুহাবাসী বুনো মানুষের মগজে খোলেগেলো বুদ্ধির দরোজা
সেই থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ আমার সব,সবকিছুই তাদের জন্যে অবারিত

হাজার লক্ষ বছর খুব নিরবে সয়ে গেছে নির্মম পদভার
হাজার লক্ষ বছর খুব যত্নে বিলিয়েছে জল খাদ্যসম্ভার
হাজার লক্ষ বছর খুব যত্নে অকাতরে সেবিছে ফলাহার
হাজার লক্ষ বছর উদ্ভিদ বেহিসাবে দিয়েছে অক্সিজেন
হাজার লক্ষ বছর সাগর যোগান দিয়েছে মৎস্য আর নুন
হাজার লক্ষ বছর অকাতরে পাহাড় দিয়েছে সবুজাভ বন
হাজার লক্ষ বছর বৃক্ষ দিয়েছে আশ্রয় পাখি গেয়েছে গান
হাজার লক্ষ বছর অজস্র নদী ঝর্ণা মিটিয়েছে তৃষ্ণার জল
হাজার লক্ষ বছর ক্ষুধায় খেয়েছো উদ্ভিদ তৃণলতা ফলমূল
বুনোদের মতো বনবাদাড়ে গুহাবাসে ছিলো মানুষ সাম্যবাদী

প্রকৃতির অমোঘ খেয়ালে মানুষের পীড়নে ভোগের বুদ্ধির বিকাশে
হাজার বছর কতো গবেষণা, কতো লড়াই যুদ্ধ নিজের বিরুদ্ধে নিজে
নিজেদের ভোগ ক্ষমতা সাম্রাজ্য বিস্তারে মানুষ মানুষের হত্যাকারী
বাদ রাখেনি মাঠির গভীরতা, সমুদ্রের তলদেশ, প্রাণী উদ্ভিদ জল তেল গ্রহ নক্ষত্র
উপগ্রহ
এইসব মারণ উৎসবে আমাকেই করলো উজাড়
অথচ ধরিত্রীর এই অবদানের বিনিময়ে চায়নি কিছুই মানুষের কাছে

একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ মানুষের মরণখেলায় মেতেছে জীবাণু অস্ত্রে
আবারও মানুষ মানুষকেই করছে গুহাবাসী গৃহবন্দী

আজ আমি প্রাণভরে নিজেকেই মেলে ধরলাম
দেখো আমাকে, নিজেও থাকো বিশ্রামে
ব্যস্ত মেরিন ড্রাইভে আবারও সবুজের হাতছানি
যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ণ পিকনিক যুবাদের লাউডস্পিকারের কানফাটা চিৎকার
নেই
সমুদ্রের নীল জলরাশি বুকে নেই জেলেদের নৌকার কোলাহল,পোড়া মোবিলের
আস্তরণ
চারদিকে সুনসান নিরবতায় হাসছে সবুজ বনানীর সাথে সমুদ্রজলের মিতালিতে
খেলাকরে ডলফিন
বিস্তীর্ণ বালুচরে নেই কোন পদচিহ্ন, থরে থরে ফুটেছে গঙ্গাফুল
গঙ্গালতার খুপরি তে মনের সুখে ডিমপাড়ে কাছিমের ঝাঁক

কুয়াশায় ভেজা সৈকতে মনের আনন্দে বালিচিত্র আঁকায় ব্যস্ত লাল কাকড়া
সৈকতে আঁচড়ে পড়া ঢেউ নিজের অজান্তে গড়েছে বালির ট্যারাকোটা।

মানুষের প্রতি

অ মানুষ আমাকে অল্প কিছু দিন সময় দাও জিরোবার জন্য
অ মানুষ আমাকে অল্প কিছু দিন সময় দাও নিজেকে গুছিয়ে নিবো
অ মানুষ আমাকে অল্প কিছু দিন সময় দাও নিজেকে সাজিয়ে নিবো
অ মানুষ এই অল্প ক'টাদিন তোমরা গুহাবাস নয় গৃহবাসী হও জিরোও
অ মানুষ এই অল্প ক'টাদিন তোমরা তোমাদের পরিবার কে সময় দাও
অ মানুষ এই অল্প ক'টাদিন তোমরা তোমাদের মগজ কে শান্তিতে ঘুমাতে দাও
দেখো এ ক'দিনে আমি তোমাদের জন্য আরও একহাজার বছরের শান্তি দিবো
দেখো এ ক'দিনে আমি তোমাদের জন্য আরও একহাজার বছরের শীতলতা দিবো
দেখো এ ক'দিনে আমি তোমাদের জন্য আরও একহাজার বছরের সুস্বাদু জল দিবো
দেখো এ ক'দিনে আমি তোমাদের জন্য আরও একহাজার বছরের সুষম শস্যদানা দিবো
দেখো এ ক'দিনে আমি তোমাদের জন্য আরও একহাজার বছরের সুস্বাদু ফলাহার দিবো
দেখো এ ক'দিনে আমি তোমাদের জন্য আরও একহাজার বছরের বৃক্ষশোভিত সবুজছায়া দিবো
দেখো এ ক'দিনে আমি তোমাদের জন্য আরও একহাজার বছরের হারানো বন ফিরিয়ে দিবো
দেখো এ ক'দিনে আমি তোমাদের জন্য আরও একহাজার বছরের সমুদ্রের মাৎস্য ভান্ডার দিবো
অ মানুষ আমি কথা দিচ্ছি তোমাদের, তোমরা এ ধরিত্রীর খবু আদরে লালিত সন্তান আমার
দয়া করে তোমরা ঘরে থাকো নিরাপদে থাকো ধরিত্রীমাতার শ্রেষ্ঠ মানবজাত।