ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

বিদ্যুৎ দাস কি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি চলে যাচ্ছেন?

২০২০ এপ্রিল ২৬ ১৪:২৮:১০
বিদ্যুৎ দাস কি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি চলে যাচ্ছেন?

শিতাংশু গুহ


বিদ্যুৎ দাস হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আমাদের টেক্সট করে জানিয়েছিলো যে, তিনি কোভিড-১৯ আক্রান্ত। সবার শুভেচ্ছা, আশীর্ব্বাদ চেয়েছেন। সাথে রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন, ‘এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসিখেলায় আমি যে গান গেয়ে ছিলাম……’। বিদ্যুৎ কি বুঝতে পেরেছিলো যে তিনি চলে যাচ্ছেন? পরে জেনেছি, বিদ্যুৎ তাঁর আর এক বন্ধু ডাক্তার উত্তম বণিককে লিখেছেন, ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে--’। এই গানটি ‘চিতাশয্যার’ সাথে সম্পর্কিত। আরো আছে, স্বপন দাসকে তিনি তাঁর অর্থনৈতিক বিষয়ে সবকিছু বলে গেছেন। এ সবই ভেন্টিলেটার পরানোর আগের কথা। ভাবছিলাম, বিদ্যুৎ কি টের পেয়েছিলো? যতদূর শুনছি, বিদ্যুৎ হাসপাতালে গেলেও ভেনটিলেটারে যেতে চাননি। পরে ডাক্তার-স্বজনদের পীড়াপীড়িতে রাজি হন। প্রথম থেকেই তিনি মেডিকেল জটিলতায় পড়েন, মধ্যখানে একটু স্বস্তি এলেও শেষ সপ্তাহে অনেকগুলো উপসর্গ একত্রে হানা দেয়, বিদ্যুত চলে যায় আমাদের ছেড়ে।

মধ্য মার্চে রুমা কিচেনে আমাদের একটি ঘরোয়া বৈঠক ছিলো। তখনো করোনার জন্যে ‘সোশ্যাল ডিসটেনসিং’ নীতি ঘোষিত হয়নি, কথাবার্তা চলছিলো। বিদ্যুৎ জানালো, তিনি আসতে পারবেন না, কারণ তাঁর সর্দ্দি-জ্বর হয়েছে। চন্দন সেনগুপ্ত বললো, আমরা কনফারেন্স কল করি। তাই হলো। এখন বোঝা যায়, বিদ্যুৎ তখন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত, সেদিন আমরা বসলে আরো অনেকে আক্রান্ত হতে পারতাম? এর ক’দিন পর জ্বর ১০৪’ উঠলে তাঁকে হাসপাতালে নেয়া হয়। ডাক্তাররা চেষ্টার ত্রূটি করেননি। তবু শেষ রক্ষা হয়নি। এখন মনে হয়, বিদ্যুৎ মরার আগেও আমাদের একটি উপকার করে গেলো, নিজে মরে আমাদের বাঁচিয়ে দিয়ে গেলো। মৃত্যু মাত্রই কারো না কারো কাছে বেদনার। কোন কোন মৃত্যু কাউকে কাউকে সজোরে একটি ধাক্কা দিয়ে যায়। বিদ্যুৎ দাস-এর মৃত্যু তাঁর পরিবারের বাইরে অনেককে একটি সেই ধাক্কা দিয়েছে।

স্বপন দাস যখন বললো, ‘দাদা, উনি নেই’। ঠিক মানতে চাইছিলাম না, জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বিদ্যুৎ নাই’? স্বপন দাস বললেন, ‘বিদ্যুৎদা আজ রাত (২১ এপ্রিল ২০২০) ৮টা ৫মিনিটে চলে গেছেন’। টের পেলাম, তিনি অস্থির, আবার বললেন, ‘আমি কি যে করি, আমার শ্বাশুড়ী অসুস্থ, স্ত্রী ভাইয়ের জন্যে কান্নাকাটি করছে, বা বিদ্যুৎ’র বাড়ীর অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন’। স্বপন দাস পরলোকগত বিদ্যুৎ দাসের ভগ্নিপতি। শ্বশুড়ি হচ্ছেন, বিদ্যুতের মা। বৃদ্ধা মা’কে রেখে ছেলে চলে গেলো, এই মা’র কথা চিন্তা করে নিজেকে সামলে নিলাম। সবাইকে জানাতে হবে। একই সময়ে নবেন্দু দত্ত’র টেক্সট পেলাম। কিছুক্ষন টেক্সট চালাচালি, এরপর ফেইসবুকে দিলাম। ব্যস, কলের পর কল।

বিদ্যুৎ দাস-এর পুরো নাম বিদ্যুৎ বিহারি দাস, যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। নবেন্দু দত্ত সভাপতি। সিকি শতাব্দী বা আরো আগে বিদ্যুতের সাথে সম্পর্কটা সাংগঠনিক হলেও কখন যে সেটা ‘আত্মিক’ হয়ে গেছে, তা টের পাওয়া যায়নি। বিদ্যুৎ হাসপাতালে ভর্তি হলে সবাই টের পেলেন। ১১ এপ্রিল লিখেছিলাম, বিদ্যুৎ আজ ১৭ই এপ্রিল স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে ভেন্টিলেটরে আছেন, ২১শে এপ্রিল রাতে সব শেষ। আমরা হয়তো অলৌকিক কিছু আশা করছিলাম। ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু এতদিন ভেন্টিলেটরে থাকার পর ফিরে আসার সম্ভবনা কম থাকে? তবু আমরা আশা করছিলাম, মানতে চাইছিলাম না যে, বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে।

মৃত্যু’র মাত্র তিনদিন আগে শনিবার রাতে স্বপন দাস জানালেন, বিদ্যুৎকে একটি নুতন এন্টিবায়োটিক দিচ্ছে, ঠিকমত কাজ করলে সোমবার অন্য ওষুধ দেবে। তবে অবস্থা সঙ্কটজনক। এই প্রথম স্বপন দাসের গলায় ‘হতাশা’র কথা শুনলাম। সবাইকে জানালাম, বিদ্যুতের অবস্থা সঙ্কটজনক। সোমবার স্বপন দাসের সাথে কথা বলে নবেন্দু দত্ত জানালেন, বিদ্যুতের অবস্থা এখন একটু ভালো। তারপর, মঙ্গলবার সব শেষ। আমরা আসলে বিদ্যুৎকে চলে যেতে দিতে চাইছিলাম না, তাই অন্ধকারে আলোর হাতছানি খুঁজছিলাম। কবিগুরু হয়তো এজন্যে গেয়েছেন, ‘যেতে নাহি দেব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়..।

বিদ্যুৎ দাসকে মানুষ ভালোবাসতো। মৃত্য’র পর সেটা আরো ভালোভাবে টের পাওয়া গেলো। হিন্দু কোয়ালিশনের দীনেশ মজুমদার তাই হয়তো বলেন, বিদ্যুৎদা ভালো মানুষ ছিলেন, এতো মানুষ তাকে ভালো বাসতেন তা আগে জানতাম না? বিদ্যুৎ দাস শুধু ঐক্য পরিষদ করতেন তা নয়, সাংস্কৃতিক ও গোঁড়ামির উর্ধে উঠে ধর্মীয় অঙ্গনে তাঁর বিচরণ ছিলো। সদাহাস্য, মিষ্টভাষী ভদ্রলোক বিদ্যুৎ দাস আসলে সংগঠনের দেয়াল উৎরে সার্বজনীন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। তাই লুৎফুন্নাহার লতা ঘটনার পরপরই যখন সত্যতা যাচাই করার জন্যে কল দেন, এবং আমি বলি, ‘ঘটনা সত্য, বিদ্যুৎ নাই’, অপর প্রান্ত থেকে তখন আর কোন শব্দ হয়নি, বুঝলাম, ‘লতা ওয়াজ শক্ড’। এই সময়ে সোসাইটির প্রেসিডেন্ট কামাল আহমদ ও বিদ্যুৎ দাসের মৃত্যু ধারণা করি সবচেয়ে আলোচিত দু:খজনক ঘটনা।

ভাবছিলাম, বিদ্যুতের সাথে আমার শেষ দেখা কবে হয়েছিলো? আমার স্ত্রী আলপনা জানালো, ২২শে ফেব্রূয়ারি মহামায়া মন্দিরে রণজিৎ সাহা’র মায়ের বাৎসরিক কাজে। সেদিন বিদ্যুৎ-কেকা দু’জনের সাথেই দেখা হয়, কথা হয়। আমার স্ত্রী সেদিন বিদ্যুতের সুন্দর পাঞ্জাবীর প্রশংসা করেছিলো। এমনিতে এই দম্পতি টিপটপ, মার্জিত, রুচিশীল পোশাক পরতে পছন্দ করতো। এই মুহূর্তে কেকা’র অবস্থা কথা বর্ণনা করা যাবেনা, কন্যা কুহু ও পুত্র আকাশ এই অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়ে অথৈ সমুদ্রে পড়লো, তা বলা বাহুল্য। মৃত্য’র পরদিন বুধবার ডঃ দ্বিজেন ভট্টাচার্য্য ও তাঁর পুরো পরিবার বিদ্যুতের স্ট্যাটন আইল্যান্ডের বাড়ী গিয়েছিলেন, সেই হৃদয় বিদারক দৃশ্যের কথা না-ই বা বললাম! বিদ্যুৎ দাসের মরদেহ স্ট্যাটন আইল্যান্ডের একটি ফিউনারেল হোমের দায়িত্বে রয়েছে, ১৫ই মে তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে।

বিদ্যুৎ দাস ‘আপনি আচরি ধর্ম’ নীতি মেনে সমাজে তাঁর সঠিক অবস্থানটি সৃষ্টি করে নিয়েছেন। বিদ্যুতের বাড়ী সন্দ্বীপ। পারিবারিক বা আকাশ-কুহু’র বন্ধু বিংহ্যাম্পটনের শিক্ষার্থী শিমুল বণিক বিদ্যুৎ দাস স্মরণে সামাজিক মাধ্যমে আমেরিকান ষ্টাইলে তাৎক্ষণিক একটি ফান্ড রেইজিং করছেন, ‘গোফান্ডমিডটকম’-এ গিয়ে আপনি শিমুলের সাথে একাত্মতা জানাতে পারেন, আমরা করেছি। বিদায় বন্ধু বিদায়, গুডবাই।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।