ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

সর্বগ্রাসী করোনা : সর্বাত্মক প্রতিরোধ

২০২০ এপ্রিল ২৬ ১৫:২১:৫৭
সর্বগ্রাসী করোনা : সর্বাত্মক প্রতিরোধ

রণেশ মৈত্র


করোনা তার সর্বোচ্চ ভয়াবহতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী মানব প্রজাতিকে আক্রমণ করতে শুরু করেছে আজ থেকে তিন মাসেরও বেশী আগে। এই সময়কালে, রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র মারাত্মকভাবে। কোন প্রতিরোধ প্রচেষ্টা এ যাবতকাল পর্য্যন্ত পৃথিবীর কোন আক্রান্ত দেশেই সফল হয় নি। সর্বত্র রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে প্রতিদিনই বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। কোথায় এর সমাপ্তি তা আজও জানা যাচ্ছে না।

বিস্ময়ে স্তম্ভিত হতে হয় যখন জানা যায়, নানাবিধ নিরাপত্তা ভেদ করে করোনা ভাইরাস গিয়ে আক্রমণ করে বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাশালী বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে, সৌদি রাজপরিাবরের ১৫০ জন সদস্যকে নানা দেশের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে, ডাক্তার-নার্সরাও কোন দেশেই আক্রমনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিক্রম নন। এগুলি দেখে আগামী দিনগুলিতে দেশে দেশে কী ঘটবে বা ঘটতে চলেছে তা ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়।

নানাদেশে বসবাসকারী আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব তো দূরের কথা, একই শহর বা গ্রামের একপাড়ার কেউ আক্রান্ত হলে ভিন্ন পাড়ার কেউ তাঁকে এক নজর দেখতে যেতেও পারছেন না।

মৃত্যু না হয় গতিকে স্তব্ধ করে দেয় কিন্তু আক্রান্ত রোগীকে দেখতে যাওয়া, তাঁর পরিবার পরিজনকে সান্তনা দেওয়া বা প্রয়োজনে ডাক্তার ডেকে এনে অথবা নিকটস্থ কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াও বন্ধ। নিজের জীবনকে বাঁচানোর জন্যে এই যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তাই যে শেষ বিচারে পরিবার, সমাজ ও দেশকে বাঁচাবে তার বৈজ্ঞানিক আবেদন অনেক সনাতনী বিশ্বাসের মূলেও আঘাত হেনেছে। ফলে সর্বত্র এক দুঃসহ অস্থিরতা। মানুষের কাছে তার সামাজিক জীবন অক্সিজেন তুল্য। সেই সমাজকে দূরে ঠেলে বাঁচা তাই দুঃসহ।

শুধু কি তাই? এক ছাদের নীচে বাস করলেও মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী বহুক্ষেত্রেই, অন্তত: রাতের বেলায়, নিরাপত্তাবোধ থেকে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে ঘুমাতে বাধ্য হচ্ছেন। দম্পতির একজন চিকিৎসক হলে অপরজনের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। মা যখন তাঁর সন্তানকে বড় আশা করে ডাক্তারী পড়িয়ে ডাক্তার বানিয়ে সুদিনের অপেক্ষায় আছেন তখন রাতে সন্তানটি হাসপাতাল থেকে বাড়ী ফিরছেন না দেখে উৎকণ্ঠিত চিত্তে সন্তানকে ফিরে আসতে টেলিফোন করলে সন্তান জবাব দিচ্ছে, “মা, তুমিই তো আমাকে কত কষ্ট করে ডাক্তার বানিয়েছ-এখন কি আমি রোগী ছেড়ে বাড়ী আসতে পারি? এখন তো নয়ই কখন যে বাসায় ফিরতে পারব তাও বলা যাবে না মা। কারণ করোনা রোগীর চিকিৎসার পর বাসায় যেতে দেবে না। হাসপাতালেই কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে দু’সপ্তাহ”। মায়ের চোখের জল বাঁধ মানেনা তবু সইতেই হচ্ছে এমন পরিস্থিতি সারা বিশ্বের হাজার হাজার মায়ের-হাজার হাজার স্ত্রীর।
দুটি মাত্র ওষুধ

এমন যে পীড়া, যাতে এক লাখের উপরেও ত্রিশ হাজার বা তার চাইতেও বেশী সংখ্যক মানুষ এযাবত মারা গেলেন আরও যাবেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু তা নিরাময় বা প্রতিরোধের কোন ওষুধই আজতক পৃথিবীর স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করতে পারেন নি যদিও ব্যাপক গবেষণা চলছে এবং সাফল্য মানুষের নিকটবর্তী হয়ে এসেছে বলে অনুমান করা হয়।

এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে বিজ্ঞানের আপাতত: পরামর্শ হলো ঘরে থাকুন, জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হবেন না। দ্বিতীয়ত: ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে এবং বারবার বাড়ীঘর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে। ফলে সাবান, হ্যা--ওয়াস, স্যানিটাইজার, ডেটল, ব্লিচিংপাউডার বাজারে দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে-দামও বেড়েছে কয়েক গুণ।

অপরপক্ষে, জীবনের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক ভালবাসা থেকে যে লক্ষ লক্ষ বাঙলাদেশি নরনারী স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী হয়ে আছেন বিগত তিনটি মাস ধরে তাঁদের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান।

প্রথমত: তাঁরা এক সড়হড়ঃড়হু তে ভুগছেন। সংবাদপত্র মফ:স্বলে আসে না তাই তা পাওয়াও যায় না। সময় কাটানোর বড় অবলম্বন সংবাদপত্রের সাক্ষাত নেই ২৬ মার্চ থেকে। তাই সময় কাটানোর একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলি। কিন্তু সেখানেও এক ঘেঁয়েমি। অসংখ্য চানেল কিন্তু করোনা সংক্রান্ত একই খবর দিবারাত্র প্রচার করে চলেছে তারা সবাই। কোন বৈচিত্র্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা নেই। কেউ কি চান অনবরত পৃথিবীর কোন দেশে কতজনের মৃত্যু ঘটলো এবং কতজন আক্রান্ত হলেন সেই বেদনাদায়ক খবর শুনতে? চ্যানেলগুলির এই একঘেঁয়ে খবর দিবারাত্র প্রচারের কারণে তাদের দর্শক সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু তারাই হতে পারতো দেশ বিদেশের কিছু ইতিবাচক সংবাদ ও নানাবিধ সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে এই বন্দীদশা পরিস্থিতিতে দর্শকদের মস্ত বড় অবলম্বন। বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের এখন বড্ড বেশী প্রয়োজন।

আমাদের তরুণদের একাংশ বাইরে বের হওয়ার সরকারি নিষেধাজ্ঞা মানতে চাইছে না। ঐ বয়সে আমাদেরকে যদি অভিভাবকেরা অনিনির্দিষ্টকালের জন্য ঘরে বসে থাকতে বলতেন কেমন লাগত আমাদের? কতটা মানতে পারতাম ঐ পরামর্শ? এটা সকলে উপলব্ধি করতে হবে। তাদের সামনে চলমান দিনগুলির চেহারা কেমন?

এক. তাদের স্কল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘকাল ধরে বন্ধ থাকায় কেউ লেখাপড়ার পরিবেশ বা আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছে না, খেলাধুলা বন্ধ, বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে তরুণ-তরুণীদের স্বভাবজাত আড্ডা নেই, পার্কে-ক্লাবে মেলামেশা-গল্প করার সুযোগ নেই, রেষ্টুরেন্ট, মিষ্টির দোকান সিনেমা হল সব বন্ধ। এ অবস্থায় তরুণ-তরুণীরা বাধ্য হয়েই অনেকটা বাইরে যায় নানা অজুহাত দেখিয়ে। তাদেরকে আকৃষ্ট করতে হবে নিজ নিজ বাড়ীতে থাকতে এবং সেজন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে ক্রীড়া ও বিনোদনমূলক কর্মকা-ের বিকল্প নেই। টিভি চ্যানেলগুলি এ জাতীয় মান ও রুচি সম্পন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন-নাটক দেখাতে পারেন-নৃত্য গীতের ভাল ভাল অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে পারেন তবে সরকার বা কারও ফরমায়েশ অনুযায়ী নয়।

টেলিভিশনে দেখি অসংখ্য বেকার তরুণ-তরুণীর ক্ষুধা ক্লিষ্ট চেহারা। সরকার কিছুটা সহযোগিতা করছেন ত্রাণ বিতরণের মাধ্যমে। কিন্তু সরকারি চাল-ডাল-তেল-লবণ-বিশেষ করে চালের বস্তা চলে যাচ্ছে দুর্নীতি বাজদের গুদামে। এই দুনীতিবাজদের অবস্থান সরকারি দলে। তাই ধরা পড়লেও উপযুক্ত শাস্তি তারা পাচ্ছে না। দল থেকে বহিস্কার এবং সাময়িক জেল বন্দী। ব্যস। কিছুদিন পর আবার স্বমূর্তিতে ফিরে আসা। যেন কানামাছি ভোঁ ভোঁ।
আমরা কখন প্রতিরোধে নামলাম?

ডিসেম্বর, ২০১৯ এ চীনের উহান প্রদেশে প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটলো এই রোগের। কিন্তু আমরা ডিসেম্বর দূরের কথা জানুয়ারিতেও নজর দিলাম না প্রস্তুতিও নিলাম না।

আমরা মাঠে নামলাম মার্চের শেষার্ধে করোনা প্রতিরোধের প্রত্যয় নিয়ে। এতদিন করোনা ইউরোপ, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়ায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ-কুয়েত সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের। তখনও রোগীর সংখ্যা হাতে গোনা। কিন্তু ঢাল নেই, তলোয়ার নেই-আমরা নিধিরাম সরদার। কোথায় প্রশিক্ষিত এবং নিবেদিত ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও ক্লিনিং কর্মী? এঁরা তো আগে কেউ করোনা দেখেন নি তাই কোন অভিজ্ঞতা বা শিক্ষার ভিত্তিতে চিকিৎসা শুরু হলো না হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কিছু পরামর্শের ভিত্তিতে। সেগুলি ভুল তা নয়। বরং পূরোপূরি ঠিক। কিন্তু তার জোগান? সমস্যাটা সেখানেই।

করোনাই হোক বা অন্য কোন রোগই হোক, সর্বাগ্রে প্রয়োজন তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার বৈজ্ঞানিক সুযোগ। টেষ্টিং কিটস্ নেই। সারা দেশে মাত্র একটি তাও ঢাকায়। সেটা দিয়েই শুরু। পরে ক্রয় ও নানাসূত্রে আরও কিছু কিটস্ পাওয়া গেল। এখন মাত্র ১৭ টা। তার দশটাই ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। অবশিষ্ট সাতটি বিভাগীয় শহরগুলিতে বসানো হলো। কিন্তু রোগ কমছে না। তাই আইন শৃংখলা বাহিনীকে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার দায়িত্ব পালনে মানবিক হয়েও কিছুটা কঠোরতা অবলম্বন ছাড়া উপায় নেই।
সরকারি প্রণোদনা

কয়েক দফায় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা ঘোষনা করেছেন। প্রথম দফায় গার্মেন্টস শিল্প যাতে মুখ থুবড়ে না পড়ে, শ্রমিকরা যাতে কারখানা চালু থাকুক বা না থাকুক নিয়মিত বেতন পান সে জন্য ৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষনা করেন শতকরা ২ ভাগ সুদে। কিন্তু এই টাকাকে সুদমুক্ত করার দাবী গার্মেন্টস মালিকদের এবং অফেরতযোগ্য করার আবদারও তাঁরা তুলেছেন। ফলে লক্ষ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিকের জীবন-জীবিকার পূর্ণ নিশ্চয়তা এখনও পাওয়া যাচ্ছে না।

অপরদিকে কৃষক সমাজের জন্য ঘোষিত প্রণোদনায় শতকরা ৫ ভাগ সুদ ধার্য্য করায় কৃষক সমাজ হতাশ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কৃষকেরা ফসল ফলান। অথচ সুদের হারের এই বৈষম্য সীমাহীন সংকটে ফেলবে কোটি কোটি কৃষক ক্ষেতমজুরদেরকে। বস্তুত: প্রকৃত উৎপাদক হলেন ক্ষেতমজুর বা কৃষি শ্রমিক। তাঁদের জন্য আজও কোন নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট আয়ের ব্যবস্থা না থাকায় বছরের ছয়মাস তাঁদেরক বেকার জীবন যাপন করতে হয়। বেকারত্ব দূর করে এঁদের জন্য স্বল্প মূল্যে রেশনিং ব্যবস্থা প্রবর্তন না করলে তাঁদের জীবনের সংকট কাটবে না। একই সাথে তাঁদের নিয়মিত উপার্জনও নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিতে যে প্রণোদনার কথা বলা হয়েছে তা সুদমুক্ত অথবা শতকরা দুই ভাগ সুদে দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সরকার কমিয়ে চার ভাগ করলেও তা যথেষ্ট বেশী।

অর্থনীতির সংকটে পড়েছে প্রায় সকল স্তরের মানুষ। পরিবহন পরিষেবা বন্ধ বহু দিন যাবত বন্ধ। এই সেক্টরের শ্রমিকদের নগদ আর্র্থিক সহায়তা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। বাস, ট্রাক, ট্রেন, নদীপথের যানবাহন রিকসা, ভ্যান স্কুটার সবাই বেকার। সংকট তাই অত্যন্ত গভীরে। ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব তবে দুনীতির মূলোৎপাটন একই সাথে করতে হবে। মধ্যম ও ছোট দোকানদার, কুলি কামিনের সংখ্যাও তো কম নয় এঁরা সবাই বেকার।

যে সকল ডাক্তার নার্স জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করবেন তাঁদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা অভিনন্দনযোগ্য।

যে দীর্ঘ মেয়াদী ও সর্বগ্রাসী সংকট দৃশ্যমান হয়ে উঠছে তা সরকারের একার পক্ষে যথাযথভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে একটি সর্বদলীয় দুর্যোগ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা। এতে নানা পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিদেরকেও সংশ্লিষ্ট করা প্রয়োজন। উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই নইলে চাটুকারেরা সব পন্ড করে দেবে।

সাংবাদিকেরা বিস্তর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছেন করোনা ও চলমান দূর্নীতি সংক্রান্ত ব্যাপারে। এই সকল কাজে তাঁদের ভূমিকা অব্যাহত রাখতে সংবাদপত্র শিল্প ও সাংবাদিকদের জন্যও বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করা জরুরী প্রয়োজন। তাঁরা মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।