ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় মে-জুনের বাঙালি জীবন

২০২০ মে ১৫ ১৮:২১:৫৬
উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় মে-জুনের বাঙালি জীবন

রণেশ মৈত্র


বিগত ২৬ মার্চ থেকে আজ ৩ মে পর্য্যন্ত বাড়ীতে একটিও সংবাদপত্র আসে না। হকারের সাথে সাক্ষাত নেই-যে হকার (নাম তার মনসুর) প্রতিদিন সকালে অন্তত: সাতটি সংবাদপত্র (ঢাকা থেকে প্রকাশিত) আমার বাসায় পৌঁছে আমার খবর ক্ষুধা মেটাতো এবং নতুন নতুন নিবন্ধ লেখার উপাদান জোগাতো। পত্রিকা ঢাকা থেকে আদৌ আসছে না-মনসুর এসে তা দিয়েও যায় না-লেখার উপাদান খবর থেকে নয় মস্তিস্ক থেকে এবং প্রধানত: ইন্টারনেটে এক ঝলক দেখা নানা সংবাদপত্রের শিরোনাম থেকেই সংগ্রহ করতে হয় ফলে তথ্য সমৃদ্ধ নিবন্ধ লেখার সুযোগ বড্ড বেশী কমে এসেছে।

নিবিষ্ট মনে লেখার পরিবেশ-পরিস্থিতিরও বড্ড বেশী অভাব বোধ করি আজ দু’মাস ব্যাপী স্বদেশ বিদেশে করোনা তা-ব দেখে। তাই লেখা শুরু হয়-শেষ হয় না। কারণ লেখা গতি তেমন একটা এগোয় না। ফলে, দু’মাস যাবতই লেখার সংখ্যা কমে এসেছে। বাইরে ঘোরাঘুরি করে স্বচক্ষে মানুষের অবস্থা দেখে যে লিখতে বসবো সে সুযোগও নেই। কারণ দু’টি মাস ধরেই রয়েছি গৃহ বন্দী। এর মধ্যে যদিও ৩/৪ দিন কাঁচাবাজারে গিয়েছি পছন্দমত মাছ-সবজী কিনতে কিন্তু তাতেও এতে বেশী মানুষে মানুষে দূরত্ব-ব্যবধান মানার চেষ্টা করতে হয় যে কারও সাথে দু’দ- সুখ দুঃখের কাহিনী বলার বা শুনার ভাবনাটাও যেন মনে দানা বাঁধছে না।

কিন্তু আজ ৩ মে সকালে ইন্টারনেটে পত্রিকাগুলি দেখতে নিয়েই আতংক-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বহুলাংশ বেড়ে গেল। দৈনিক সমকাল এবং দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে যুগপৎ প্রকাশিতখবরটি এই উৎকণ্ঠার ¯্রষ্টা। যে সীমিত সংখ্যক ঢাকা বাসী (ঢাকাতেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে হকাররা সংবাদপত্র বিলি করছেন না বা গ্রাহক-পাঠকেরা গৃহবন্দী থাকায় অসংখ্য সংবাদপত্রে ষ্টলও বন্ধ) এখনও সংবাদপত্র হাতে পান বা নিয়মিত পাঠ করেন তাঁরাও নিশ্চয়ই খবরটি পড়ে আমার মতই বা ততোধিক সংকিত: উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত।

দুটি পত্রিকারই একই খবর। মে মাসে বাংরাদেশে পঞ্চাশ হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখে গিয়ে পৌঁছাতে পারে।

বলা হয়েছে বাংলাদেশে মে মাসেই করোনা আক্রমনের পিক আওয়ার। জুনের মাঝামাঝি গিয়ে করোনা আক্রমণ কমতে শুরু করবে এবং মাস কয়েক আরও তা বিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণ করতে থাকবে তবে সংখ্যায় সেটা কম।

তা হলে কবে আমরা বলতে পারবো এবং নিশ্চিত হতে পারবো এই কথা ভেবে যে বাংলাদেশ এখনও থেকে পূরোপূরি করোনামুক্ত? এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বিশেষজ্ঞ “সমকাল” কে বলেছেন, যতদিন কার্য্যকর করোনা ভ্যাকসিন আবিস্কার হয়ে বাজারে না পাওয়া যাবে ততদিন করোনা সংক্রমণ কমবেশী চলতেই থাকবে এবং সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ করোনামুক্ত এমন কথা বলা যাবে না।

আমরা জানি, বাংলাদেশে কৃষিক্ষেত্রে খানিকটা ছাড়া আর কোন বিষয়ে গবেষণার বালাই নেই। করোনা ভ্যাকসিন তৈরীর গবেষণার তো প্রশ্নই ওঠে না কারণ বেহাল স্বাস্থ্য সেবা আয়োজনে এমন কোন রোগ বা তার ব্যাকসিনের মত ব্যয় বহুল গবেষক এবং উচ্চস্তরের গবেষক তৈরীতে রাষ্ট্র কোন উদ্যোগ এ যাবত নেয় নি।

জানা গেল, করোনা সংক্রান্ত দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্য্যালোচনার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দেশীয় বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাগনের এক বৈঠক সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই এ জাতীয় অভিমত প্রকাশ করা হয়। স্বাস্থ্য অধিফতরের কর্মকর্তারা গার্মেন্ট কারখানাগুলি খুলে দেওয়ার বিরোধিতা করেন কারণ মালিকরা যতই বলুন, কারখানার অভ্যন্তরে শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মত কোন ব্যবস্থাই নেই। তাঁদের মতে সমস্ত গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ রাখলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চরম ক্ষতি হওয়ার আশংকা এবং রফতানি আদেশ ব্যাপ্ত কারখানাগুলি খোলা রাখা প্রয়োজন হলেও রোগ বিস্তারের দিকে তাকালে সেগুলি খোলা রাখা অত্যন্ত বিপজ্জনক।

তাঁরা জানান, ইতোমধ্যেই একবার কারখানা খোলা আবার বন্ধ ঘোষণার ঘটনায় লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের ঢাকা আসা এবং ফেরত যাওয়ার ঘটনাতে অনেক ক্ষতি হয়েছে। সুতরাং সেই ক্ষতির পরে পুনরায় যাওয়া অধিকতর বিপর্য্যায় ডেকে আনতে পারে।

তাঁরা আরও বলেন, লক-ডাউন এখনই প্রত্যাহার বা শিথিল করাও ভয়ংকরভাবেই বিপজ্জনক বরং তা বাড়ানো এবং তার কঠোর প্ররেয়াগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন কারণ দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রায় সকল জেলায়ই, উপজেলা-ইউনিয়ান পর্য্যায় পর্য্যন্ত কিছু সংখ্যক মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সংক্রান্ত নিয়মনীতি মানছেন না। অপরদিকে করোনার আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে লক-ডাউন নীতিমালা কার্য্যকরভাবে প্রয়োগ করতে যতটুকু কঠোরতা প্রয়োজন-তা দ্রুতই করা প্রয়োজন।

আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে স্বাস্থ্য অধিফতরের কর্মকর্তারা জানান , প্রথম দিকে যখন সংক্রমণ নির্ধারণ করার ব্যবস্থা অত্যন্ত সীমিত ছিল তখন আক্রান্তের সংখ্যাও ছিল কম। কিন্তু ৩১ টি জায়গা থেকে (বিভাগীয় শহরগুলি সহ) করোনা টেষ্ট করা শুরুর পর থেকেই জানা যাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সংখ্যা। তাঁরা মনে করেন সকল জেলা উপজেলায় সংক্রমণ পরীক্ষার ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন এবং তা করলে সংখ্যা যে আরও বড় তা ধরা পড়বে বলে মনে করার সঙ্গত যুক্তি আছে। সুতরাং মানুষের মৃত্যুর ও করোনা আক্রান্ত রোগীর মিছিল ঠেকাতে হলে যে করেই হোক, প্রাথমিকভাবে সকল জেলা সদরে অবিলম্বে করোনা পরীক্ষার এবং চিকিৎসার হাসপাতাল ও আইসোলেশনের জন্য উপযুক্ত সংখ্যায় এবং সানসম্মত ওয়ার্ড চালু করা অতীব জরুরী প্রয়োজন প্রতিটি চিন্তশীল মানুষ মনে করেন দলমত নির্বিশেষে।

আজ পর্য্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমরা হারিয়েছি বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স,স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ ও পুলিশ কর্মকর্তা। যদিও মোট মৃত্যুর সংখ্যা আজ ৩ মে অবধি সরকার স্বীকৃত ও প্রচারিত সংখ্যা ১৭৭। ব্যাপকভাবে টেষ্টিং ব্যবস্থা করা হলে এই সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে যাবে বলেই সকলের অনুমান। পূর্বেই জানা গেছে এখন অবধি মাত্র ৩১ টি স্থানে টেষ্টিং ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে সিলেট, ময়মনসিংহ, বগুড়া ও রংপুরে এই ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়েছে।

অর্থাৎ এখনও ৫৫টি জেলায় আদৌ কোন টেষ্টিং ব্যবস্থা নেই। তা হলে এসব জেলায় যাদের করোনাক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হয় তাদের টেষ্টিং ব্যবস্থা? সে সব জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নিকটস্থবিভাগীয় শহরে পাঠান হয় কিন্তু ফলাফল জানতে ১১/১২ দিন লেগে যাচ্ছে। সনাক্ত করণের এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষ না হতেই অনেককে মৃত্যু বরণ করতে হচ্ছে করোনাক্রান্ত হয়ে যদিও তখনও তা সনাক্ত হয় নি। মৃত্যুর পর জানা যাচ্ছে তাঁর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর।

এই প্রক্রিয়া অমানুষিক। অবিলম্বে তাই ৬৪ টি জেলার সব কটিতে অন্তত: একটি করে করোনা পরীক্ষাগার স্থাপন করা হোক। বড় বড় উপজেলাগুলিতেও।

আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সকল দুর্বলাত, ঘাটতি, দুর্নীতি প্রভৃতি করোনা ভাইরাসের দৌলতে সবার নজরে উলঙ্গভাবে প্রকাশ পেল। দুর্নীতির হাত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সমস্ত সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালকে মুক্ত করা সর্বাধিক জরুরী। আর এ কাজ করতে গিয়ে কোন রাঘব বোয়ালকেই যেন রেহাই দেওয়া না হয়।

যতই সম্পদ স্বল্পতা থাকুক, দৃঢ়তা এবং সাহজসিকতার সঙ্গে অবলিম্বে আরও অন্ত: ২০ টি ১০০০ বেডের বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাল স্থাপন, ডাক্তারী ও নার্সিং শিক্ষার কলেজ দ্বিগুণ করণ, অবলিম্বে কমপক্ষে ১০,০০০ হাজার ও ২০,০০০ হাজার নার্স ও ৫০,০০০ স্বাস্থ্যকর্মীকে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।

পুলিশ বিভাগ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ঝুঁকিযুক্ত কর্তব্যরত পুলিশ ও পুলিশ কর্মকর্থাকে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম দিয়ে নিশ্চিন্তে ডিউটি করার সুযোগ করা এবং প্রতি বিবাগ একটি করে উন্নতমানের পুলিশ হাসপাতাল স্থাপন করা হোক।

রোগটি পৃথিবীময় ছড়িয়েছে যেমন সত্য, তেমনই যারা যত দূরত্ব রক্ষা, পানাহারে বেপরোয়া থেকেছেন, সময়োচিতভাবে করোনামুক্ত রাখতে সচেষ্ট হন নি তারাই তত বেশী সংখ্যায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর শিকারে পরিণত হয়েছেন।

আবার এর বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক কিউবা, ভিয়েতনাম ও কমিউনিষ্ট শাসিত এবং কমিউনিষ্ট প্রভাবিত দেশ ও রাজ্যগুলিতে করোনা আক্রমণ হলেও অত্যন্ত কম এবং মৃত্যু প্রায় শূণ্যের কোঠায় দেখে তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। হেলথ ইনসিওরেন্স সকল নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক করা এবং বৈজ্ঞানিক শিক্ষা স্নাতকোত্তর পর্য্যায় পর্য্যন্ত সকল নাগরিকের জন্য ফি করা হোক। ধর্ম শিক্ষাকে ব্যক্তিগত এবং গৃহ শিক্ষার পর্যায়ে আনা হোক।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।