ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

স্যালিউট জর্জ ফ্রয়েড 

২০২০ জুন ১৫ ১৬:৩৯:২৭
স্যালিউট জর্জ ফ্রয়েড 

রণেশ মৈত্র


গোটা বিশ্বকে আলোড়িত করলো ২৫ মে ২০২০। সেদিন অবাক হয়ে শত শত কোটি মানুষ দেখলেন শত সহস্র বছরব্যাপী মার্কিন দেশে সযতনে লালিত বর্ণবাদ কী ভয়াবহ রূপ নিয়েই না আত্মপ্রকাশ করতে পারলো এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে।

সেদিন মানুষ চকিত চিত্তে নিজ নিজ কানে শুনতে পেলেন একটি কোনদিন না শুনা চিৎকার “আই কান্ট ব্রিদলে” কষ্টটি এ যুগের এক তরুণ মার্কিনী জর্জ ফ্লয়েডের।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার করোনা দমনে ব্যর্থ হলেও কৃষ্ণ বর্ণের জর্জ ফ্রয়েডকে দমনে নৃশংস বর্বর অত্যাচার চালিয়ে জর্জ ফ্রয়েডকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করতে শ্বেতাঙ্গ অহমিকা পূরণ করতে ঠিকই সক্ষম হয়েছিল। সাদা মানুষের নয় বর্ণবাদী শ্বেতবর্ণের ট্রাম্প প্রশাসনের এক পুলিশ যে নারকীয় অত্যাচার চালিয়ে জর্জ ফ্রয়েডকে বেমালুম হত্যাকা- চালাতে পারলেও বিজয়ের হাসিটি হাসার সুযোগ পায়নি।

মুহুর্তেই খবরটি ছড়িয়ে পড়লো সমগ্র মার্কিন মুল্লুকে গোটা বিশ্বের বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে পড়লো। প্রতিরোধের শক্তিগুলি একাট্টা হয়ে নেমে এলেন রাজপথগুলিতে। মিছিলের পর মিছিল কঠোরতম ভাষায় নিন্দা ও প্রতিবাদ ধ্বনিত করতে। নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যে, শহরে, ইউরোপ, আফ্রিকা এশিয়া জুড়ে মানুষের মিছিল অবিরাম আজও চলছে।

সিএনএন-এ লাইভ দেখলাম সেদিন জর্জ ফ্রয়েডের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। কী বিপুল জমায়েত সবার বুকে লেখা ব্ল্যাক ম্যাটারস কৃষ্ণবর্ণের মানুষেরাই কি শুধু মিছিলে ছিলেন? না, বিপুল সংখ্যক শ্বেতাঙ্গ নারী পুরুষও। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে মানবিক আচরণ, মানবাধিকারের ও বর্ণবৈষম্যের চির অবসানের দাবিতে বিশাল ঐ জমায়েতটি ছিল মুখরিত। অথচ সেখানে তো শুধুই জর্জ ফ্রয়েডকে শেষ স্যালিউটটি জানানোই তো হওয়ার কথা ছিল সেদিন।

বস্তুত: কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী নির্যাতন তো নতুন কিন্তু নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ভাইরাসটি পৃথিবীর দেশে দেশে ঠাঁই করে নিয়েছে যেন এটাই কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসী, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভাগ্যলিপি।

হাজারো মৃত্যু, লাখো ত্রন্দন, কোটি কোটি চোখের অশ্রু বহুকাল পূর্ব থেকে সম্ভবত: ফিউডাল যুগ থেকে আজ পর্যন্ত। মানুষে মানুষে সমানাধিকার আজও সর্বত্রই ধরা-ছোয়ার বাইরে রয়ে গেছে। ফিউডাল যুগের সমাপ্তি ঘটেছে, পুঁজিবাদের (তুলনামূলকভাবে অবশ্যই আধুনিক ও প্রগতিশীল) বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে। আইন আদালত চালু হয়েছে কিন্তু বর্ণবাদ, ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন, নির্যাতন রয়েই গেছে দিন দিন তা বাড়ছে বরং।

সেই যে দাসপ্রথার যুগ কবেই না অবসান ঘটেছে দাসযুগের প্রবল আন্দোলনও তীব্র জনমতের চাপে। কিন্তু ক্রীতদাস প্রথা প্রথা নানারূপে, নানা ঢং এ আজও যেন সর্বত্র বিরাজমান। ফিউডাল যুগ এলো-দাসযুগের চাইতে আধুনিক ও প্রগতিশীল। কিন্তু ঐ প্রতিক্রিয়াশীল পরিপূর্ণ অবসান আকাংখিত হলেও তা ঘটেনি। ঘটতেও দেওয়া হয়নি।
এলো পুঁজিবাদ। আজও তা দাপটের সাথে তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। পুঁজিবাদকে তো নিশ্চিত ভাবেই দাসযুগ ফিউডাল যুগের চাইতে প্রগতিশীল।

পুঁজিবাদ গণতন্ত্রের কথা বলে, মানবাধিকারের কথা বলে, ন্যায় বিচারের কথা বলে। সেই পুঁজিবাদী বিশ্বের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার গণতন্ত্র, সেখানকার মানবাধিকার, ন্যায় বিচার, আইনের শাসন-এই মোহনীয় কথাগুলি কিন্তু অর্থহীণ শব্দ সমষ্টি মান? বাস্তব চিত্র পুঁজিবাদী বিশ্বের সর্বত্রই আলাদা। জনমতের সঠিক প্রতিফলন কোথাও নেই। প্রতিফলন যে নেই তা এই তো সেদিন দেখিয়ে দিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে আইনের তোয়াক্কা না করে শ্বেতাঙ্গ এক পুলিশ কর্মকর্তা মিথ্যা অজুহাতে অকথ্য হামলা করে জর্জ ফ্রয়েডের কোমরের হাত ভেঙ্গে দিল এবং পরিণতিতে ফ্রয়েডকে মৃত্যুবরণ করতে হলো। শ্বসরোধ করে এমন করুণ মৃত্যু ঠেকলো না, “আই কান্ট ব্রিদ”-বলে ফ্রয়েডের কণ্ঠে উচ্চারিত আকুল আর্তির করুণ চিৎকার।

ফলে গোটা সচেতন বিশ্ব এই নির্মম ঘটনার প্রতিবাদে মিছিলের পর মিছিল করে মার্কিনী মিছিলকারীদের সাথে সংহতি জানিয়ে একদিকে যেমন বলছেন “ব্লাক লাইফ ম্যাটারস” তেমনি তাঁরা উচ্চকণ্ঠে “উই কান্ট ব্রিদ” বা “আমাদের শ্বাস ও রুদ্ধ হয়ে এসেছে।” এমন উচ্চারণ আজ গোটা বিশ্বের। সেখানে কি শ্বেতাঙ্গ, কি কৃষ্ণাঙ্গ, কি নারী, কি পুরুষ, কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি বৌদ্ধ, কি খৃষ্টান, কি সমতলের, কি পাহাড়ের আদিবাসী সব একাকার। সবাই পরষ্পর পরষ্পরের হাত মিলিয়ে সোচ্চার কণ্ঠে স্লোগানগুলি তুলছেন। একই ধরণের ঘটনা ঘটতে দেখি পাকিস্তানে যেখানে নির্মম নির্যাতন করে ৯৯ ভাগ হিন্দু শূণ্য করা হয়েছে, অসংখ্য হিন্দু নারী অপহরণ ও ধর্ষণ করা হয়েছে। হাজার হাজার হিন্দু নর-নারীকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়েছে।

ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি আমলে এসে তাদের রাজত্বের প্রথমদিকে দেশটিরে গৌরবোজ্জ্বল অতীতের ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে অসংখ্য মুসলমানকে ধর্মান্তরিত করা হয়, গো-মাংসের ভক্ষণের বা সংরক্ষণের অভিযোগে অনেক মুসলমানকে হত্যা অথবা নির্যাতন করা হয়। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও মুসলিম রোগীরা বৈষম্যের শিকান হন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। যার কোনো অস্বীকৃতি রাষ্ট্রীয় কোনো মহল থেকে করতে করতে দেখা যায়নি। তদুপরি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে বহু মুসলিম নাগরিকের নাগরিকত্ব হরণের অপচেষ্টাও চলছে।

বাংলাদেশের দিকে তাকালে সেখানেও কোনো ভিন্ন চিত্র চোখে পড়ে না। পাকিস্তান আমল তো গোটাটাই ছিল উগ্র সাম্প্রদায়িতকতার নগ্ন আচরণে পূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশেও বিজয়ের পর ৩/৪ বছর যেতে না যেতেই শুরু হতে থাকে সাম্প্রদায়িকতার উগ্র বহিঃপ্রকাশ। ধারাবাহিকভাবে অবাধে চলছে হিন্দুবাড়ি ব্যবসাস্থল দখল, আবাদী জমি জবরদখল, অগ্নিসংযোগ, দেশত্যাগে বাধ্যকরণ, হত্যা-ধর্ষণ প্রভৃতি। কোনো বিচার নেই, কোনো অপরাধীর শাস্তি নেই।
অনেক ঘটা করে যে পাবর্ত্য শান্তি চুক্তি করা হয়েছিল পাহাড়ী আদিবাসীদের সাথে আজ থেকে প্রায় ২৩ বছর আগে তার পূর্ণ বাস্তবায়ন আজও হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় আজও যেন সামরিক প্রভুত্ব চলছে। কল্পনা চাকমার হদিস আজও মিলছে না। নিখিল তো মাত্র সেদিন পুলিশের হাতে তাস খেলার অভিযোগে বে-আইনি কি?) পিঠের হাড় ভেঙ্গে দিয়ে হত্যা করা হলো। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে অনেক বাহানার (আপোষ প্রভৃতি) পর গ্রেফতার করা হলেও নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তাঁর কারাবাস সাময়িক মামলাও হারিয়েছে সাথে অসংখ্য অনুরূপ হামলার মত।

চলছে করোনার মহামারী পৃথিবীব্যাপি মুত্যুর মিছিল। তবুও থামে কি বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত নিপীড়ন, নির্যাতন বহু আগেই এক.........? বৈশি^ক চরিত্র ধারণ করেছে।

আবার এই করোনা মহামারীকে কেন্দ্র করেই চলছে মারাত্মক মেরুকরণ প্রক্রিয়া। শ্রমিকদের হাজার হাজারে চাকরিচ্যুতি, নতুন নতুন বেকারের সৃষ্টি দেশে বিপজ্জনক ও আতংকজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেও রাষ্ট্র কর্তৃক তা উপেক্ষিত। একদিকে হাসপাতাল, বেড-ডাক্তার-নাস, স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসা উপকরণ, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর প্রভৃতির নিদারুণ অভাব অপরদিকে করোনায় মৃত্যুজনিত কারণে লক্ষ লক্ষ মায়ের বুক খালি হওয়া এক শ^াসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে একটি বাজেট প্রস্তাবনা হাজির করা হয়েছে কয়েক লক্ষ কোটি টাকার। কিন্তু স্বাস্থ্যখাত, বেকারত্ব দূরীকরণ, করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ সকল .........? রোগী, চিকিৎসক, পুলিশ, সাংবাদিক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী এবং নতুন নতুন হাসপাতাল নির্মাণ, চিকিৎসক নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়নি স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দে। নামমাত্র বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হলেও তাদের ন্যুনতম প্রয়োজন মেটানোর ধারেকাছেও যাওয়া যাবে না।

এই যতগুলি বিপদ, অনাচার, অত্যাচার, শোষণের বিবরণ হাজির করা হলো তা ঘটনাবলীর বিবেচনায় অত্যন্ত কম। কিন্তু এগুলির হাত থেকে মানুষকে রক্ষা পেতে হবে। তার পথ কি?

সহজেই যে উত্তর অনেকেই দিয়ে থাকেন তা হচ্ছে সরকার বদল চাই। কিন্তু সরকার বদল তো বহুবার ঘটেছে সমস্যাবলীর সমাধান কেউ করেছে কি?

মূল কথা হলো, বদলাতে হবে ব্যবস্থা। গণ-বিরোধী ব্যবস্থার স্থলে আনতে হবে গণ-মুখী ব্যবস্থার। ধনীবান্ধব ব্যবস্থার বদলে আনতে হবে দরিদ্রবান্ধব ব্যবস্থা যার মাধ্যমে দারিদ্রের চির অবসান ঘটানো যায়। বদলাতে হবে শোষণ নির্ভর ব্যবস্থা আনতে হবে শোষণমুক্তির ব্যবস্থা। বদলাতে হবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। আনতে হবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থা সমাজকে সাম্যের পথে অগ্রসর করে নেবে। বৈষম্যমূলক, নিপীড়ন, নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে মানুষের বৈষম্যহীণ সামাজিক সাম্যভিত্তিক মানবিক ব্যবস্থা।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটেছে বিগত শতকের শেষ দশকে এই সাময়িক বিপর্যয় থেকে নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে যে ব্যবস্থাকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা পুন:প্রতিষ্ঠার জন্য আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে বিজয়ের প্রত্যয় নিয়ে আন্দোলনে নামার বিকল্প নেই।

এখনো কিউবা, ভিয়েতনাম, নেপাল, কেরালা প্রভৃতি দেশ ও প্রদেশে সমাজতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় থেকে বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে তারা করোনা উচ্ছেদে সক্ষম। তারা সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে একটি শোষণমুক্ত, সর্বজনীন সমাজব্যবস্থা গড়তে সক্ষম। সক্ষম সবার জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, চাকরি বা বেকারত্বের অবদানকে সুনিশ্চিত করে সকলের বাসযোগ্য একটি সুন্দর, সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে।

জর্জ ফ্রয়েড, বিপ্লবী সালাম। জীবন দিয়ে ব্যবস্থা বদলের চিন্তা জাগানোর জন্য। পৃথিবী জাগছে তোমার হত্যার নিষ্ঠুরতায় সচেতন হয়ে।

লেখক :সভাপতিম-লীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।