ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

শুধুই ‘কঠোর’ আর ‘সীমিত’-কান ঝালাপালা

২০২০ জুন ১৮ ১৭:০০:৫২
শুধুই ‘কঠোর’ আর ‘সীমিত’-কান ঝালাপালা

রণেশ মৈত্র


প্রাণঘাতী করোনা আক্রমণ বাংলাদেশে সুরু হলো মার্চের প্রথম দিকে। চীন থেকে শুরু করে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ তার অনেক আগে থেকেই ঐ ভাইরাসের আক্রমণের শিকার হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, তাঁর মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর দিব্যি নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকলেন। ভাবখানা এই যে বাংলাদেশের কিছুই হবে না। কিন্তু আমাদের মত সাধারণ মানুষদের মনে আগে থেকেই আতংক দানা বাঁধছিলো।

কোন কোন হুজুর বললেন, চীন নাস্তিকদের দেশ। মুসলমানদেরকে করোনা আক্রমণ করতে পারবে না। জানি না স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং গোটা স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় ঐ হুজুরদের বানীতে প্রবাবিত হয়ে, তাতে আস্থা স্থাপন করে চুপ করে রইলেন নাকি তাঁর অভ্যাস বশতই তিনি গোটা মন্ত্রণালয় নিয়ে ঘুমিয়ে রইলেন।

সংক্রমণ শুরু হলো। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হুঁশিয়ারী মোতাবেক ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে “সাধারণ ছুটি” ঘোষণা করা হলো। তাদেরই নির্দেশনা অনুযায়ী সকলকে ঘরে থাকতে “অনুরোধ” জানান হলো। দেশব্যাপী সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হলো। কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকান ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দোকান ছাড়া সব রকমের দোকান পাট, বাণিজ্য কেন্দ্র বন্ধ, মাস্ক পরা, হ্যা-গ্লাভস পরা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, হ্যা-ওয়াশ, স্যানিটাইজার প্রবৃতি ব্যবহার করা, স্যালন জাতীয় পদার্থ দিয়ে বাড়ীর সকল মেঝে ও উঠান জীবাণুমুক্ত করার নির্দেশাবলী টেলিভিশন ও সংবাদপত্র মারফত জনগণকে জানানো হলো-সকল প্রকার পরিবহন, বিমান-নৌ-রেল-সড়ক বন্ধ ঘোষণা করা হলো।

এগুলি পালিত হচ্ছে কি না অথবা পালিত না হলে কি করা হবে-তা রইলো অস্পষ্ট। অপরদিকে সংক্রমণ প্রতিরোধের ও সংক্রমণ যাচাই এর ন্যূনতম উদ্যোগ ও তৎপরতা রয়ে গেলো সবার কাছেই অজানা।

পরিণতিতে কিছু সংখ্যক মানুষ নিজস্ব সচেতনতা দিয়ে ঘরে থাকলেন আর কিছু মানুষ এগুলি মানলেন না। যাঁরা মানলেন না তাঁদের একটি বড় অংশের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার, বারংবার সাবান জলে হাত ধোয়া বা মাস্ক প্রভৃতি কিনবার সামর্থ্য ছিল না আর উপার্জনের জন্যও তাঁদের অনেককে বাইরে যেতে বাধ্য হতে হতো।
কিন্তু এগুলির কোন মনিটরিং নেই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরে থেকে বিষয়গুলি তত্ত্বাবধানের ন্যূনতম উদ্যোগ নেই।

রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলো। বিদেশ থেকে অনেক যাত্রী ঢাকা বিমানবন্দরে নামতে থাকলেন। আমাদের একটিমাত্র আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। সেটাই আগমন-নির্গমণের একমাত্র পথ। কিন্তু সেখানে করোনার টেষ্টিং কিটের ভয়াবহ স্বল্পতা-বিদেশ ফেরত সকলকে কোয়ারান্টাইনে বা আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা বা উদ্যোগ নেই। কেন নেই তারও কোন প্রকার জবাবদিহিতা নেই। পরিণতি স্বরূপ যা হওয়ার তা-ই হলো। ঐ বিদেশাগতদের থেকেই ঢাকাতে সংক্রমণ শুরু হলো। প্রথমে ২/১ জন করে কিন্তু এপ্রিল পার হতে না হতেই সংক্রমিত ও মৃতের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকলো।

এতেও কোন উদ্বেগ প্রকাশ না করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী দিব্যি প্রকাশ্যে বলেন, আমেরিকা-ইউরোপের চাইতে বাংলাদেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম। যেন তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন।

সংক্রমিত হলেন প্রথমে সাধারণ মানুষ। রোগটি মারত্মক রকমের ছোঁয়াচে হওয়াতে এবং উপযুক্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীরাও আক্রান্ত হতে থাকলেন। ডাক্তারদের কেউ কেউ মারা যেতে লাগলেন। পরিস্থিতি দুষ্টে ডাক্তারদের কোন একটি সংগঠন করোনা রোগীর চিকিৎসা চিকিৎসকেরা করবেন না বলে বসেন। হুশিয়ারী এলো করোনা রোগীদের চিকিৎসা না করলে চাকুরী থাকবে না। কাউকে কাউকে সাময়িকভাবে চকুরীচ্যুত করা হলো।

ক্ষুব্ধ চিকিৎসকেরা জানালেন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হাসপাতাল, যথেষ্ট সংখ্যক মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই সরবরাহ না করা হলে নিশ্চিত মৃত্যুর পথে তাঁরা যেতে রাজী নন। অবশেষে সকল মহলের দাবীর প্রেক্ষিতে এই স্বাস্থ্য সুরক্ষার সরঞ্জামগুলি আনা হলো অনেকে কিনে এনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বা কোন কোন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিতরণ করলেন। একটি সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হলো।

কিন্তু আসলে যাদের জন্য এতো আয়োজন সেই রোগীদের চিকিৎসা? সাধারণ রোগীদের কথা বাদ দিলেও ভেন্টিলেটর, আই সি ইউ,বেড প্রভৃতি? দেখা যাচ্ছে নানা বিমিডয়ায় খবর বেরোচ্ছে হাসপাতালগুলিতে যেমন একদিকে শয্যা সংখ্যা অত্যন্ত কম, তেমনি আবার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষিত বেড, ভেন্টিলেটর, আই সি ইউ প্রভৃতির সংখ্যা মারতহ্মকভাবে সীমিত থাকায় বহু রোগী উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে চরম অসহায় অবস্থায় মৃত্যু বরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

পৃথিবীতে এমন কোন দেশ আছে বলে আমার জানা নেই যেখানে কোন রোগী একের পর এক হাসপাতালে দিনের পর দিন ঘোরাঘুরি করে কোন রকমেই ভর্তি হতে না পারায় সম্পূর্ণ বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বরণ করছেন। হাসপাতালগুলি সরকারি হাসপাতালগুলি সহ যেন জবাবদিহিতার উর্ধে। সবাই রাজা-যে যা খুশি করে যাচ্ছেন।

আবার করোনায় আক্রান্ত কি না তা পরীক্ষার জন্য হাজার হাজার মানষ নানা জায়গায় লাইন দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে অনেক ক্ষেত্রে চরম হতাশা নিয়ে ফেরত যাচ্ছেন। যারা নমুনা দিতে পারছেন-সেই ভাগ্যবানেরাও দিনের পর দিন অপেক্ষা করে চলেছেন পরীক্ষার ফলাফল জানতে। এমনও ঘটছে রোগীর মৃত্যু ঘটলো বিকেলে সন্ধ্যায় এসে হাজির হলো রিপোর্ট যাতে দেখা গেল তাঁর করোনা পজিটিভ। এই রিপোর্ট যদি তাৎক্ষণিক পাওয়া যেত তবে হয়ত রোগীর চিকিৎসা করে তাঁকে বাঁচিয়ে তোলা যেত।

কেন এমনটি হচ্ছে? আসলে পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক কিটস্ এর যেমন অভাব তেমনই আবার নমুনা পরীক্ষার ল্যাবও প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কম। তাছাড়া দেশের বহু স্থানে আজও কোন ল্যাব প্রতিষ্ঠিত হয় নি। যার ফলে নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলি অন্যত্র পাঠাতে হচ্ছে পরীক্ষার জন্যে। এ কারণেও ফলাফল জানতে বহু ক্ষেত্রেই অনেক দেরী হচ্ছে।

কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে নমুনা পরীক্ষার কিটস্ ও ল্যাব সংগ্রহ করা কি অসম্ভব? নিশ্চয়ই তা নয়। হ্যাঁ, অর্থের প্রয়োজন। যদি সরকারের হাতে এগুলি বাবদ প্রয়েঅজনীয় পরিমাণ অর্থ না থাকে তাবে দেশ বিদেশ থেকে প্রয়োজনে ঋণ নিয়েও সে ব্যবস্থা করা উচিত এমন কথা সবাই বলবেন। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ সকল ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্বিকার। আর সেটা যে চরম দায়িত্বহীনতার বহি:প্রকাশ তা-ও তাঁদের চিন্তায় নেই।

এত কিছুর পরও দেখা যায় সরকারি নির্দেশনা, নানাবিধ সিদ্ধান্ত হামেশাই গ্রহণ করে জানানো হচ্ছে যে সরকার এগুলি বাস্তবায়নে ‘কঠোর’ মনোভাব গ্রহণ করেছে এবং যারাই এই নির্দেশনাবলী মানবে না তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।

কিন্তু বাস্তবে আদৌ কোন ‘কঠোরতা’ দেখা গেল কি? বাইরে বিশেষ প্রয়োজনে, অর্থাৎ কাঁচা বাজার ও ওষুধের দোকান ছাড়া বাইরে যাওয়া ‘কঠোরভাবে নিষিদ্ধ’ বলা হয়েছিল। কিন্তু বাজার বা ওষুধ কেনার উদ্দেশ্যেই কেউ বাইরে গেল-না কি আড্ডার উদ্দেশ্যে গেল তা নির্ধারণের কোন চেষ্টাই করা হয় নি। আবার ঐ কাজের জন্য কতটুকু সময় বাইরে থাকা যাবে তা-ও বলা হয় নি। তার বেশী বাইরে থাকলে কদাপি কাউকে সে অপরাধে শাস্তি দেওয়া হয় নি। মাস্ক পরা বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক হলেও তা আজও অনেকেই মানছেন না। এসব ব্যাপারে, সাধারণ মানুষকে দোষ দিয়ে সরকারের দায়িত্ব ভুলে যাওয়া যাবে না।

কারণ এই কঠোরতাহীন ঢিলেঢালা ভাব থাকার ফলেই নির্দেশনাগুলি অমান্য করা সম্ভব হয়েছে এবং তার পরিণতিতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। শীঘ্রই সংক্রমণের সংখ্যা এক লক্ষে এবং মৃত্যুর সংখ্যা দেড় হাজারে পৌঁছতে চলেছি আমরা আর সেখানেই যে বূদ্ধি পাওয়ার গতি থেকে যাবে তা-ও বিগত ১৭ জুন দৈনিক সমকালে প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবর প্রকাশ করেছে “জুলাই মাসে আক্রান্ত ছাড়াবে দুই লাখ”। আতংকজনক এই খবরটি আসলে একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের অভিমত।

এমন আসংকা যদি সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে সেই সংখ্যক রোগীর জন্য হাসপাতাল, বেড, অপরাপর সরঞ্জাম, ডাক্তার নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী কোথায় পাওয়া যাবে। দুই লক্ষ হোক, তার সিকি সংখ্যক রোগীকেও তো রাখার জায়গা জুটবে না দেশের সকল হাসপাতাল মিলিরেয়ও।

এমন ভয়াবহ অবস্থা কেন হবে? চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সকল নাগরিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার। এ প্রসঙ্গের সাথে জড়িত রয়েছে অপরাপর রোগের আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার সুযোগও।

সরকারের দায়িত্বছিল, দেশের বিপুল জনসংখ্যার কথা মাথায় রেখে সে অনুযায়ী আধুনিক বিপুল সংখ্যক হাসপাতাল গড়ে তোলা। করোনা আর যাই করুক এই প্রয়োজনীয়তার দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এবং আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতাকেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

একটি বাজেট পেশ করা হয়েছে সংসদে। সংসদ অধিবেশনে সকল সদস্য যোগদান এবং বাজেট আলোচনায় অংশ নিতে পারছেন না করোনায় আক্রান্ত হয়ে। কেউ কেউ মৃত্যু বরণ করেছেন। ৪০ জনকে বয়স ও স্বাস্থ্যগত কারণে অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানান হয়েছে। পরিস্থিতির ভয়াবহ চিত্র এটি।

এখন পরিত্রানের পথ সম্পর্কে সরকারের সর্বশেষে ভাবনায় দেখা যাচ্ছে, সারা দেশের নানা অঞ্চলকে তিনটি জোনে বিভক্ত করা হবে রেড, ইয়োলো এবং গ্রীন জোন হিসেবে। এ কথা প্রায় এক সপ্তাহ যাবত সরকারি মহল থেকে বলা হচ্ছে কিন্তু কোন কোন এলাকা রেড, ইয়োলে বা গ্রীন জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হবে তা সাত সাতটি দিনের মধ্যেই চিহ্নিত করা যায় নি (নাকি করা হয় নি?)। কবে যে চিহ্নিত হবে, কবে তা কার্য্যকর হবে এবং তার ফল কতটা মহামারী ঠেকাতে সক্ষম হবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।

বলা হচ্ছে রেড জোন লক ডাউন করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হবে এবং সকল সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি “কঠোরভাবে” কার্য্যকর করা হবে। ইয়োলো ও গ্রীন জোনে সাধারণ ছুটি থাকবে না তবে সব কিছু “সীমিত ভাবে” চলবে।

প্রশ্নের বস্তুত: কঠোর এবং সীমিত শব্দ দুটি বাস্তবে কার্য্যকর হবে না কি অতীতের মতই ঢিলেঢালাভাবে সকল কিছু চলবে এবং ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যুও বাড়তেই থাকবে।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।