ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

আমি মুক্তিযোদ্ধা বলছি-২

অস্ত্র-গোলাবারুদসহ মুক্তিযোদ্ধার বেশে দেশে প্রবেশ

২০২০ জুন ১৯ ১৯:২৭:০১
অস্ত্র-গোলাবারুদসহ মুক্তিযোদ্ধার বেশে দেশে প্রবেশ

আবীর আহাদ


১৫ জুলাই । ১৯৭১ । কলকাতা থেকে আমি যখন টাকীস্থ ৯ নং সেক্টর হেড কোয়ার্টারে পৌঁছি তখন রাত ন'টা । আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত আমার আত্মীয় ক্যাপ্টেন খুরশীদকে সঙ্গে করে আমি মেজর জলিলের সাথে দেখা করি । তাঁকে শেখ আবু নাসের ও আলীমুজ্জামানের সালাম জানাতেই তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে আমার সাথে কথা বলেন । প্রবল রাশভারি ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেজর জলিলের ঝাঁকড়া চুল ও দাড়ি-গোফের বাহারি চেহারা দেখে তাঁকে আমার কিউবা বিপ্লবের অন্যতম নায়ক মেজর চে'গুয়েভারার মতো মনে হচ্ছিল । তিনি বেশ প্রাণবন্ত ।

কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন যে, প্রধানমন্ত্রী আমাদের গোপালগঞ্জ ভারি অস্ত্রশস্ত্র পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছেন । মনে মনে বলি, এটা তো আমারই যোগাযোগের ফল । মেজর জলিল বলেন, গোপালগঞ্জের ওপর হানাদার বাহিনীর শ্যেনদৃষ্টি বেশি, যেহেতু ওটা বঙ্গবন্ধুর এলাকা । তাদের মোকাবিলা করার লক্ষ্যেই প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ । ভারি অস্ত্রশস্ত্রের চালান আসছে । আগামীকাল সকাল নাগাদ সেগুলো বেগুন্দিয়া ইণ্ডাকশন ক্যাম্পে পৌঁছবে । তুমি আজ রাতেই বেগুন্দিয়া চলে যাও ।

রাতের খানা শেষ করে টাকীতে অবস্থানকারী আমার সহযোদ্ধা সিরাজ-উল হক, সৈয়দ আহমদুজ্জামান, আবদুল হান্নান, কাওসার নাসিম, শাহাবুদ্দিন জনু, কাবুল হোসেন, ফরিদ আহমদ, আলমগীর হোসেনসহ ১০/১২ জন পায়ে হেঁটে বেগুন্দিয়ার উদ্দেশ্য রওনা হই । টাকী থেকে যার দূরত্ব কমপক্ষে চার মাইল । বৃষ্টির মধ্যেই আমরা হাঁটতে থাকি ।

পরদি ১৬ জুলাই । সকাল ন'টায় ইণ্ডাকশন ক্যাম্পের ইনচার্জ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ক্যাপ্টেন সুলতানউদ্দিন আহমদ আমাকে ও সৈয়দ আহমদুজ্জামানকে ডাকলেন । সেখানে গিয়ে দেখি, ক্যাপ্টেন খুরশীদ ও ক্যাপ্টেন নূর মোহাম্মদ বাবুলও অবস্থান করছেন । জানতে পারলাম ক্যাপ্টেন খুরশীদ সকাল বেলা ট্রাকে করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছেন । আজ রাত আমাদের তিনটি গ্রুপকে দেশে পাঠানো হবে ।

আমার, আহমদ জামান ও মতিয়ার রহমান খোকনের নেতৃত্বে পৃথকভাবে কাশিয়ানী, আলফাভাঙ্গা ও লোহাগড়া থানার ২৫-২০-১৫ জনের তিনটি গ্রুপকে দেশে পাঠানোর আয়োজন শুরু হলো । আমি তিন ক্যাপ্টেনকে জানিয়ে দেই যে, কাশিয়ানী থানার ভাটিয়াপাড়ায় যেহেতু হানাদারদেরবড়ো ধরনের শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে গেড়ে বসেছে এবং যেহেতু আমাদের এই তিন থানার সংযোগ স্থলে ঐ ভাটিয়াপাড়া----সেহেতু আমাদের চাহিদা মোতাবেক অস্ত্রশস্ত্র দিতে হবে । বার বার তো গোলাবারুদের জন্য এতো দূর আসা সম্ভব নয়, ইত্যাদি ।

মতিয়ার রহমান খোকনকে খবর দিতেই সেও আমার ও জামানের সাথে যোগ দেয় । আমরা তিনজন মিলে আমাদের যোদ্ধাদের নামের তালিকাসহ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের চাহিদাপত্র তৈরি করতে বসে যাই । আমরা জানি যে, আমাদের চাহিদা মোতাবেক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ পাবো না, তারপরও দাবি করতে তো দোষ নেই । আমার নেতৃত্বে যোদ্ধাদের তালিকা নিম্নরূপ-----

সি-ইন-সি স্পেশাল (ভারত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) গ্রুপ কমান্ড,
থানা/উপজেলা : কাশিয়ানী
মহকুমা : গোপালগঞ্জ,
জেলা : ফরিদপুর ।

কমাণ্ডার
আবীর আহাদ (পারুলিয়া)

2. ডেপুটি কমাণ্ডার : হাবিলদার আবদুস সোবহান, মৃত, (ডোমরাকান্দী)
3. সদস্য : পুলিশ কনস্টেবল আবদুল মালেক, মৃত, (হরিদাশপুর)
4. সদস্য : মো: শাহাবুদ্দিন আহমদ জনু, (পোনা), 31 অক্টোবর ফুকরা রণাঙ্গনে শহীদ
5. মো: কাওসার নাসিম (পোনা)
6. মো:আবদুর রাজ্জাক (খয়েরহাট)
7. মো:আকমল হোসেন (গোয়ালগ্রাম)
8.মো: কাবুল হোসেন (গোয়ালগ্রাম)
9. মো: হাসমত আলী (তারাইল)
10. মো: সিরাজুল ইসলাম (সাধুহাটি)
11. মো: জিন্নাত আলী (গেড়াখোলা)
12. মো: আবদুল খালেক (রাজৈর, মাদারীপুর)
13. মো: ফরিদ আহমদ (ফুকরা)
14. মো: রবিউল ইসলাম, (ফুকরা), 31 অক্টোবর ফুকরা রণাঙ্গনে শহীদ
15. মো: বাদশা মিয়া (ফুকরা)
16. মো: সুলতান আহমদ (ফুকরা)
17. মো: সাহেব আলী (ফুকরা)
18. মো: ইয়াসিন আলী (ফুকরা)
19. মো: আবুল কাশেম (নাওরা ভাদুলিয়া)
20. বাদশাহ মিয়া (সাহেবের চর)

বাকি পাঁচ জনের নাম এ মুহূর্তে মনে নেই । তবে তাদের নাম পরবর্তীতে সংযোজন সংযোজন করা হবে ।

আমাদের চাহিদাপত্র গ্রহণ করে ক্যাপ্টেন সুলতান বলেন, মেজর জলিল সন্ধ্যার পর এখানে এলে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে । ভাটিয়াপাড়ায় যেহেতু হানাদার বড়ো ধরনের একটা ঘাঁটি রয়েছে তখন সে-নিরিখেই অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হবে । তোমরা বিশ্রামে থাকো । আজ রাতেই তোমাদের পালা ।

১৭ জুলাই । রাতের খানা শেষে আমরা এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে বসে কেউ কেউ গল্প করছি । কেউ কেউ বিড়ি সিগারেট টানছি । এমন সময় একটা জীপ এসে দাঁড়ায় প্রাইমারি স্কুল প্রাঙ্গনে । জীপ থেকে মেজর জলিল নামলেন ।

ক্যাপ্টেন সুলতানের বাশির ডাকে আমরা তিনটি গ্রুপ তিন লাইনে দাঁড়াই । মেজর জলিল আমাদের সামনে এসে একটা চেয়ারে বসলেন । অতঃপর আমাদের উদ্দেশ্য একটি বক্তব্য দিলেন যার সারমর্ম হলো : নবম সেক্টরের বিশেষত্ব এই যে, এটি বলা চলে টোটালি গণবাহিনীনির্ভর সেক্টর । এখানে অল্প কিছুসংখ্যক নিয়মিত বাহিনীর সদস্য থাকলেও গণবাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গড় উঠেছে এখনকার সৈনিক কাঠামো ।-----মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃতির অর্থে এই বাহিনীর একটি রাজনৈতিক দর্শন রয়েছে, সেটি হলো আমরা একটি জনগণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে সাধারণ মানুষের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে চাই । আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ কোনো সামরিক যুদ্ধ নয়, জনগণের সমন্বিত বাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত হবে । আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু । তাঁর নির্দেশিত গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে একটি শোষণহীন সমাজ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই আমাদের লক্ষ্য ।-----আমরা মহান কার্ল মার্কস ও মহামতি লেনিনের সাম্যবাদী বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারায় বাংলাদেশকে পরিচালিত করার লক্ষ্যে এ মুক্তিযুদ্ধ করছি ।-----

মেজর জলিলের বক্তব্য কে কীভাবে নিলো জানি না, তবে মার্কসবাদী চিন্তার একজন ক্ষুদে ছাত্র হিশেবে আমার কাছে মনে হলো তিনি একটা অতিবিপ্লবী চেতনায় আচ্ছন্ন । ফলে চলমান মুক্তিযুদ্ধকে চীন বা কিউবান বিপ্লবের মতো করে তিনি একটু অগ্রিম চিন্তাচেতনায় ডুবে আছেন । আমার কাছে চলমান মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতির আলোকে বাস্তবসম্মত মনে হলো না । কারণ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে হঠিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে । সমাজ বিপ্লব এখানে অনুপস্থিত । কারণ আওয়ামী লীগ ও ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে জনগণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কথা চিন্তা করছে না । দু'টি দলই পাঁতি বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী দল । তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের লক্ষ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর ভারতের লক্ষ্য বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাকিস্তানকে শায়েস্তা করা । ভারতের কী লক্ষ্য তা আমাদের চিন্তা করার দরকার নেই, আমাদের লক্ষ্য তার সহযোগিতা নিয়ে স্বাধীনতা অর্জন ।-----আওয়ামী লীগ ও ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনায় একটি মিল আছে বলেই দল দু'টি এক মোহনায় এসে দাঁড়িয়েছে । তাদের উভয়ের উদ্দেশ্য: স্বাধীন বাংলাদেশ । এর বাইরে আর কোনো দার্শনিক চিন্তা আপাতত: তাদের মধ্যে নেই । এ-স্তরে মেজর জলিলের চিন্তা একটি আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয় ।

মেজর জলিলের বক্তব্যের মধ্যে একবারের জন্যও মুজিবনগর সরকারের ভূমিকাও ভারতের সহযোগিতার শোনা গেলো না ! তখন বুঝতে বাকি রইলো না যে, মেজর জলিল আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেসের বাইরে একটি অতিবিপ্লবী চেতনা নিয়ে আগাচ্ছেন । তবে জয়বাংলা শ্লোগান ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর বিপুল আবেগ রয়েছে । আমার একবার মনে হয়েছিল তাঁর অতিবিপ্লবী চেতনা সম্পর্কে দু'টি কথা বলি, কিন্তু পরক্ষণেই ভেবে বসি যে, আমরা এখানে কোনো রাজনৈতিক দীক্ষা নিতে আসিনি । আমাদের লক্ষ্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দ্রুত দেশে প্রবেশ করে যার যার এলাকায় গমন ।

আমরা মোটামুটি আমাদের চাহিদার কাছাকাছি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করতে সক্ষম হলাম । আমাদের পথের হাত খরচ বাবদ প্রত্যেককে পাকিস্তানি পঁচাত্তর টাকা দেয়া হলো । রাত দশটার দিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের দু'টি বাস এলো । দেশে ফেরার প্রবল বাঁধভাঙা আবেগে দ্রুত বাসে চড়ে বসি । গাইড হিশেবে দু'জন বিডিআর সদস্য আমাদের সাথে চললো । বাস স্টার্ট দিতেই আমরা জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ও জয়হিন্দ শ্লোগান দেই । আর তখনি আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া শুরু হলো । মনে মনে খুশি হলাম যে, বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে সীমান্তে আমরা নিরাপদ থাকবো । কারণ বৃষ্টি ও ঝড় পাকিদের শত্রু । ঝড় আর বৃষ্টির তারা তাদের ঘাঁটিতে পড়ে থাকবে, আর আমরা অনায়াসেই সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যাবো । তাছাড়া আমরা সীমান্ত এলাকায় বা পারতপক্ষে চলতিপথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবো না, আমরা আমাদের এলাকায় যেতে চাই ।

গাইড হাবিলদার শওকত ও আমি বাসের ড্রাইভারের পাশে বসা । বাসচালক বিএসএফের একজন সদস্য । তিনি বাঙালি । নাম সুরেশ ভদ্র । বৃষ্টিজনিত কাদামাটির পথ দিয়ে ধীর গতিতে আমরা এগিয়ে চলেছি যেখান থেকে আমরা বাংলাদেশের মাটিতে প্রবেশ করবো সেই দিকে । কয়েক মিনিটের মধ্যেই গাইড ও ড্রাইভারের সাথে পরিচিত হলাম । আমি তাদের দু'জনকে ডায়মণ্ড সিগারেট অফার করি । কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে ।

আমরা কোন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকবো ?' আমিই গাইড শওকতকে জিজ্ঞেস করি ।
কুষ্টিয়া জেলার মহেশপুর ও যশোরের চৌগাছা থানার মধ্যবর্তী বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের সংযুক্ত ভূমিতে আমাদের নামিয়ে দেয়া হবে বলে শওকত জানান ।

আমি দ্রুত বলি, বাগদা-মান্দারতলা কি ?
-----না না । তারও মাইল দশেক উত্তরে । পথটি শুকনা ও নিরাপদ ।
------আপনারা কতো ভেতরে আমাদের এগিয়ে দিয়ে আসবেন ?
------আপনারা কি আগে মান্দারতলা দিয়ে এসেছিলেন ?
-------হ্যাঁ ।
চৌগাছা থানার সেই বিশাল বটবাগানের কথা মনে আছে ? ঐ পর্যন্ত আমরা আপনাদের পৌঁছে দেবো ।
------ঠিক আছে । বাকি পথ আমরা চিনে নেবো । আমি বলি ।
তখনও চলছে ঝড়বৃষ্টির মাতামাতি । মেঠোপথ ছেড়ে ফাঁকা পাকা সড়ক দিয়ে আমাদের বাসও উল্কার বেগে ছুটে চলেছে । আমার মানসপটে তখন ভেসে উঠছে আমার গ্রামবাংলা ও আপনজনদের মুখ । আজ তিন মাস পর দেশে ফিরে যাচ্ছি । আপনজনদের কে কেমন আছে কিছুই জানি না । তারপরও দৃপ্তমনে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার বেশে দেশে ফিরে যাচ্ছি । আমার হাতে দু'টি অস্ত্র । একটি মডিফায়েড এসএলআর, আরেকটি বারো বোর রিভলবার-----। আমরা সবাই সশস্ত্র । একেকজনের কাঁধে হাতে কোমরে বাঁধা কমপক্ষে ত্রিশ/পঁয়ত্রিশ কেজি ওজনের বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ।
বৃষ্টিজনিত শীতল আবেশে ক্লান্ত শরীর বোধ হয় গভীর শ্রান্তির মধ্যে ডুবে গিয়েছিল ।
নির্দিষ্ট স্থানে বাস থামতেই ঘুম ভেঙে যায় । রাত তিনটা । তখনও টিপ টিপ ও মৃদু দমকা হাওয়ার বৃষ্টি-ঝড় চলছে ।
আমরা দ্রুত বাস থেকে নেমে বিএসএফ বাসচালককে শেষ শুভেচ্ছা জানাই । জড়ো হই একটা বিরাট মাদার গাছতলায় । এখানে বিএসএফের লোকেরা নিরবে আমাদের গার্ড অব অনার প্রদান করেন । গাইডদ্বয় প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশ দিয়ে পথ চলা শুরু করে । আমরা লাইনবদ্ধ তাদের অনুসরণ করি ।

পায়েচলা প্রশস্ত মেঠো বালিপথ । তবে অন্ধকারে পথ চলতে বেগ পেতে হচ্ছে । তার ওপর সবার কাছে বিপুল ওজনের অস্ত্রশস্ত্র । ক্রমেই বোঝা ভারি হয়ে আসছে । তবু পথ চলার বিরাম নেই । রাতের অন্ধকারে সীমান্ত অতিক্রম করে অনেক দূরে চলে যেতে হবে । তখনও আমরা ভারতের মাটিতে ।

প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটার পর আমাদের গাইডরা জনমানবহীন জঙ্গলবহুল একস্থানে থামতে নির্দেশ দেয় ।
গাইড শওকত ফিসফিস করে বললো, আমরা এখন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছি । একথা শোনার সাথে সাথে আমরা সবাই আবেগপ্রবণ হয়ে উঠি । কেউ কেউ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে । আমারও বুক ফেটে বিপুল কান্না বেরিয়ে এলো । পরক্ষণে নিচু হয়ে একমুঠো মাটি তুলে কপালে ও নাকে ঠেকাই । এই তো আমার চিরচেনা বাংলাদেশের মাটির সোঁদা গন্ধ । আর তখনি আমার মনের তন্ত্রীতে রবিসুর ভেসে ওঠে :

ও আমার দেশের মাটি-----
তোমার 'পরে ঠেকাই মাথা ।
তোমাতে বিশ্বময়ী,
তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা-----

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।