ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

পর্যবেক্ষনে ভারত-চীন সীমান্ত বিতর্ক

২০২০ জুন ২৮ ১৫:৫৮:২৪
পর্যবেক্ষনে ভারত-চীন সীমান্ত বিতর্ক

রহিম আব্দুর রহিম


১৯৭৫’র পর এবছর ১৫ জুন চীন ও ভারতের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় গাল ওয়ান উপত্যকার নিয়ন্ত্রন রেখা সংলগ্ন এলাকায়। এই সংঘর্ষে ভারতের ২০ জন সেনা নিহত হয়েছে। চীনের কত সেনা হতাহত হয়েছে,তা স্পষ্ট করেনি চীন। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ, চীনের প্রায় ৪৫ জন সৈনিক হতাহত। এই ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস উভয় পক্ষকে সবোর্চ্চ সংযম প্রদর্শনের আহবান জানান। সমস্যা সমাধানে ১৬ জুন মঙ্গলবার, চীন-ভারতের কর্মকর্তারা গালওয়ানে বৈঠক করেন। সমাধান হয়নি। আবারও বৈঠক বসে ১৮ জুন বৃহস্পতিবার, ফলাফল শূণ্য।

কারণ, চীনের দাবী গোটা গালওয়ান উপত্যক তাদের,এখান থেকে তাদের সৈন্য তারা সরাতে নারাজ। অপর দিকে ১৭ জুন বুধবার, উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ফোনে কথা বলেছেন। সেখানে ‘সার্বিক পরিস্থিতি দায়িত্বের সঙ্গে মোকাবেলা করতে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছেন।’ এখানে ‘দায়িত্বের সঙ্গে’ শব্দটি ব্যবহারেই প্রমাণ হয় এবারের সংঘর্ষের ঘটনাটি অপ্রত্যাশিত। গত ৬ জুন সিনিয়র কমান্ডার পর্যায়ের উভয় দেশের সেনাদের সাথে এক সমঝোতা বৈঠক হয়। ওই দিনের সমঝোতা যথাযথ বাস্তবায়নে উভয় পক্ষ সম্মত হলেও,চীন পক্ষ তা রক্ষা করেনি। এই ‘রক্ষা’ ‘না রক্ষার’ বিষয়টি ঘিরে অপ্রতাশিত ঠুনকো থেকে বিষয়টি বিরাট আকার ধারণ করেছে।

এই ঘটনায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইকে বলেছেন,‘‘গালওয়ান উপত্যকার ‘অপ্রত্যাশিত’ ঘটনা ভারত-চীন সম্পর্কে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। চীনের পূর্ব পরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের কারনে গত সোমবার,সীমান্ত সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে এবং এর দায় সরাসরি চীনের সেনা বাহিনীর ওপর বর্তায়।” তিনি চীনের কর্মকান্ড শুধরে নেওয়ার ওপর জোরও দেন। এর পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এক বিবৃতিতে জানায়,“দ্রুত পরিস্থিতি শান্ত করতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে।” চীন এবং ভারতের পরস্পর বাদ-প্রতিবাদে স্পষ্ট হয়, ঘটনাটি কোন ভাবেই যুদ্ধাবস্থার মত নয়। ‘যুদ্ধনীতি’ অনুযায়ী ‘যুদ্ধবিরতি বা কোন সমঝোতার পর কোন পক্ষের সৈনিক তা না মেনে বিতর্কিত কিছু কওে, তবে তা নিজ দেশের ঊর্দ্ধতনদের কাছে শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। চীন-ভারত সীমান্ত বিতর্ক হাজার বছর ধরে চলতে পারে,বারবার হতেই পারে। তাই বলে অপ্রত্যাশিত ঘটনা বারবার ঘটে যাওয়া দু:খ জনক।

উল্লেখ, ১৯৬৬ সালে ভারত-চীনের শর্ত অনুযায়ী সীমান্ত অঞ্চলে আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহার নিষিদ্ধ। ওই দিনের ঘটনায় উভয় পক্ষের সৈনিকরা এই শর্ত যথাযথ মেনেই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে করে প্রমাণ হয়, বিষয়টি সীমান্তের উভয় পক্ষের সৈনিকদের ঠান্ডা মাথায় হয়েছে; ফলে ‘পরিকল্পিত’ শব্দটিকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভারত-চীন দুটি দেশই পারমানবিক শক্তিধর। যে কারনে উভয় দেশ ঘটনা বা বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই এগুবে এটাই নিশ্চিত। অস্ত্র আছে বলেই তার ব্যবহার করতে হব্ েএটা যেমন সভ্যতায় গ্রহণ যোগ্য নয়, তেমনি ‘অপ্রত্যাশিত’ ঘটনায় ‘পরিকল্পিত’ বিষয় জেগে ওঠাও ঠিক নয়। এবারের ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষ ঘিরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদী এক বিবৃতিতে বলেন,“ভারত সেনা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। যেনো তারা ভারতের সীমান্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে।”

তবে লাদাখে প্রয়োজনে অস্ত্র প্রয়োগের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন ভারত সরকার। নরেন্দ্রমোদী আরও বলেন, “চীনের পদক্ষেপে পুরো ভারত আহত ও ক্ষুব্ধ। ভারত শান্তি ও বন্ধুত্বের পক্ষে; কিন্তু সার্বভৌমত্ব ধরে রাখা সর্বাগ্রে।’ নরেন্দ্র মোদীর এই বক্তব্য অত্যন্ত শালিন, গ্রহণযোগ্য এবং তাঁর দেশাত্ববোধের প্রতিছবি। পৃথিবীর সকল মানচিত্র খচিত, রাষ্ট্র প্রধানরা সার্বভৌমত্ব ধরে রাখতে একই ভূমিকা রাখবেন। সব কিছু মিলে লাদাখ বা গালওয়াল উপত্যকসহ ভারত-চীন সীমান্তের পুরো এলাকায় তিন বাহিনীকেই কড়া অবস্থানে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। চীনও তাদের বাহিনীদের কড়া অবস্থানে থাকার নির্দেশ দিতেই পারেন, যা তাদের সার্বভৌমত্বের পরিচয়। তবে কোন ভাবেই ভারত-চীন এর মধ্যে ফের কোন সংঘর্ষ হোক, অস্ত্রের ঝনঝনানি চলুক,গুলি ফুটুক এমনটি কাম্য নয়। পরম সভ্যতার এই যুগে শান্তির জন্য ‘সমঝোতা’য় সর্বশ্রেষ্ঠ। এক্ষেত্রে কোন প্রতিবেশি দেশ কোন পক্ষকে উসকানী দিয়ে স্বার্থ আদায় করার সুযোগ নেওয়া যৌক্তিক নয়, তেমনি ভারত-চীন সীমান্ত বিতর্ক ঘিরে চীন এবং ভারত তাদের প্রতিবেশি কোন দেশকে বাঁকা চোখে দেখাও যৌক্তিক নয়।

নেপালের সাথে ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক ঢিলেঢালা। বর্তমান পরিস্থিতে নেপালকে চীন উসকানি দিচ্ছে, এমন ধারনা ভারতের। ‘উসকানি’ বা ‘সুযোগ গ্রহণ’ তা বিশ্লেষণযোগ্য। তবে নেপাল যে, ভারতীয় এলাকা অন্তর্ভুক্ত করে নেপালের মানচিত্র প্রকাশ করেছে; শুধুমাত্র নেপালে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিগদের জন্য তারা তাদের নাগরিক আইন সংশোধন করেছেন এটা স্পষ্ট। যার সবগুলোই আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করছে। কেননা, আকসাই চীনে সেনা প্রবেশ করেছে, চলছে লাদাখে গন্ডগোল, পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্কের বৈরিতা অনেক আগের, জম্মু-কাশ্মির ঘিরে যা আরও প্রবল আকার ধারণ করেছে। এখনো কাশ্মিরে চলছে ‘গুপ্তহত্যা’ বা জঙ্গী হমলার মত ঘটনা। সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মিরের অনন্তনাগে ২৬ জুন বেলা বারো টায় সেনা বাহিনীর টহল গাড়িতে হামলা হয়েছে। এতে এক জন সৈনিক মারা গেছেন। ওই ঘটনায় পথচলা বারো বছর বয়স্ক এক শিশু গুলির আঘাতে নিহত হয়েছে। যার সবকিছুই অমানবিক।

কোন ‘গুপ্তহত্যা’ ‘জঙ্গী সত্রাস’ যেমন কোন জাতি গোষ্ঠীকে বিজয় বা মুক্ত করেনা; তেমনি কোন গোষ্ঠীকে দমাতে নিরীহ কাউকে হত্যা মানবতায় সমর্থন করে না। পর্যবেক্ষণ, চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত বিরোধ,ভারতের সাথে নেপালের সীমান্ত বিতকের্র মধ্যে উজানের অভিন্ন পানি বন্ধ করে দিয়েছে ভুটান। ১৯৫৩ সাল থেকে কৃত্রিম ভাবে তৈয়ার করা চ্যানেল (আঞ্চলিক ভাষায় ডং) দিয়ে ভুটান হতে প্রবাহিত পানির মাধ্যমে চাষাবাদ করে আসছে ভারত-আসামের বাকসা জেলার ২৬ টি গ্রামের কৃষকরা। যা এই মুহূর্তে বন্ধ করে দিয়েছে ভুটান। এতে করে ২৬ টি গ্রামের প্রায় ৫০ হাজার কৃষক পরিবার এখন শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। এর প্রতিবাদে ‘কালিপুর-যোগাজুলি-কালানদী’ আঞ্চলিক ডং বাঁধ সমিতির ব্যানারে জেলার কয়েক’শ কৃষক ও নাগরিক সমাজের সদস্যরা বিক্ষোভ করেছেন। এই মুহূর্তে এসব কি হচ্ছে!

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভারত-চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বহু পুরনো, দুদেশের আলাদা রাজ্যের বিভক্তি থাকলেও ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ব্যবসায়িক আদান প্রদানের গভীরতা ছিলো প্রবল। ভারতের বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা সময়ের ব্যবধানে ভারত থেকে চীনে পাড়ি জমান। ওই সময় (বিহারের বৌদ্ধ প-িত বিক্রম শীল) বাংলার অতীশ দীপঙ্কর তিববতে বৌদ্ধ দর্শন প্রচার করেন। চীনা ব্যবসায়িরা এক সময় সিল্ক রোড হয়ে হিমালয় পার হয়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অবাধে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। ভারত-বাংলার বন্দর হয়ে চীনা পণ্য বিভিন্ন দেশেও যেতো। আবার ভারতের ব্যবসায়ীরা একই ভাবে চীনে ভারতীয় পণ্য বিক্রি করতো। সেই মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ ভারত হয়ে চীনের সাথে ব্যবসায়ীক ও সকল সংস্কৃতিক সম্পর্কের শক্তিশালি ভীত গড়ে ওঠে। ১৮২৬ সালে ব্রিটেন-বর্মা যুদ্ধে ব্রিটেন জয় লাভ করে। ফলে মনিপুর ও আসাম বৃটিশ ভারতের অন্তর ভূক্ত হয়, যেকারণে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সীমানা বর্মা ও চীন পযর্ন্ত বিস্তৃত হয়।

ভারত চীন সীমান্তের পূর্বপ্রান্তে অরুনাচল প্রদেশ। চীনের সাথে ভারতের অরুনাচলের এই সীমানা ‘ম্যাকমাইন লাইন’ নামে পরিচিত। ১৮২৬ থেকে ১৯১৩ সাল, দীর্ঘ ৮৭ বছর পর ১৯১৩ সালে ব্রিটেন চীন ও তিববতের প্রতিনিধিরা ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, তিববত ও চীনের মধ্যকার সীমানা স্থির করার জন্য এক সভায় মিলিত হন। যে সভাটি ওই সময় সিমলায় হয়েছিল। ব্রিটিশ জেনারেল এবং কুটনীতিক হেনরী ম্যাকমাইন সীমানা নির্ধারণ করে যে প্রস্তাব চূড়ান্ত করেন, তাতে উপস্থিত তিন দেশের প্রতিনিধিরা সই করেন। পরে চীন এই প্রস্তাবকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। ওই সময় চীনের বক্তব্য ছিল, ‘তিববত চীনের স্বয়ং শাসিত একটি অংশ। কাজেই তিববত প্রতিনিধির এই ধরনের চুক্তি সই করার কোন অধিকার ছিলোনা।’ তবে ব্রিটিশরা তাদের ম্যাপে এই ম্যাকমাইন লাইন ব্যবহার করা শুরু করে ১৯৩০ সালের পর থেকে।

৪০৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ভারত চীন সীমান্তের পশ্চিম ভাগে রয়েছে লাদাখ এবং আকসাই চীন। যেখানকার সীমানা আজোবধি চিহ্নিত হয়নি। ফলে লাদাখের সীমান্ত ঘিড়ে দুই দেশের মধ্যেকার সাম্প্রতিক এই সংঘর্ষ এই অঞ্চলের ভারত চীন সীমান্ত ‘লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ বলে অভিহিত যার ইতিহাস চমকপ্রদ। ১৮৪১-৪২ সালে শিখ রাজ্যের অধীন জম্মুর ডোগরা রাজা গুলাব সিং লাদাখ জয় করেন। তিনি তিবতের সাথে ১৮৪২ সালে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন কিন্তু তাতে কোন নির্দিষ্ট সীমানা চিহ্নিত ছিল না। শুধু চুক্তিতে ছিলো, উভয় পক্ষ পুরনো সীমান্ত মেনে চলবে। এদিকে ১৮৪৭ সালে ব্রিটিশ ও শিখদের মধ্যে সংগঠিত যুদ্ধে ব্রিটিশরা জয়ী হয়। ফলে জম্মু-কাশ্মির এবং লাদাখ শিখদের হাত ছাড়া হয়। তবে গুলাব সিং কে ব্রিটিশরা ‘মহারাজা’ বলে মানতে রাজি হয়।

এরপর ব্রিটিশরা চীনা আধিকারদের সঙ্গে সীমানা চিহ্নিত করে কিন্তু চীন কোন আগ্রহ দেখায় নি। এর পর ১৯৪৭, ১৯৪৯,১৯৫০,১৯৬০,১৯৬২ পেরিয়ে ২০২০ এর ১৫ জুন। ভারত-বাংলাদেশ দীর্ঘ ৬৭ বছর পর তাদের সীমান্তের জটিলতা নিরসন করে ৫৫ হাজার মানুষের রাষ্ট্রীয় অধিকার নিশ্চিত করে বিশ্ব মানবতায় স্থান পাওয়ার মত মহান কাজটি করতে পারলে,চীন-ভারত ৮৭ বছরের সীমান্ত জটিলতার নিরসনের মাইলফলক সৃষ্টি করতে কেন পারবেনা?

লেখক : শিক্ষক, গবেষক, নাট্যকার ও শিশু সংগঠক।