ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » জাতীয় » বিস্তারিত

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ও বাংলাদেশের আদিবাসী

২০২০ আগস্ট ০৯ ০২:৫৬:১২
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ও বাংলাদেশের আদিবাসী

সজীব কিসকু : ৯ই আগষ্ট, আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের এই বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, 'কোভিড-১৯ মহামারিতে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম', যা বর্তমানে খুবই প্রাসঙ্গিক। জীবন ধারণের জন্য শুধুমাত্র কোভিড-১৯ এ নয় প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলেছে বাংলাদেশের আদিবাসীরা। মহামারির মারাত্মক প্রভাব পুরো বিশ্বের সাথে সাথে আদিবাসীদের ওপরও পড়েছে। আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক অস্বীকৃতির রাষ্ট্রে শুধু কোভিড-১৯ এ না সেটা অহরহ আদিবাসীদের ওপর পরিচালিত অন্যায় নির্যাতন, উচ্ছেদ, জবর দখল, অগ্নিসংযোগ, হত্যাকাণ্ড, বঞ্চনা, বৈষম্য মহামারির রূপ ধারণ করেছে। প্রকৃতির বরপুত্র আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত প্রকৃতি-পরিবেশ, বন-জঙ্গল রক্ষা করে গেলেও সেখান থেকে তাদেরকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ, বিতাড়িত করা হচ্ছে। যার দরুণপ্রভাব প্রকৃতি- পরিবেশের ওপর পড়ছে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. পল এপ্সটিন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগসংক্রমণ বিষয়ক এক গবেষণায় বলেছেন, "মানুষই তার প্রকৃতি -পরিবেশকে বসবাসের অযোগ্য করেছে তাদের অবিমৃষ্য ক্রিয়াকলাপের দ্বারা।" কোভিড-১৯ মহামারিতে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার সংগ্রামেও কিন্তু আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও অন্যান্য অধিকারের প্রশ্নগুলো এড়ানো যাবে না। করোনা মহামারিতেও আদিবাসীরা বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জীবন-জীবিকা অতিবাহিত করছে। এই সংগ্রাম যেন থেমে থাকার সংগ্রাম নয়। এই সংগ্রাম অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রাম, সমতলে আলাদা পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের সংগ্রাম, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম, ভাষা রক্ষার সংগ্রাম, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য রক্ষার সংগ্রাম। আদিবাসীদের ভূমি দখল, উচ্ছেদের মত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। করোনাকালীন সময়েও সেটা বন্ধ থাকেনি। বিভিন্ন অনলাইন নিউজে সেগুলো উঠে এসেছে বারবার। কিছু শিরোনামগুলো তুলে ধরা হল, 'আর কত উচ্ছেদ হবে ভূমিপুত্ররা।' ১৬ জুন আমাদের সময়, 'তানোরে আদিবাসী পল্লীর পুকুর দখলের অভিযোগ', ১৪ জুন সোনালী সংবাদ, 'বান্দরবানে উচ্ছেদ আতঙ্কে চাক আদিবাসী', ২৪ জুলাই জনজাতির কণ্ঠ, 'নওগাঁয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শতাব্দীপ্রাচীণ শশ্মাণ জবর দখলের চেষ্টা', ২৫ জুলাই সমকাল, 'পোরশায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির শত বছরের পুরাতন শশ্মাণ জবর দখলের চেষ্টা', ২৪ জুলাই ইত্তেফাক, 'সাত দফা দাবিতে গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের বিক্ষোভ', ২০ জুন প্রথম আলো, 'ঘোড়াঘাটে তহশীলদারের ভুল রিপোর্টের কারণে আদিবাসীদের জায়গা জমি হারাতে হচ্ছে', ৮ জুলাই দিনাজপুর নিউজ২৪, 'জুলুম দখলের প্রতিবাদে চাপাইনবাবগঞ্জে রাজোয়ার সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ সমাবেশ', ১৮ জুলাই দ্য ডেইলি স্টার, 'আদিবাসীদের নামে মিথ্যা মামলা নির্যাতন: চাপাইনবাবগঞ্জে প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল', ১৯ জুলাই সমকাল, 'সম্পাদকীয়: গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের বিক্ষোভ-ক্ষোভ নিরসন করুন' ২১ জুলাই জনজাতির কণ্ঠ, 'ভূমিকেন্দ্রিক সমস্যা ছাড়াও করোনাকালীন খাদ্য সংকটেও পড়ে যায় আদিবাসীরা।'

প্রচারিত শিরোনামগুলোর মধ্যে কিছু তুলে ধরা হল 'খাদ্যের অপেক্ষায় আদিবাসী গ্রামগুলো' ২৬ এপ্রিল নয়া দুনিয়া, 'দিনাজপুরে ত্রাণের দাবীতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ' ২০ এপ্রিল দিনাজপুর নিউজ, 'লকডাউনে আদিবাসী গ্রামগুলোতে খাদ্য সংকট: মতামত', ১৮ এপ্রিল বিডি নিউজ২৪, 'শহর থেকে গ্রামে আসা আদিবাসীদের খাদ্য সহায়তা দরকার', ১৫ জুন জনজাতির কণ্ঠ, 'করোনা পরিস্থিতিতে আদিবাসীদের পর্যাপ্ত সহায়তার আহ্বান' আইনিউজ বিডি, 'ত্রাণ সহায়তাবঞ্চিত গাইবান্ধার ঘরবন্দি ১২০০ সাঁওতাল পরিবার', ১ এপ্রিল দ্য ডেইলি স্টার, 'সাঁওতালদের পাশে কেউ নেই' ৩১ মার্চ সমকাল। মহামারি সময়েও আদিবাসী নারীর ধর্ষণের নিউজ উঠে এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তারমধ্যে 'চুনারুঘাটে সাঁওতাল কিশোরীকে দলবেধে ধর্ষণ', ২২ জুন জনজাতির কণ্ঠ, 'ধর্ষিত সাঁওতাল কিশোরীর ছবি প্রকাশ: প্রতিবাদ', ২৪ জুন জনজাতির কণ্ঠ। এছাড়াও 'দীঘিনালায় এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ পাহাড়ী মেয়ে', ২৭ জুলাই জন জাতির কণ্ঠ, 'হিলিতে আদিবাসী ভ্যানচালকের গলা কাটা লাশ উদ্ধার', ২ আগষ্ট কালের কণ্ঠ উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য বিষয় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপে প্রণোদনাবঞ্চিত আদিবাসীদের চরম বৈষম্য বিগত ৩১ জুলাই প্রথম আলো পত্রিকায় স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আদিবাসীদের অধিকার ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে রাষ্ট্র বরাবর নীরব ভূমিকা পালন করেছে। অধিকার প্রশ্নের প্রতুত্তোরে দেখা যায় ব্রিটিশ আমলে আদিবাসীদের পৃথক আবাসভূমি ও পৃথক শাসনব্যবস্থা ছিল। এমনকি পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ ও ৬২ সালের সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল।পরবর্তী দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে আদিবাসীদের নিজস্ব পরিচয়কে হরণ করে বাঙালি নামে আখ্যায়িত করা হয়। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্মারক গ্রন্থে দেখতে পাই পরবর্তীতে সংসদ উপনেতা ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান সাজেদা চৌধুরীও সে সময় সংসদে বলেছিলেন, "সংবিধানে তাদের উপজাতি বা আদিবাসী স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তবে তারাও আজকে সাড়ে সাতকোটি বাঙালির সঙ্গে স্বাধীন এবং তাদেরও বাঙালি জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।"

সেই প্রসঙ্গে একটি প্রশ্নও ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন "একটি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার চেয়ে একটি জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া কি অধিক মর্যাদাজনক নয়?" ৭২ সালের সংবিধানে আদিবাসীদের অস্বীকার করে তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক রূপ পরিলক্ষিত হয়। 'নিজভূমে পরবাসী ২০০৬, মেসবাহ কামাল ও অন্যান্য' গ্রন্থে রাশেদ খান মেনন বলেন, "১৯৭২ এ রচিত বাংলাদেশের সংবিধান নিশ্চিত ভাবেই একটি উত্তম বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংবিধান। কিন্তু এই সংবিধানের প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এমনকি মৌলিক অধিকার ভোগের কোথাও বাংলাদেশের চৌহদ্দির মধ্যে সংখ্যালঘু ৩৭টি জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে উল্লেখ নেই। সংবিধানে এই জাতিগোষ্ঠির অস্তিত্বের অনুল্লেখ রাষ্ট্র কর্তৃক তাদের উপেক্ষা করার এবং বৈষম্যমুলক আচরণ করার পথকেই প্রশস্ত করে দিয়েছে।" সংবিধানে শুধু জাতিগতভাবে নয়, ভাষাগত ক্ষেত্রেও আদিবাসীদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। সংবিধানে ৩ নম্বর ধারায় শুধুমাত্র রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বলা হয়েছে, "প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।" এর মাধ্যমে দেশের অন্যন্য জাতিগোষ্ঠীর ভাষাকে কার্যত স্বীকার করা হয়নি। সংবিধান প্রণয়নের পর অনেকবার সংশোধন করা হল কিন্তু আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়গুলো বরাবরই এড়ানো হয়েছে। পরিশেষে বলতে চাই যে আদিবাসী বান্ধব রাষ্ট্র না হলে আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত বৈষম্যের স্বীকার হবে। করোনাকালীন সময়েও করুনার পাত্র হয়ে নয় বরং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও অন্যান্য অধিকার প্রদানের দাবি জানাচ্ছি।

(পি/আগস্ট ০৯, ২০২০)