ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা : বাস্তবতার শোচনীয়তা

২০২০ আগস্ট ২৭ ০১:২৮:১০
অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা : বাস্তবতার শোচনীয়তা

প্রান্ত সাহা


ছয় মাসেও কি অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত অবস্থানে নেয়া সম্ভব হল না? করোনা পরিস্থিতি গোটা বিশ্বকেই নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আলাদাভাবে উল্লেখ না করলেও অর্থনৈতিক অবস্থার পাশাপাশি আজ শিক্ষা ব্যবস্থাও পুরোপুরি অচল।

গত মার্চ মাস থেকে একযোগে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর নানা উপায়ে নড়বড়ে অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে কচ্ছপ গতিতে এগুচ্ছে দেশের সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রম। এতে দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার পাশাপাশি সারাদেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থা সন্তোষজনক না হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান চাইলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে মারাত্মক সেশনজট পরিস্থিতি চোখ রাঙানি দিচ্ছে। অনলাইন ক্লাস পদ্ধতি নিয়ে প্রথম দিকে নানা প্রশ্ন জন্ম নেয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে, সময়ের সঙ্গে অনেকাংশে সে প্রশ্ন মাটি চাপা পড়েছে এটা ঠিক, তবে কাঙ্ক্ষিত গতি কি এসেছে শিক্ষা ব্যবস্থায়? এটি নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক, এর মাঝেও কাঙ্ক্ষিত ফল না আসার বেশ কয়েকটি বিষয় আমাদের সামনে এসে ধরা দেয়। তা হচ্ছে-

১। নতুন প্রযুক্তির প্রতি এক প্রকার অজানা ভীতি।

২। আর্থিক সচ্ছলতার প্রশ্নে ইন্টারনেট খরচ এবং স্মার্ট ডিভাইস একটি বাড়তি সংযোজন।

৩। চিরায়ত পাঠ্যসূচির সঙ্গে ডিজিটাল পাঠ্যক্রম প্রতিনিয়তই জন্ম দিচ্ছে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি।

৪। ব্যবহারিক কোর্সসহ সকল পরীক্ষা কার্যক্রম অনলাইনে নেয়া সম্ভব না বিধায় যারা নির্দিষ্ট কোর্সগুলোর ক্লাস শেষ করে পরীক্ষার অপেক্ষায় ছিলেন তারা রীতিমত একাডেমিকভাবে স্থবির হয়ে আছেন পরবর্তী নির্দেশনার অপেক্ষায়।

তবে এটা সত্য যে, উপরোক্ত সমস্যাগুলোর বেশকিছুর প্রভাব সময়ের ব্যবধানে অনেকাংশেই লাঘব হয়েছে। দীর্ঘ ৬ মাসের পথ অতিক্রম শেষেও আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছি না এই অচলাবস্থা কবে নাগাদ শেষ হবে। তাই এই পরিস্থিতির সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবনধারণকেই বিকল্প একমাত্র পথ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। সে মোতাবেক দেশের সকল সেক্টরই তাদের কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে পুনবহাল করেছে। শুধুমাত্র স্পর্শকাতর ইস্যু হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর মাঝে বাতিল করা হয়েছে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী ও বৃত্তি পরীক্ষা। জেএসসি-জেডিসি’র পাশাপাশি গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিতব্য এইচএসসি পরীক্ষার ভাগ্যও আজ অনিশ্চয়তার পেন্ডুলামে ঝুলছে।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ তাদের সকল কার্যক্রম অনলাইনের ভিত্তিতে দিনকে দিন সেশন বাই সেশন পার করতে পারলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানান জটিলতায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। যে সকল প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যেতে চাইছে তারাও বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন আশানুরূপ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিতে। তাই লক্ষ্যপূরণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়পক্ষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবার দৌড়ে এককভাবে এগিয়ে আছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বলা যায়, এখন জীবনের সবচে মূল্যবান সময় পার করছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সকলে, কেননা ছাত্রজীবনের এই পর্যায়ে এসে ব্যক্তি জীবনের এক রূঢ় মেরুকরণের সম্মুখীন হন সবাই। একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি পারিবারিক দায়িত্ব গ্রহণের এক অদৃশ্য চাপ প্রকটভাবে ধরা দেয়; একই সঙ্গে এই প্রতিযোগিতার বাজারে চাকুরির মত সোনার হরিণের পেছনে যেখানে বছরের পর বছর ঘুরতে হয় সেখানে শিক্ষা ব্যবস্থাই যদি জীবনের মূল্যবান সময়কে গ্রাস করে তখন নানাবিধ মানসিক সমস্যায় হতাশাগ্রস্ত হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা! বেশ কিছুবছর ধরে সেশনজটকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও এই করোনার প্রকোপ এটিকে নির্দ্বিধায় পুরোপুরি উস্কে দিয়েছে বহুগুণে।

সে কারণেই করোনা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হবার দরুন এরই মাঝে নিজেদের এগিয়ে নেবার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত শিক্ষার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সকলকে। যখন অনলাইন নির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা নেয়া হয় তখন থেকেই এটিকে উন্নত অবস্থানে নেয়ার বিষয়ে একটি সুপরিকল্পিত প্রকল্পের প্রয়োজন ছিল, যা হয়তো তাৎক্ষণিক কোন সুসংবাদ দিতে না পারলেও দীর্ঘ বিরতিতে এসে এখন ফলপ্রসূ হত!

যে সকল বিষয়ে লক্ষ্য দিলে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা আরো কার্যকর হত বলে ধারণা করা যায়, তা হচ্ছে-

১। অনলাইন ক্লাস পরিচালনার স্বার্থে UGC কর্তৃক একটি বিশেষায়িত ওয়েবসাইট সৃষ্টি, যেখানে নিজস্ব সার্ভার এবং তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এটিকে পরিচালনা করা।

২। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইন ক্লাসের জন্য হলেও একটি নির্দিষ্ট সার্ভারে যুক্ত করা এবং একই সঙ্গে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আইডি পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে তাদের স্বকীয়তা নিশ্চিত করা।

৩। কেন্দ্রীয়ভাবে একটি মনিটরিং টিমকে সকল সময় পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্ব দিয়ে কারিগরি সাহায্যের জন্য প্রস্তুত রাখা।

৪। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের অধীনে শিক্ষারত সকল শিক্ষার্থীদের আলাদা আলাদা আইডি খোলার ব্যবস্থা রাখা, যেখানে তাদের সকল তথ্য নথিভুক্ত থাকবে এবং সেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উক্ত শিক্ষার্থীর উপস্থিতি গণনার পাশাপাশি বিভাগের সকল নির্দেশনা সমূহ খুব সহজেই তার নিকট পৌঁছে দেয়া যাবে।

৫। অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে এ সেবা পৌঁছাতে তুলনামূলক উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবার প্রয়োজন। তাই সরকারের নির্দেশে সকল অপারেটর কোম্পানি যদি একটি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট ব্রাউজের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি বিশেষ সুবিধা প্রদান করে তবে অনেকাংশে এ বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।

৬। এখন যেহেতু অনলাইন ক্লাসগুলোর জন্য ইন্টারনেট সংযোগ বাধ্যতামূলক তাই অপারেটর কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে সুলভ মূল্যে বিভিন্ন ইন্টারনেট প্যাকেজ সরবারহ করা যেতে পারে।

তাছাড়াও স্মার্ট ডিভাইসের সংকট দূরীকরণের ক্ষেত্রেও UGC’কে দ্রুত ভাবা উচিত। কেননা গত ৬ মাস যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় বাজেটের সিংহভাগ যেখানে শিক্ষার্থীদের পেছনে খরচ করার কথা ছিল তা এখন রীতিমত বন্ধ রয়েছে। সেকারণেই বাজেটের এই অংশের টাকা দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর মত বিশেষায়িত একটি ডিভাইস সকল শিক্ষার্থীকে প্রদানের পরিকল্পনা নেয়াটা এখন সময়োপযোগী হিসেবেই গণ্য করা যায়। তাই আবারো বলবো দ্রুত করিৎকর্মা সিদ্ধান্তে আসুন। কেননা এই বৈশ্বিক সংকটের মাঝে সিদ্ধান্তহীনতা জাতিগত সমৃদ্ধির পথকে রুদ্ধ করছে বহুগুণে।

লেখক : শিক্ষার্থী- নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।