ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

প্রসঙ্গ : মুখোশধারী ও লুটেরাদের উচ্ছেদ

২০২০ সেপ্টেম্বর ০৭ ১২:৫২:১৮
প্রসঙ্গ : মুখোশধারী ও লুটেরাদের উচ্ছেদ

আবীর আহাদ


রাষ্ট্র ক্ষমতার সাথে জড়িত কিছু মানুষ আছেন যারা মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু দয়াদক্ষিণা দিয়ে তারা অনেক সওয়াবের কাজ করে ফেলেছেন, এটাই তো বড়ো সম্মান ! আর সম্মান দেয়ার কী আছে ? তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে চাই, যারা এসব বলেন, ভাবেন, তারাই বা মুক্তিযুদ্ধের সময় কী ভূমিকা রেখেছেন ? মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সব সামর্থ্য থাকলেও জীবনের মায়ায় তারা মুক্তিযুদ্ধে যাননি । অনেকে বৌ বা স্বামী নিয়ে নিরুদ্বিগ্নে সংসার করেছেন । পাকি সরকারের হুকুম তালিম করে অনেকে চাকরি করেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন । অনেকে পাকিদের সবরকম খেদমতও করেছেন; মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারকে পাকিদের হাতে ধরিয়েও দিয়েছেন ।

দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর তারাই বিভিন্ন সময় টাকা, রাজনৈতিক শক্তি ও আত্মীয়তার জোরে মুক্তিযোদ্ধাও সেজেছেন । আর আজ স্বাধীনতার ঊনপঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো অনেকে মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন ! যে প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা বানানো হচ্ছে তাতে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা বানানো হতে থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই । আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সংজ্ঞা এবং সুরক্ষা আইন না থাকার ফলে যত্রতত্র যে-কেউ অর্থের বিনিময়ে, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছে ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা দেড়লক্ষের নিচে । কিন্তু ইতিমধ্যে সরকারি তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো । এর মধ্যে বিরাট সংখ্যক রাজাকাররাও ঠাঁই পেয়েছে । বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তারা অমুক্তিযোদ্ধাসহ রাজাকারদের যেমন মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগ সরকার একনাগাড়ে আজ বারো/তেরো বছরেও দেদার অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে । স্বাধীনতার পরপরই বাহাত্তর সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংজ্ঞা প্রদান করেন । সেই সংজ্ঞায় বলা হয়েছিলো : "মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি যেকোনো একটি দলের (ফোর্স) অন্তর্ভুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ।" এ সংজ্ঞাটি ছিলো সত্যিকার অর্থে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংজ্ঞা । কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা মানেনি, তেমনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও মানছে না । কেনো মানছে না, তার কারণ আগেই বর্ণনা করা হয়েছে ।

মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রণয়নের দাবিতে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে আমি সর্বপ্রথম একটি আন্দোলনের সূত্রপাত করি । সেই আন্দোলনের প্রয়োজনে আমরা বিভিন্ন সময় সভা, সমাবেশ, আলোচনা সভা, মতবিনিময় সভা, সংবাদ সম্মেলন, অবস্থান কর্মসূচি, পদযাত্রাসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করেছি । বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সঠিকভাবে প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি উচ্চতর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশও পেশ করেছি । কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার কোনোই প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে না ।

আর ইদানিংকালে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সরকারের অবহেলা ও আচরণসহ সারা দেশে সরকারি দলের সমর্থকরা যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারবর্গের ওপর হত্যা হামলা মামলাসহ অত্যাচার করে চলেছে, তাতে সরকারের মধ্যেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না । আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জলাঞ্জলি দেয়ার শেষ পরিণতি হিশেবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকমহল অভিমত ব্যক্ত করেছেন ! আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার যে সর্বনাশা কর্মযজ্ঞে লিপ্ত হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার একটি অপমৃত্যু সংঘটিত হওয়ার সমূহ সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে ।

মুক্তিযোদ্ধারা দেশটি স্বাধীন করেছিলো বলেই যারা যা কল্পনাও করেননি তারা তাই হয়েছেন । ক্ষমতা খাটিয়ে, ঘুষ-কমিশন খেয়ে, ভুয়া প্রকল্প বানিয়ে প্রতারণার আশ্রয়ে শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন । তারা যে জীবনে বেঁচে থেকে এতসব অর্জন করলেন----রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী বিচারপতি স্পিকার মন্ত্রী এমপি সচিব জেনারেল ব্যবসায়ী শিল্পপতিসহ অন্যান্য সবকিছুই হয়েছেন হচ্ছেন ও হবেন---এটাও কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দয়ার দান ।

তবে একথাও ঠিক, তাদের অনেকেই গালভরা শ্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জয়গান করেন । কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা ও তাদের দাবিদাওয়া সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও একটি কথা বলেন না, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করেন না । এরা আসলে প্রতারক । দ্বিচারী ও বর্ণচোরা । সুবিধাবাদী । মুখোশধারী । মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তাদের অন্তরে বিষ ! তারা মনে করে, দরিদ্র ও অশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা হবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতীয় বীর ? এটাই তাদের পরশ্রীকাতরতা । হিংসা । অথচ মুক্তিযুদ্ধের নামে ক্ষমতা এবং ক্ষমতায় থেকে দু'হাতে লুটপাটই তাদের লক্ষ্য ।

রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদেরও একটি আদর্শ আছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মুখোশধারীদের আদর্শ বলতে কিছু নেই । পরশ্রীকাতরতায় আক্রান্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান-দলন এবং মুক্তিযুদ্ধের নাম ব্যবহার করে ক্ষমতায় বসে দুর্নীতি-লুটপাট করাই তাদের আদর্শ । মূলত: এরা রাজাকারদের চাইতেও নিকৃষ্ট মনের অধিকারী ।

যতোদিন সমাজ ও রাষ্ট্রে এ-ধরনের মুখোশধারী প্রতারক ও বর্ণচোরারা থাকবে, ততোদিন এ-সমাজে, এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা নেই । দেশের উন্নয়নের নামে লুটেরাদের উন্নয়ন হবে । জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন হবে না । নৈতিকতা ও চরিত্রের উন্নয়ন হবে না ।

দেশের জনগণ, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত যুবসমাজসহ সমাজশক্তিকে সর্বাগ্রে সংগঠিত হয়ে এই প্রতারক ও বর্ণচোরারাদের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে । এদেশটি সবার । মুক্তিযোদ্ধারা দেশটি স্বাধীন করে দিয়েছেন, তারা এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, তারা আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে দুর্বল । শুধু তাদের দিকে চেয়ে থাকলে চলবে না । একজীবনে সবকিছু হয় না । তারপরও তো মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে কলম ও সাংগঠনিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন । এখন যুবসমাজ ও সমাজশক্তির দায়িত্ব দেশটাকে মুখোশধারী প্রতারক ও লুটেরাদের হাত থেকে উদ্ধার করা এবং তাদেরকে উচ্ছেদ করা ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।