ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » ফিচার » বিস্তারিত

আধুনিক বরিশালের নির্মাতা মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত

২০২০ নভেম্বর ০৬ ১৮:০৩:৫২
আধুনিক বরিশালের নির্মাতা মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত

এম এ জলিল :অশ্বিনী কুমার দত্ত বরিশালের নির্মাতা। তিনি স্বদেশী যুগে ভারত উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন। সাধনা, নিষ্ঠা, মানব-প্রেম ও স্বাধনিতা আন্দোলনে তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক। এ সিদ্ধ পুরুষদের জন্ম বরিশালে। বরিশালে একান্ত আপনজন অশ্বিনী কুমার দত্ত। তিনি বরিশালের গৌরব। বরিশালের পরিচয় মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত ও শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। তারা বরিশাল তথা বাংলার কৃতি সন্তান। বাংলার রাজনীতিতে তারা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী জননেতা। তারা উভয়ে বাঙালি জাতি সত্তা বিকাশে অবিশ্মরণীয় অবদান রেখেছেন। বঙ্গভঙ্গ হতে স্বদেশী, স্বদেশী হতে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে অশ্বিনী কুমার দত্ত বাঙালি জাতির নিকট চির পূজনীয় ও স্মারণীয়। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের একান্ত ভক্ত ছিলেন উপ মহাদেশের দুই কৃতিমান পুরুষ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও শেরেবাংলা আবুল কাশে ফজলুল হক। তার ও তার দুই অনুসারী চিত্তরঞ্জন দাস ও শেরেবাংলার মহান কৃতিত্বের অনুসারীরা ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন যুগিয়েছিলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিসেস শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে এই দুই নেতার ভক্তকুলেরা। ১৯৭১ সালে বাঙালিদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, সমর্থন যুগিয়েছে। সেই কারণে বাংলাদেশ ৯ মাসের মধ্যে স্বাধীনতা লাভ করেছে।

অশ্বিনী কুমার দত্ত ১৯৫৬ সালের ২৫ জানুয়ারী পটুয়াখাল জেলার লাউকাটিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন পিতা ব্রজমোহন দত্ত। তখন ব্রজমোহন দত্ত পটুয়াখালীর মুন্সেফ ম্যাজিষ্ট্রেট। পিতামাতার ধর্মানুরাগ অশ্বিনী কুমারের ওপর বাল্যকাল প্রভাব বিস্তার করে। বাটাজোর গ্রামে নিজ বাড়িতে জমিদারির গোমস্তা নীল কমল সরকারের নিকট তালপাতায় বর্ণমালা শিক্ষা লাভ করেন। তারপর পিতার সাথে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যা শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বিষ্ণুপুর ও রংপুরে নিম্নশ্রেনীতে পড়েন। ১৮৬৯ সালে বিএ পড়ার সময় তিনি নলছিটির নথুল্লাবাদের মলি বহর পরিবারের কায়স্থ কন্যা ৯ বছর ৪ মাস বয়ষ্কা সরলা বালাকে বিয়ে করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার সময় তার বয়স ১৪ বছরের কম ছিল। কিন্তু পরীক্ষার সময় বাড়িয়ে লেখা হয়।

এ মিথ্যা সংশোধনের জন্য তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে চতুর্থ বর্ষে উন্নীত হয়ে পড়া স্থগিত রেখে যশোরে পিতার নিকট চলে আসেন। তিনি পিতার নিকট ধর্মচর্চা, সংস্কৃত ও ফার্সি শিক্ষা লাভ করেন। এলাহাবাদে পীড়ারশিপ পাস করে কিছুদিন সেখানে ওকালতি করেন। পুনরায় তিনি ১৮৭৬ সালে বিএল পাস করেন। অশি^নী কুমার কলকাতায় ছাত্র জীবনে রামতুনু লাহিড়ী, রাজনারায়ণ বসু, কেশব চন্দ্র, রামকৃষ্ণ রমহংস ও স্বামী বিবেকানন্দের সংষ্পর্শ লাভ করে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেন। রাজানারায়ণ তাকে বলেছিলেন, অশি^নী যদি কাজ করিতে চাও বরিশালে থাকিও, আর যদি সুনাম করিতে চাও কলিকাতায় থাকিও। পিতা বজ্রমোহন দত্ত পুত্রের ইংরেজদের গোলাম হওয়া পছন্দ করতেন না। তাই পিতার নির্দেশ ও রাজনারায়ণের উপদেশ তিনি ১৮৮২ সালে বরিশালে জজকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। বরিশালে তিনি প্রথম এমও, বিএল। অচিরে তিনি একজন সৎ ও ন্যায়বান উকিল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি বরিশালে সমাজের কুসংস্কার ও সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি ব্রক্ষ সমাজের সদস্য হন এবং পুনরায় সমাজের চাপে সনাতন ধর্মে ফিরে যান। বাজার রোডের কালীবাড়ীর সোনা ঠাকুরকে তিনি পরম শ্রদ্ধা করতেন।

অশ্বিনীকুমার সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারের কর্মসূচি একই সঙ্গে গ্রহণ করেন। তিনি ১৮৮৪ সালে ২৭ জুন বিএম স্কুল এবং ১৮৮৯ সালের ১৪ জুন বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিএম স্কুল ও কলেজে ১৭ বছর শিক্ষকতা করেন। তিনি কোন বেতন নিতেন না। অধিকন্ত বিদ্যালয়ের জন্য ৩৫,০০০ টাকা দান করেন। তিনি ১৮৮৬ সালে কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৮৮৭ সালে বরিশালে লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ১৮৯৭-১৯০০ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯০৫ সালে তিনি বরিশালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু করেন। ১৯০৬ সালে বরিশালে অনুষ্ঠিত কংগেস প্রাদেশিক সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি স্বদেশ বান্ধব সমিতি গঠন করে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন করেন। তার পরিচালিত স্বদেশী আন্দোলনে সারা ভারতে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং তাকে ১৯০৮ সালে সরকার গ্রেফতার করে রেঙ্গুনে ও আগ্রায় অন্তরীণ রাখে। ১৯১০ সালে ৮ ফেব্রুয়ারী তিনি মুক্তি লাভ করে বরিশালে আসেন।

মুক্তি লাভের পর তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তিনি বহুমূত্র ও উৎকট পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন। অসুস্থ্যতা সত্ত্বেও তিনি কয়েকবার কংগেসের সম্মেলনে যোগ দেন। তিনি শেষবারের মতো ১৯২১ সালে বরিশালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। ১৯২১ সালে ২ সেপ্টেম্বর মহাত্মা গান্ধী ও মওলানা মুহম্মদ আলী অশি^নী কুমারের সাথে তার বাসায় সাক্ষাৎ করেন। তিনি রোগ মুক্তির জন্য ১৯১০ সালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমন করেছিলেন। কিন্তু তার রোগের কোন উপসম হয়নি। তিনি শেষবারের মতো ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে চিকিৎসার জন্য কলিকাতায় গমন করেন। সেখানে তিনি এক বছর তিন মাস ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে ভবানীপুরে ৫৯ নং চক্রবেড়ে রোড বাড়িতে ছিলেন। ১৯২৩ সালের ৭ নভেম্বর বাংলা ১৩০০ সালের ২১ কার্তিক বুধবারে বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বা স ত্যাগ করেন। ঐ দিন রাত ৯টা ৩০ মিনিটে কেওড়াতালায় তার দেহ সমাহিত করা হয়।

অশ্বিনী কুমার একজন প্রতিভাশীল সাহিত্যিক ছিলেন। ১৮৮৭ সালে বিএম স্কুলে ভক্তিতত্ত্ব সমন্ধে কয়েকটি বক্তৃতা দেন এবং তা অবলম্বন করে ‘‘ভক্তিযোগ” গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ভক্তিযোগ ইংরেজি ও ভারতের কয়েকটি ভাষায় অনুদিত হয়। তার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কর্মযোগ’। ১৮৯৩ সালে তিনি স্বদেশ বান্ধব সমিতিতে তিনটি বক্তৃতা দেন এবং তা পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। ধর্ম রক্ষিনী সভায় তার প্রদত্ত ভাষণ অবলম্বনে দূর্গোৎসব তত্ত্ব প্রকাশিত হয়। তিনি কতগুলো সঙ্গীত রচনা করেন এবং তা ভারতগীতি নামে প্রকাশিত হয়। তিনি সংবাদপত্রের সেবক ছিলেন। তার প্রেরণায় ‘বরিশাল হিতৈৗষী” ও ‘বিকাশ পত্রিকা” প্রকাশিত হয়। দূর্গামোহন সেন ‘বরিশাল হিতৈষী” পত্রিকার সম্পাক ছিলেন।

অশ্বিনী কুমার একজন শিক্ষক, সমাজ সংস্কারকম সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব্। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, জননেতা তোফায়েল আহমেদ, সওগাতুল আলম সগীর, আশমত আলী সিকদার ও ইতিহাসবিদ সিরাজ উদ্দীন আহমেদ।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ।