ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

৭ নভেম্বরে নিহত কর্নেল হুদার কাছেই ভাটিয়াপাড়ার পাকিবাহিনী আত্মসমর্পণ করে 

২০২০ নভেম্বর ০৯ ১৩:৩৬:৩৮
৭ নভেম্বরে নিহত কর্নেল হুদার কাছেই ভাটিয়াপাড়ার পাকিবাহিনী আত্মসমর্পণ করে 

আবীর আহাদ


১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানে বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম ও কর্নেল এটিএম হায়দার বীরউত্তমের সঙ্গে যে কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীরবিক্রম নিহত হয়েছিলেন----সেই হুদাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের অন্যতম সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এন হুদা । গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানায় অবস্থিত ভাটিয়াপাড়া পাকিঘাঁটির বিপুলসংখ্যক সৈন্য ও রাজাকাররা একাত্তরের ১৯ ডিসেম্বর এই মেজর হুদার কাছেই আত্মসমর্পণ করেছিলো ।

কর্নেল কে এন হুদার আরেকটি ঐতিহাসিক পরিচয় ছিলো । তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন হিশেবে চাকরি করার সময় বঙ্গবন্ধুর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে সশস্ত্র পন্থায় স্বাধীন করার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন । বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয়সূত্রে, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভগ্নিপতি প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা এটিমএম সৈয়দ হোসেনের সাথে ক্যাপ্টেন হুদার এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে । সেই সূত্রে ১৯৭০ সালের প্রথমদিকে ক্যাপ্টেন হুদার সাথে আমারও পরিচয় ঘটেছিলো ।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষদিকে কলকাতার বাংলাদেশ মিশনে একদিন ক্যাপ্টেন হুদার সাথে আমার দেখা হয়ে যায় । আমার এক কাকা তখন মিশনের প্রেসবিভাগের একজন কর্মকর্তা আলীমুজ্জামানের কক্ষে বেশ কিছুদিন, বলা চলে, হুদাভাই ও আমি প্রায় প্রতিদিন একসঙ্গে কাটিয়েছি । সেই থেকে তাঁর সাথে আমার একটি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা তাঁর নিহত হওয়ার পূর্বপর্যন্ত অটুট ছিলো ।

১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ-ভারত যৌথকমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও, ভাটিয়াপাড়ার পাকিবাহিনী ভয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায় । তারা তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে বলে গো ধরে বসে থাকে । কিন্তু আমরা অনড় । আমরা চাই, আমাদের কাছেই আত্মসমর্পণ করতে হবে । তারা বিগত ন'মাসব্যাপী আমাদের এ-অঞ্চলে যে পৈশাচিক কর্মকাণ্ড করেছে, তার প্রতিশোধ তো নিতে হবে । কিন্তু বিশাল এলাকা জুড়ে মাটির তলে তারা কংক্রিটের বাঙ্কার খুঁড়ে তার মধ্যে অবস্থান করায় আমাদের পক্ষে সহজে তাদের হঠানো সম্ভব ছিলো না । অপরদিকে দেশ যেহেতু মুক্ত হয়ে গিয়েছে, সে-ক্ষেত্রে যশোর থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে ডাকলেও তারা আসবে না । ভাটিয়াপাড়ায় বিশাল অস্ত্রভাণ্ডারসহ খাদ্যশস্যভর্তি একটি এলএসডি গুদাম ছিলো পাকিদের নিয়ন্ত্রণে । ফলে তারা গো-ধরে বসে থাকে । ফলশ্রুতিতে আমরাও উপায় খুঁজতে থাকি যে, কী উপায়ে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করানো যায়-----

ভাটিয়াপাড়া এলএসডির উত্তরপাশে বারাশিয়া নদীর পাড়ে আফম হাফিজুর রহমানের মুজিববাহিনী ও আমার সি-ইন-সি স্পেশাল বাহিনীর যৌথ অপারেশন সেন্টার ছিলো । অপারেশন সেন্টারে বসে ১৮ ডিসেম্বর সকাল বেলা আমি ও হাফিজ সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আজ বিকেলে আমি চারজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নড়াইল যাবো । আমরা খবর পেয়েছিলাম যে, নড়াইল সার্কিট হাউসে নাকি একজন অফিসারসহ আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈন্য অবস্থান করছে । মূলত: তাদের সাথে পরামর্শ করে কিছু করা যায় কিনা সে-বিষয়ে আলোচনা করার জন্যই আমাদের সেখানে যাওয়া । মধুমতি পার হয়ে প্রায় পনেরো/ষোল মাইল পায়ে হেঁটেই আমরা রাত ন'/দশটা নাগাদ নড়াইল সার্কিট হাউসে পৌঁছি । সেখানে কোনো কমিশনড অফিসার পেলাম না । হাবিলদার মজিদের কাছে জানতে পারি, সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর হুদা যশোরে অবস্থান করছেন । হাবিলদার মজিদ ওয়ার্লেসে মেজর হুদার সাথে আমাকে যুক্ত করে দিলে আমি মেজর হুদাকে সার্বিক পরিস্থিতি অবগত করি । তিনি আগামীকাল ১৯ ডিসেম্বর সকালে ভাটিয়াপাড়া আসতে সম্মতি দেন । ঐ রাতেই আবার আমরা পায়ে হেঁটে ভাটিয়াপাড়া ফিরে আসি ।

১৯ ডিসেম্বর সকাল এগারোটায় মেজর হুদা ভাটিয়াপাড়া আসেন । আমার অপারেশন সেন্টারে হালকা নাস্তা সেরে, ভাটিয়াপাড়া পাকিঘাঁটি ঘিরে-থাকা প্রায় তিন/চার শতাধিক মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রক প্রায় আট/ দশজন অধিনায়কের সাথে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে সবাইকে যার যার অবস্থানে ফিরে যেতে বললেন । আগে-থেকে আমাদের কাছে ধৃত পাকিসৈন্য খিজির খানের কাছে তিনি একটি চিঠি দিয়ে পাকিঘাঁটির প্রধান মেজর শওকত হায়াত খানের প্রতি বিকেল তিনটার মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলেন ।

বিকেল পৌনে দু'টায় মেজর শওকত হায়াত খান একটি ফিরতি চিঠি দিয়ে মেজর হুদাকে তাদের ক্যাম্প-হেডকোয়ার্টার ওয়ারলেস সেন্টারে আত্মসমর্পণ বিষয়ে আলোচনার আমন্ত্রণ জানায় । অসীম সাহসী মেজর হুদা একাই সেখানে যেতে উদ্যত হলে আমি তাঁর হাত চেপে ধরি বলি, আপনাকে একা যেতে দেবো না । আমিও আপনার সঙ্গে যাবো ।' মেজর হুদা একটু মুচকি হেসে বললেন, চলো ।

মেজর হুদা একটা এসএমজি কাঁধে ঝুলিয়ে আমাকেও আমার এসএলআর কাঁধে ঝুলিয়ে নিতে বললেন । তারপর পাকিসৈন্য খিজির আগে আগে পথ চিনিয়ে আমাদের নিয়ে চললো । আমাদের পেছনের মুক্তিবাহিনীকে এ-অবস্থানে পজিশন নিতে অপেক্ষায় থাকতে বলা হলো ।

আমরা প্রায় পনেরো মিনিটের মধ্যে শত্রুর মূল ঘাঁটিতে পৌঁছে গেলাম । যাওয়ার পথে আমরা লক্ষ্য করি, বিভিন্ন বাঙ্কার থেকে পাকিসৈন্যরা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে বসে আছে । মেজর শওকত হায়াত খান আমাদের স্বাগত: জানায় । সে আমাদের সাথে করমোদন করে । মেজর হুদার পাকিস্তান বাহিনীর পূর্বতন ক্যাপটেনের পরিচয় পেয়ে মেজর শওকত বেশ খুশি ও আস্থাশীল হয় । আমার মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় পেয়ে সে কৌতুহলের হাসি হাসে । বলে, তুম এতনি ছোটি হ্যায় ! তারপর আমার একটা হাত ধরে ছলছল চোখে বলে, I have a little brother like you !-----

মেজর শওকত হায়াত খান আমাদের চা পান করায় । তারপর শুরু হলো আত্মসমর্পণের বিষয়টি । জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী মেজর হুদা ও মেজর শওকত আত্মসমর্পণ চুক্তিতে পরস্পর স্বাক্ষর করেন । মেজর শওকত হায়াত মাইকে তার সৈন্য ও রাজাকারদের যার যার অস্ত্রসমেত ওয়ারলেস চত্বরে এসে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দেয় । অপরদিকে মেজর হুদা আমাদের মুক্তিবাহিনীকে চারদিক থেকে উঠে আসার নির্দেশ দেন ।

আধা ঘন্টার মধ্যে পাকিবাহিনী ও রাজাকারদের ঘেরাও করে আমাদের মুক্তিবাহিনী তাদের অস্ত্রগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় । অস্ত্র সমর্পণের এক পর্যায়ে এক পাকিসদস্য ' হাম সারেন্ডার নেহি করেগা' বলেই নিজের মাথায় চাইনিজ রাইফেল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করে ।

মেজর খন্দকার নাজমুল হুদার নেতৃত্বে এভাবেই ভাটিয়াপাড়ার পাকিসৈন্যদের আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে এ-অঞ্চলের সর্বশেষ পাকিঘাঁটির চূড়ান্ত পতন ঘটে ।

লেখক :মুক্তিযোদ্ধা লেখক গবেষক, চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।