ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

বিপ্লবী জননেত্রী সেলিনা বানু 

২০২০ নভেম্বর ১১ ১৪:১৪:৫৬
বিপ্লবী জননেত্রী সেলিনা বানু 

রণেশ মৈত্র


বিপ্লবী জননেত্রী সেলিনা বানু আজ আর নেই। কিন্তু ভুলবার মতো বিপ্লবী নেত্রী তো তিনি নন, যেমন নন আরও অনেক নেত্রীই-বিশেষত যাঁরা আমাদের বা তারও আগের যুগের । সেলিনা বানুর কর্মক্ষেত্র যেমন ছিলো পাবনা, তেমনই ছিলো ঢাকা আবার কখনও কুমিল্লা । সবচেয়ে বড় কথাটি হলো সেলিনাদি ছিলেন গণমানুষের নেতা, বিশেষত দরিদ্র জনগণের ।

সেলিনাদি বয়সে ছিলেন আমার চাইতে ১০-১২ বছরের বড় এবং তিনি থাকতেন তাঁর পৈত্রিক বাড়ী পাবনাতে । আমার জন্মস্থান পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানার ভুলবাড়িয়া গ্রামে। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি ভুলবাড়িয়ার তিন মাইল দুরে আতাইকুলা উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পাবনা শহরে এসে ভর্তি হই অষ্টম শ্রেণীতে। শহরে এলেও তখন পর্যন্ত রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হওয়ার ফলে পরিচয়টা ঘটে নি। আমি পাবনা শহরে আসি ১৯৪৭ সালের শেষে। তখনও শহরের স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষক মন্ডলি, রাধানগর পাড়ার প্রতিবেশীগণ এবং আর দু’চার জনের বেশী কাউকেই চিনতাম না । রাজনীতি করতাম না বলেই রাজনৈতিক অঙ্গনের কাউকেই চিনতাম না। সে সব কারণে সেলিনাদি ছিলেন আমার কাছে নিতান্তই অপরিচিত। কিন্তু পরিচয়টা হয়েই গেল একদিন।

তখনও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির ইসলামী জোশ এবং মুসলিম লীগের বেশ প্রভাব সমাজে রয়ে গেছে। ঐ সমাজে আবার মেয়েদের চলাফেরা ছিল অত্যন্ত সীমিত । যে কোন মুসলিম মহিলার জন্য বোরকা পড়া ছিল বাধ্যতামূলক । নারী শিক্ষার অগ্রগতিও তেমন একটা হয়নি। সমাজটি ছিল অত্যন্ত পশ্চাৎপদ এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। প্রাথমিক পর্যায়ের উপরে ছেলেমেয়েদের সহ-শিক্ষা যেন ছিল নিষিদ্ধ। বিশেষ করে জনসমাগম যেখানে হয় সে জাতীয়, বিশেষ করে নাচ গানের আয়োজন যেখানে থাকত-মুসলিম মহিলাদেরকে পরিবারের পক্ষ থেকেই বাধা দেওয়া হতো সে সব অনুষ্ঠানে যেতে। এমনই একটি পরিবেশ গ্রাম থেকে শহরে এসেও আমাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল।

এই সামাজিক পটভূমিতে সেলিনাদির সাথে আমার পরিচয় ঘটে অকস্মাৎ একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে , সম্ভবত ১৯৫১ সালের দিকে। দিন তারিখ আজ আর মনে নেই। পাবনার নিয়ন্ত্রিত বেসরকারী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বনমালী ইনষ্টিটিউটে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে আমরা জনা কয়েক সহপাঠি গিয়েছি। বনমালী ইনষ্টিটিউটই হলো আজতক পাবনা জেলার একমাত্র নাট্য মঞ্চ এবং তার সভাপতি ছিলেন পদাধিকার বলে ডিষ্ট্র্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি পদাধিকার বলে থাকতেন পাবনার পুলিশ সুপার । বনমালী ইনষ্টিটিউটের অপর সকল কর্মকর্তা-সদস্যও নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থাটা এমনই ছিল যে , সরকার-ঘেঁষা না হলে কারও নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ নেই; তা সে যত বড় জনপ্রিয় শিল্পী বা নাট্যকার অথবা গুণীজন ইত্যাদিই হোন না কেন।

যা হোক, ঐ রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে হঠাৎ ঘোষণা করা হল সভাপতি হিসেবে বনমালী ইনষ্টিটিউটের সভাপতি জেলা ম্যজিষ্ট্রেট মাহতাব উদ্দিন সরকারের নাম। হলটিতে লোক সমাগম ভালই হয়েছিল। অবশ্য মহিলা দর্শকদের উপস্থিতি ছিলো উল্লেখযোগ্যভাবেই কম। সেলিনাদি সামনের সারিতেই বসেছিলেন। অপরদিকে সব বড় বড় আমলা ও স্তাবকের দল। আমাদের স্থান হয়েছিলো কিছুটা পেছনের সারিতে।

সভাপতি তাঁর উদ্বোধনী বক্তব্য বলার জন্য দাঁড়ানো মাত্রই একজন মহিলা সামনের সারি থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং তাঁর কণ্ঠের সমস্ত শক্তি দিয়ে চীৎকার করে বলে উঠলেন, “রবীন্দ্র জয়ন্তী” উদযাপনের নামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রবীন্দ্রনাথের প্রতি উপযুক্ত সম্মান না দেখিয়ে জেলা ম্যজিষ্ট্রেটকে উচ্চাসনে বসিয়ে বিশাল একটি মালা দিয়ে মাল্যভূষিত করা হয়েছে- আর মঞ্চের মেঝেতে রবীন্দ্রনাথের ছোট্ট একটি ছবিতে কটি ফুল দিয়ে গাঁথা মালা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এভাবেই রবীন্দ্রনাথকে অপমানিত করা হয়েছে। তাই এ জাতীয় অনুষ্ঠানে আমি থাকতে পারি না-এই কথা ক‘টি বলেই হন হন করে মহিলাটি বেরিয়ে গেলেন।

অপরদিকে সমগ্র হলটিতে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। জেলা ম্যাজিষ্টেট অবশ্য অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে মহিলাটিকে বসতে বললেন আর নিজের গলার মালাটি খুলে পরিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথের ছবিটিতে। অতঃপর বেশ কিছু দর্শক হাত তালি দিয়ে নিজ নিজ জায়গায় বসে পড়লেন।

আমরা কয়েকজন ছাত্র এবং আরও বেশ কয়েকজন অল্পক্ষণের মধ্যেই হলত্যাগ করলাম। জিজ্ঞেস করলাম-‘ভদ্র মহিলাটি কে?’। অনেকেই বলে উঠলেন, ‘সেলিনা বানু-পাবনার প্রখ্যাত জননেতা খান বাহাদুর ওয়াছিমউদ্দিনের দুঃসাহসী কন্যা।’ এভাবেই সেদিন তাঁকে চিনলাম বটে কিন্তুু পরিচিত হওয়ার সুযোগটুকু পাওয়া গেল না।

এর পরবর্তীতে আমি স্কুল জীবনের প্রায় শুরুতেই ১৯৪৮ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেই-সংগঠিত করি ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। তখন তো কলেজ জীবনে পৌঁছে গেছি। অতঃপর ঢাকাতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হওয়ার পর পরই পাবনাতে আমরা ১৫/২০ জন মিলে ঐ সংগঠনটির পাবনা জেলা আহবায়ক কমিটি গঠন করি বন্ধুপ্রতিম আবদুল মতিনকে আহবায়ক করে। এর পর কয়েকজন মিলে গেলাম সেলিনাবানুর বাসভবনে তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে। তিনি যেন মাতৃস্নেহের সাথে আমাদেরকে নিজে চেয়ার টেনে বসতে দিলেন কথাবার্তাও হলো অনেক। তিনি ছিলেন আত্মপ্রচার বিমুখ।

পরে জানা গেল, সেলিনা বানুর জন্ম হয়েছিলো ১৯২৬ সালের ১৩ অক্টোবর এবং তিনিই হলেন পাবনার প্রথম মুসলিম মহিলা যিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন। কলেজ জীবনে তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের কমিউনিষ্ট পার্টির ছাত্রফ্রন্ট ছাত্র ফেডারেশনের একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য ও নেত্রী এবং পরে তিনি তাঁর কর্মনিষ্ঠা, আন্তরিকতা, যোগ্যতা, বিশ্বস্ততা ও সাহসিকতার জন্যে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গৌরবের সাথে অর্জন করেছিলেন । কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য তখন কার্যত গোপন। সেলিনাদির ব্যাপারটিও পাকিস্তান আমল পর্যন্ত ছিল একই রকম।

ইতোমধ্যে পার্টির নির্দেশক্রমেই সেলিনাদি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের মহিলা সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে পার্টির নির্দেশে মনোনয়ন পত্র দাখিল করেন এবং মনোনয়ন পান। কিন্তু অকস্মাৎ দেখা গেলো, যুক্তফ্রন্টের মনোনিত নন এমন একজন অরাজনৈতিক মহিলাকে যুক্তফন্টের মনোনয়ন দেওয়া হলো সেলিনাদির মনোনয়ন বাতিল করে। কারণ হলো, বৃহত্তম শরীকদল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যেকার রাজনৈতিক মতপার্থক্য। মওলানা ভাসানী সমর্থন করতেন সেলিনা বানুকেই এবং সে কারণেই তিনি মনোনয়ন পেয়েও গিয়েছিলেন কিন্তু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো দক্ষিণপন্থি নেতা আমলাদের ধরপাকড়ের ফলে রাজশাহীর পুলিশ সুপারের অত্যাধুনিক স্ত্রীকে মনোনয়ন দেন। মহিলা প্রার্থিদের সংরক্ষিত নির্বাচনী এলাকা গঠিত হয়েছিলো পৌর এলাকাগুলি নিয়ে । শেষতক দেখা গেল বিশাল এক ব্যবধানে সেলিনাদি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন নৌকা প্রতীক ছাড়াই। আমরাও তাঁর সপক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালাই।

অতঃপর এমপিএ কিহসেবে তাঁর কাজকর্ম স্বচক্ষে দেখেছি। তাঁর বেশভূষা ছিলো অতি সাধারণ। শুধু তাই নয়, পরিষদ সদস্য হিসেবে তিনি যে ভাতা পেতেন তার সবটাই তিনি দরিদ্র নারী –পুরুষদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন অনন্য। ১৯৫৪ সালের মাঝামাঝি হঠাৎ প্রবল বন্যায় পাবনা জেলার বহু অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত হলে তিনি ঐ সাধারণ পোশাকেই নৌকায় চড়ে সাধ্যমতো ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করতেন বন্যার্তদের মধ্যে। ফলে নারী পুরুষ নির্বিশেষে বয়স্ক সকলকেই দেখেছি সেলিনাদিকে ‘মা’ বলে ডাকতে। গরীব মানুষদের জন্যে তাঁর বাড়ির দরজা ছিল অবারিত।

১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে প্রচুর বাক-বিতন্ডা হয়। কারণ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন ও সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী পররাষ্ট্রনীতির দাবিতে অবিচল ছিলো। দুই নেতার তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা না হওয়ায় কাউন্সিলারদের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদের পর মওলানা ভাসানী অনুসারীরাই ভোটে জয়ী হন। শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে।

এই কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত সোহরাওয়ার্দী অনুসারীরা মানলেন না- শেখ মুজিব ঢাকায় পাল্টা কাউন্সিল ডাকলেন এবং ভূয়া কাউন্সিলার বহুল পরিমাণে ঢুকিয়ে বিশেষ আবহ সৃষ্টির মাধ্যমে কাগমারী কাউন্সিলে গৃহীত সর্বসম্মত প্রস্তাব দুটি গঠনতন্ত্র অমান্য পাশ করিয়ে নিলেন। ফলে দলে ভাঙ্গন অনিবার্য হয়ে ওঠে , মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করলেন। দেশব্যাপী ঐ দু‘টি নীতির অনুসারী হাজার হাজার নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করলেন। সেলিনাদি, অলি আহাদ, ভাষা মতিন প্রমুখও ঐ একই সময় আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করলেন।
পরিণতিতে শেষতক ১৯৫৭ মালের ২৭, ২৮ ও ২৯ আগন্ট ঢাকায় এক নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন আহবান করলেন মওলানা ভাসানী। সেই কনভেনশনে সেলিনাদিসহ পাবনা থেকে আমরা অনেকে , ঢাকা শহর সহ সমগ্র প্রদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশ থেকেই ট্রেন ও বিমানাযোগে বহু সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী নেতা ও কর্মী যোগ দেন। এই কনভেনশনেই সারা পাকিস্তান ভিত্তিতে একটি অসাম্পদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং সা¤্রাজ্যবাদ-বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠিত হলো পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)নামে।

মওলানা ভাসানী সর্ব সম্মতিক্রমে ন্যাপের কেন্দ্রীয় ও পুর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। সেলিানাদি নবগঠিত ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির অন্যতম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ন্যাপ গঠনের বছর দেড়েক যেতে না যেতেই এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানে প্রথম সামরিক আইন জারী হয়, সাথে সাথে সংবিধান বাতিল করা হয়, রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী গ্রেফতার হন। ফলে, বছর কয়েকের জন্য , অর্থাৎ সামরিক শাসনের প্রথম বছর তিনেক আমাদের মধ্যে দেখ-সাক্ষাত হতো কম।

১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারীর পর ১৯৫৯ সালের মে মাসে আশীর্বাদ নিতে গেলাম নব-পরিনীতা পূরবী মৈত্রসহ সেলিনাদিদের বাসায়। তখন আমি পাকশী চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতা করতাম। যা হোক সেলিনাদি ও তাঁর স্বামী খন্দকার মোহাম্মদ শাহজহান উভয়েই আর্শবাদ করলেন , আদর আপ্যায়নও করলেন প্রাণ খুলে।

বছর কয়েকের মধ্যেই রুশ-চীন আদর্শগত দ্বন্দ্বের ফলে ন্যাপে বিভক্তি আসে। চীনপন্থী গ্রুপটি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পিকিংপস্থী ন্যাপ নামে পরিচিতি লাভ করে। আর বৃহত্তর অংশটি সীমান্ত গান্ধী খান আবুল গাফফার খানের পুত্র খান আবদুল ওয়ালি খানের নেতৃত্বে কেন্দ্রে এবং পুর্ব পাকিস্তানে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয়ে পরিচিত হয় মস্কোপন্থি ন্যাপ বলে। সেলিনাদি পাবনা জেলা কমিটির সভাপতি এবং জননেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা সম্পাদক। আমাকে মদর মহকুমা কমিটির সভাপতি এবং জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। অতঃপর ১৯৭০এর নির্বাচনে সেলিনাদি জাতীয় পরিষদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু সেবার বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফার জোয়ারে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ প্রার্থীরাই শুধু নির্বাচিত হন। যা হোক , ১৯৭৩ সালে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সেলিনাদি, বাদশা ভাই, নুরুজ্জামান বাবলু পৃথক পৃথক আসন থেকে ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

এর আগে, ১৯৭১ সালে তাঁর মেয়ে শিরীন বানু মিতিল পুরুষের বেশে অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে । মিতিলের যোদ্ধাবেশের ছবি কালকাতায় দৈনিক স্টেটসম্যান এবং আরও অনেক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। স্টেটসম্যানের পূর্বাঞ্চলীয় বিশেষ প্রতিনিধি তখন পাবনা এসেছিলেন এবং মিতিলের ছবি ও দীর্ঘ ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন যা তাঁর পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো। মিতিল তখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রী , জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী।
অতঃপর সেলিনাদি, তাঁর স্বামী শাহজাহান ভাই (কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য), কন্যা মিতিল সহ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন ।আমরাও চলে যাই মুজিবনগরে।

আমাকে তখন ইলা মিত্রের বাসায় সিপিবির নেতা মণি সিং এর পরামর্শে চলে যেতে হয় পাবনা জেলার নিকটবর্তী নদীয়া জেলার পূর্ব সীমাস্তে পদ্মা-তীরবর্তী করিমপুরে। একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে ন্যাপ- সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের একটি যৌথ ক্যাম্প খুলতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ব্যাপী ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা- পরিচালক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটমেন্ট এবং রাজনৈতিক ও সামরিক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে হয়। একই সঙ্গে ন্যাপের জেলা সম্পাদকের দায়িত্বও। বর্র্ষীয়ান নেতা অমূল্য লাহিড়ী ছিলেন পার্টির দায়িত্বে জসিম মন্ডল ছিলেন শ্রমিক ফ্রন্টের দায়িত্বে আর বাদশা ভাই ছিলেন সিপিআই ও কংগ্রেসের সহযোগিতায় ত্রাণ সংগ্রহের দায়িত্বে কোলকাতাতেই।

যা হোক নয় মাস পর যখন দেশে ফিরে আসি তখন দেখি পাক-বাহিনী ও তার অনুচরেরা মিলে আমাদের বাড়ীঘর ভেঙ্গেচুড়ে লুটপাট করে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম যার যা পরনে ছিলো তাই নিয়ে । এ অবস্থার মধ্যেই দায়িত্ব পড়লো দ্রুত কমিউনিস্ট পার্টির ও ন্যাপের জেলা কমিটি গঠন করে পার্টিকে নতুন করে গুছিয়ে নেওয়ার। ঈশ্বরদীর পশ্চিম টেংরীতে এক খোলা মাঠে বসে গোপনে আমরা জেলা কমিটি গঠন করলাম। পর্টির সেক্রেটারী নির্বচিত হলেন অমূল্য লাহিড়ী আর সেলিনাদি, প্রসাদ রায়, জসিম মন্ডল, বাদশা ভাই ও আমি ঐ কমিটির সদস্য নির্বাচিত হই। সবাই আবার প্রকাশ্যে করতাম ন্যাপ। ন্যাপ ধীরে ধীরে বেশ বড় একটি প্রগতিশীল পার্টিতে পরিণত হলো মূলত মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল অবদানের জন্যে।

যা হোক, মুক্তিযুদ্ধের অল্প কিছুদিন পর হঠাৎ খবর পেলাম পাবনা জেলার চাটমোহর থানার আওয়ামী লীগ নেতা এবং তৎকালীন এমপি মোজাম্মেল হক সমাজী চাটমোহরে এক মিছিল করেছে- শ্লোগান দিয়েছে-“মালাওনরা যদি বাঁচতে চাও- বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাও”। ফলে সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা শংকিত ও আতংকিত। আমরা তখন ওখানে এর প্রতিবাদে ন্যাপের এক জনসভার আয়োজন করি। বিশাল জনসভা হয় চাটমোহর নতুন বাজার ময়দানে। সেলিনাদি ছিলেন প্রধান বক্তা, বাদশা ভাই, আমি এবং আরও কেউ কেউ বক্তৃতা করি।

তখন পাবনা চাটমোহর যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত খারাপ। জেলা বের্ড়ের কাঁচা-ভাঙ্গাচোরা রাস্তা। বাস চলে না বিকেলের পর। কিন্তু তখন সন্ধা হয়ে গেছে। সহকর্মীরা বহু কষ্টে একটি টমটম ভাড়া করে আনলো। টমটমে উঠে পাবনা রওনা দিতেই যেইমাত্র বাঁশঝাড়ের দিকে পৌঁছেছি (দুধারে বাঁশঝাড় মাঝখান দিয়ে রাস্তাটি চলে গেছে পাবনা পর্যন্ত), হঠাৎ করে সমাজী সাহেবের ৫/৬ জন পোষা সন্ত্রাসী রাইফেল নিজ নিজ রাইফেল হাতে উঁচু করে ধরে আমাদেরকে ঘিরে লাফাতে লাগলো। মুখে “জয়বাংলা” শ্লোগান। । টমটমের চালক ভয় পেয়ে থেমে গেলে আমরা সন্ত্রাসীদের ধমকের সুরে বললাম ‘এর নাম জয় বাংলা, এই হলো মুক্তিযুদ্ধ?’ চালককে বললাম টমটম ছাড়তে। টমটম ছাড়লো পাবনা আমরা পাবনা নিরাপদেই পৌঁছালাম তবে রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল ।

মজার ব্যাপার হলো, চাটমোহরের ঐ আওয়ামী লীগ সেতা মুক্তিযুদ্ধে কোন অবদান রাখেননি, মুজিবনগরেও যাননি এবং ১৬ ডিসেম্বরে যদি পাক-বাহিনী আত্মসমর্পণ না করতো তা হলে সমাজী সাহেব নাকি প্রকাশ্যে পাক-আর্মির সাথে হাত মেলাতেন। এ কথা জানালেন চাটমোহরের বহু লোক।

সেলিনাদি সর্বতোভাবেই ছিলেন গভীরভাবে মানবতাবাদী , তাঁর দেশপ্রেম ছিলো অতুলনীয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, পাবনা বাসী সহ দেশের সবাই যেন তাঁকে ভলতে বসেছে। কিন্তু সেলিনাদির এবং তাঁর মতো মানুষের প্রয়োজনীয়তা দিন দিনই বাড়ছে। তাই সেলিনাদি অমর -সেলিনা বানু মুত্যূঞ্জয়ী।

লেখক : সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।