ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন যন্ত্রণা

২০২০ নভেম্বর ১৪ ১৪:১৩:৪২
মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন যন্ত্রণা

আবীর আহাদ


দুর্নীতি ও লুটপাটের জন্যে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এদেশ স্বাধীন করিনি । অথচ আমাদের ত্যাগ ও বীরত্বে অর্জিত স্বাধীন দেশটি আজ দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও স্বেচ্ছাচারীদর অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে, আর অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করছেন । তাদের অধিকাংশেরই মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই । চিকিত্সার অভাবে নানান রোগে ধুকে ধুকে মরছে । তেমন অবস্থা তাদের সন্তানদের । অর্থের অভাবে তাদেরকে লেখাপড়া শেখাতে পারেননি । যদিও বা কেউ কেউ কায়ক্লেশে কিছু সন্তানদের উচ্চশিক্ষা লাভ করাতে পেরেছে কিন্তু তাদের বেশির ভাগই বেকার । মুক্তিযোদ্ধা কোটা যখন ছিলো তখনো তাদের চাকরি হয়নি, আর এখন তো সেই কোটাটি নেই । বিশাল অর্থই চাকরি প্রাপ্তির একমাত্র কার্যকরি যোগ্যতা ! সে-যোগ্যতা তো মুক্তিযোদ্ধাদের নেই । এমনি অবস্থায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা জীবন যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে । তারা বোধহয় দেশটি স্বাধীন করে মহা অপরাধ করেছে ! দেশের রাজনীতি অর্থনীতি প্রশাসন ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে । উপরন্তু সর্বত্রই তারা অবহেলা ও অবজ্ঞার শিকার ।

ইদানিং আবার নতুন এক উৎপাত শুরু হয়েছে । স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার, আলবদর, সামাজিক অপরাধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অন্যান্য ধর্মান্ধ অপশক্তি ও তাদের উত্তরসূরিরা বিপুল অর্থ উপঢৌকন দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ পদসহ প্রশাসনকে কব্জা করে ফেলেছে । তারাই মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি খড়গহস্ত । বিশেষ করে রাজাকার-আলবদরদের পোলাপান----- মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের বাপ-দাদা-চাচা-নানাদেরকে যেসব মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা ও পাদানি মার দিয়েছিলো, বিভিন্ন স্থানে তারাই প্রতিশোধ নিচ্ছে আওয়ামী লীগেরই ছত্রছায়ায় । তাইতো বিগত কিছুদিন যাবত দেখা যাচ্ছে যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের ওপর নানান ঠুনকো অজুহাতে আক্রমণ করছে । ইতিমধ্যে অনেকে তাদের হাতে নিহত আহত অপদস্থ হয়েছে, অনেককে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে, জায়গা জমি দখল করেছে, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে । সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর সুযোগ পেলেই প্রায় সবাই চড়াও হচ্ছে । মূলত: মুক্তিযোদ্ধা নামের মর্যাদার প্রতি একপ্রকার পরশ্রীকাতরতা ও বিদ্বেষ থেকে এসব সংঘটিত হচ্ছে ।

মুক্তিযোদ্ধারা পিছিয়ে আছে প্রকৃতপক্ষে তাদের সততা ও দেশপ্রেমের কারণে । একদিন----একাত্তরের সাত/আটটি মাস----এ দেশটি তাদের কবলে ছিলো । মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা ইচ্ছা করলে কয়েক লক্ষ স্বচ্ছল স্বাধীনতাবিরোধী লোকদের অর্থসম্পদ দখল করে রাতারাতি ধনী হয়ে যেতে পারতেন । কিন্তু তারা তা করেননি বলেই আজ তাদের কপালে দারিদ্র্যের অভিশাপ নেমে এসেছে । অথচ সেই স্বাধীনতাবিরোধী এবং অন্যান্য পেশার লোকজনসহ সুবিধাবাদী রাজনৈতিক টাউটরা মুক্তিযোদ্ধাদের দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে । দেশ থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে ।

মুক্তিযোদ্ধারা আজ তাদেরই সৃষ্ট দেশে পরবাসী । তাদের ত্যাগ ও বীরত্বের মর্যাদা নেই । সরকার করুণা করে একটি যৎকিঞ্চিত মাসিক ভাতা দেন, এটিই যেনো তাদের প্রাপ্য ! সর্বোপরি প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কানে বাজে বিভিন্ন সরকারের গোঁজামিলের সংজ্ঞায় তৈরি মুক্তিযোদ্ধাদেরই বীরত্বে ভাগবসানো প্রায় আশি/পঁচাশি হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অট্টহাসি । এসবই মুক্তিযুদ্ধের অপমান, স্বাধীনতার অপমান, বাঙালি জাতির অপমান । মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বিসহ জীবন যন্ত্রণা ----এটা তো সভ্যতারই অপমান !

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।