ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » ফিচার » বিস্তারিত

স্বাধীনতার মহানায়ক

২০২০ ডিসেম্বর ০২ ২৩:১৩:১৬
স্বাধীনতার মহানায়ক

ফিরোজ খান


একজন তরুণ রাজনৈতিক কর্মী,দেশের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত না হলেও দেশটার জন্ম ঠেকে থাকত না, কিন্তু তিনি না থাকলে বাংলাদেশের জন্মই হতো না। পাকিস্তান যে বাঙালি জাতির বিকাশে অনুকূল স্থান হবে না, তা তিনি দেশটির জন্মের পরপরই উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীতে এই উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে।

রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও তাঁর মৃত্যুর পরে কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাব তাঁর মনে যুগপৎ হতাশা ও স্বপ্ন তৈরি করেছিল। শেখ মুজিব বরাবর আত্মপ্রত্যয়ী এবং কখনো হাল ছাড়ার পাত্র নন। দুটি বিষয় তিনি তখনই উপলব্ধি করেছিলেন—পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং মুসলিম লীগ বাঙালির ভবিষ্যৎ নির্মাণের উপযুক্ত রাজনৈতিক দল নয়। ফলে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সামনে রেখে ১৯৪৯ সালেই জোতদার-উমেদারদের প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী দলটি থেকে বেরিয়ে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি জনগণের মুসলিম লীগ বা আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করলেন। তরুণ শেখ মুজিব দলের সামনের কাতারে বর্ষীয়ান নেতাদের রাখলেও এর চালিকা শক্তি যে তিনিই ছিলেন, তা পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়।

বায়ান্নর ঘটনাবলির পরে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রদেশের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ক্রমে মুসলিম জাতীয়তাকে ডিঙিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তার চেতনা জোরদার হয়েছে। এই প্রবণতার স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে—মুসলিম লীগ পূর্ববঙ্গ থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। তখন থেকেই এই প্রদেশে ধর্মভিত্তিকের পরিবর্তে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের একচ্ছত্র বিকাশ নিশ্চিত হয়েছে। মুজিব ও তাঁর অনুসারীরা তখনই দল থেকে সাম্প্রদায়িক পরিচয় মুছে দিলেন। আওয়ামী লীগ তখন পুরোপুরি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দলে পরিণত হয়েছে।

ষাটের দশকে সারা বিশ্বের মতো এ দেশের ছাত্র-তরুণ, শিল্পী-সাহিত্যিক, শিক্ষক–বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বামপন্থার দিকে ঝোঁক বেড়েছিল। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষদের মধ্যে তখন এই ধারার প্রভাব বেড়েছে। শোষণ-বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা-ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও সব সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে এই ধারাতে যে রাজনীতি, তার সঙ্গে শেখ মুজিব তাঁর জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে যুক্ত করতে সক্ষম হন। ছয় দফায় পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরা হলেও তাতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখাও অনুক্ত থাকেনি। তত দিনে ছাত্র-তরুণ, শিল্পী-বুদ্ধিজীবী, সেনাসদস্য-আমলা—সমাজের কার্যকর নানা স্তরে বাঙালির স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পক্ষে উদ্দীপনা দেখা গেছে। ছাত্র-তরুণদের স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস কিংবা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ এরই বহিঃপ্রকাশ। শেখ মুজিব এই দুটি এবং এ রকম সব উদ্যোগের বিষয়ে জানতেন, এতে যুক্ত হয়েছেন। এ ধরনের বিপ্লবী চিন্তা ও কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেও তিনি নিজে বিপ্লবের রাজনীতি বা সংগঠন নিয়ে মাথা ঘামাননি। এই ধারা তাঁর একান্ত নিজের নয়।

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পরে তিনি বঙ্গবন্ধু, জনগণের আস্থাভাজন প্রিয় নেতা এবং সবাইকে ছাপিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, এই জনপদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহানায়ক। এই সময়ে তাঁর নেতৃত্বের পেছনে দেশের মানুষ কাতারবন্দী হতে থাকে। তিনি মাঠপর্যায়ের তখনকার সময়ের শক্তিশালী প্রগতিশীল বামধারার রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী, ছাত্র-তরুণ ও শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফাভিত্তিক আন্দোলন তাঁর ছয় দফার পরিপূরক হয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে গতি ও তীক্ষ্ণতা দিয়েছিল। এই ঐক্য ও সংগ্রামী চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফলে।

একাত্তরের শুরুতে জুলফিকার আলী ভুট্টো সামরিক কর্তাদের যোগসাজশে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ ও বিজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টি করে সংঘাতের পথ রচনায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে এই নির্বাচনের ফলাফলেও পাকিস্তানের দুই প্রদেশের ঐক্য যে অবাস্তব এবং দেশটির ঐক্যবদ্ধ ভবিষ্যৎ যে সংকটাপন্ন, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও ২৬৭টি অর্থাৎ সব কটি আসনই জিতেছে পূর্ব পাকিস্তানে। আবার ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির কোনো ভিত্তিই ছিল না দেশের পূর্বাংশে। দুই প্রদেশে প্রতিনিধিত্বকারী কনভেনশন মুসলিম লীগ আগেই কাগুজে দলে পরিণত হয়েছিল এবং এই বাংলায় চিরকালের জন্য দলটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে বাঙালির ভবিষ্যৎ নিয়ে শেখ মুজিবের চিন্তার দূরদর্শিতা স্পষ্ট বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু কালের যাত্রাপথে নানা সংকটে বিপদে-বিপর্যয়ে অবিচল থেকে একে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। সেদিক থেকে তিনি বাংলাদেশের রূপকার, জনক।আমরা সবসময় মহান নেতার দেখানো পথে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশকে সুন্দর রূপে এগিয়ে নিয়ে যাবো এটাই হবে আমাদের নতুন প্রজন্মের চাওয়া পাওয়া।

লেখক : তরুণ লেখক, ঢাকা বাংলাদেশ।