ঢাকা, শুক্রবার, ৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রচ্ছদ » জাতীয় » বিস্তারিত

প্রকাশিতব্য মুক্তিযোদ্ধা খসড়া তালিকায় থাকা অমুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জামুকায় রিপোর্ট করুন 

২০২১ ফেব্রুয়ারি ১০ ১৫:৪৮:৩২
প্রকাশিতব্য মুক্তিযোদ্ধা খসড়া তালিকায় থাকা অমুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জামুকায় রিপোর্ট করুন 

স্টাফ রিপোর্টার : সাম্প্রতিক সমাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই অন্তে পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল হয়তো অচিরেই মুক্তিযোদ্ধাদের খসড়া তালিকা প্রকাশ করবে । সেই খসড়া তালিকা প্রকাশের সাথে সাথেই অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় থেকে-যাওয়া অমুক্তিযোদ্ধাদের নামধাম জামুকায় পাঠানোর পাশাপাশি একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রেরণের জন্য সংগঠনের চেয়ারম্যান আবীর আহাদ সর্বস্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ।

আজ এক বিবৃতিতে উপরোক্ত আহ্বান জানিয়ে আবীর আহাদ বলেন, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় কমবেশি আশি হাজার অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছে, যারা প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে ভাগ বসিয়ে ও তাদের পবিত্র নামের মর্যাদাহানি ঘটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা চরম চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিয়ে প্রজাতন্ত্রের অর্থ ও অন্যান্য সুবিধাদি লুট করে আসছে । এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ, দেশ ও জাতির শত্রু । এরা রাজাকারদের চেয়েও নিকৃষ্ট । এদের কোনোই ক্ষমা নেই । আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ছিলাম, পরবর্তীতে নানান উপায়ে আমরা হিসেব-নিকেশ করে দেখেছি যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নস্তরে বিভিন্ন বাহিনীতে যারা সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজারের মধ্যে । অথচ সরকারি তালিকায় সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লক্ষ ৩৫ হাজার। অর্থাত্ আশি/পঁচাশি হাজারই অমুক্তিযোদ্ধা, যাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও যুদ্ধের কোনোই সম্পর্ক নেই । বিভিন্ন সরকারের সময়ে গোঁজামিলের সংজ্ঞায় তারা অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে । আর তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের একশ্রেণীর অর্থলিপ্সু কর্মকর্তাবৃন্দ। আরো আছে রাজনৈতিক নেতা, এমপি, মন্ত্রী ও জামুকার কর্তাব্যক্তিরা । সত্যিকার অর্থে যদি বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তর সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই বাছাই করা হতো তাহলে এসব জাল-জালিয়াতির কোনো সুযোগই থাকতো না ।

বিবৃতিতে আবীর আহাদ বঙ্গবন্ধু সরকারের সেই মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাটি উল্লেখ করেন : Freedomfighter means any person who had served as a member of any force engaged in the War of Liberation.= মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি যেকোনো সশস্ত্র দলের (ফোর্স) সদস্য হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ।" বঙ্গবন্ধুর এ মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার মধ্যে মুজিবনগর সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন মুক্তিযুদ্ধের ১১ টি সেক্টরভুক্ত সব সামরিক বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, এফএফ, এমএফ, বিএলএফ (মুজিববাহিনী), ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ গেরিলা বাহিনীসহ দেশের মধ্যে গড়েওঠা কাদেরীয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, হালিম বাহিনী, আফসার বাহিনী, বাতেন বাহিনী, মাগুরা শ্রীপুর আকবর বাহিনী প্রমুখ সশস্ত্র বাহিনীর সব বীর মুক্তিযোদ্ধারাও পড়েন এবং সেসব সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সর্বমোট সংখ্যা ছিলো দেড় লক্ষের মধ্যে । অথচ সরকারি খাতায় এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ২ লক্ষ ৩৫ হাজারেরও উর্দ্ধে !

আবীর আহাদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকার নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা ও যাচাই বাছাই নির্দেশিকা তৈরি করে দেয়ার ফলে সেসবের ফাঁকফোকর দিয়ে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা বানাতে যেয়ে আজ এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে । এ অবস্থার জন্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারও দায়ী । মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিরাটসংখ্যক স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরের যেমন মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগ সরকারও অদ্যাবধি বিরাটসংখ্যক দলীয় নেতা-কর্মীদের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে আসছে । তারপরও আমরা সবচেয়ে বেশি দায়ী করবো উভয় সরকারের সময়কার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একশ্রেণীর কর্তাব্যক্তিদের । কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দূরে সরিয়ে রেখে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অনৈতিকতার আশ্রয় না নিলে এ বিপুলসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আসতে পারতো না । এসব স্তরের মুক্তিযোদ্ধারা শক্ত থাকলে সরকারের ক্ষমতাবানরাও কিছুই করতে পারতো না । অপরদিকে জামুকা নামক দানব সংস্থাও একই প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে সরকারের অনুসৃত নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে । মূল সমস্যাটা আসলে সরকারের মধ্যে । সরকার যদি মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সম্পর্কে শক্ত অবস্থানে থাকতো, বঙ্গবন্ধুর সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাকে পাথেয় করে অগ্রসর হতো তাহলে অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অনুপ্রবেশ করতে পারতো না । সরকার অমুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টির ফাঁকফোকর সৃষ্টি করে দেয়ার ফলে সুযোগ সন্ধানীচক্র সেই ফাঁকফোকর দিয়ে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় অপকর্ম করে এসেছে।

বিবৃতিতে আবীর আহাদ বলেন, জামুকার কিছু কর্মকাণ্ডের মধ্যে তাদের আন্তরিকতার দৈন্যতা ফুটে উঠেছে। কয়েক দফা তারিখ পরিবর্তন করে অবশেষে গত ৩০ জানুয়ারি থেকে এক তালিকা, অর্থাত্ বেসামরিক গেজেটধারীদের যাচাই বাছাই শুরু করেছেন । কিন্তু বেসামরিক গেজেটধারীদের যাচাই বাছাই তালিকা প্রেরণের নামে এবারও সেই তালিকার মধ্যে বিরাটসংখ্যক ভারতীয় ও লাল মুক্তিবার্তার মুক্তিযোদ্ধাদের নাম পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে । যদিও জামুকা থেকে বলা হচ্ছে যে, বেসামরিক গেজেটধারীদের যাচাই বাছাই কার্যক্রমের আওতায় ভারতীয় ও লাল তালিকাধারীরা পড়বেন না, তবু যাচাই যাচাই তালিকার মধ্যে তাদের বিরাটসংখ্যকের নাম পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে । অপরদিকে বিরাটসংখ্যক এক তালিকা তথা বেসামরিক গেজেটধারীদের নাম উক্ত যাচাই বাছাই কার্যক্রমে যায়নি । এর মধ্যে মন্ত্রীসহ অনেক ক্ষমতাবানরা রয়েছে যাদের নাম যাচাই বাছাই থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে । এটা কি ইচ্ছেকৃত, না করণিক ভুল তা বুঝা যাচ্ছে না । এ নিয়ে দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিশাল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে ।

আবীর আহাদ বলেন, ৩০ জানুয়ারিতে শুরু হয়ে অদ্যাবধি বিভিন্ন উপজেলা ও থানায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কার্যক্রম চলমান রয়েছে । যেসব এলাকায় যাচাই বাছাই সমাপ্ত হয়েছে তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন মন্ত্রী এমপি ও নেতারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে ২০১৭ সালের যাচাই যাচাই কমিটির সদস্যদের পুনর্নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়ার ফলে তারা তাদের পূর্বেকার বাণিজ্যিক কৌশলে ভুয়াদের পার করে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন । অপরদিকে যাচাই বাছাই কমিটিতে যারা নতুন সদস্য ছিলেন ও আছেন, সেখানে একটু ভালো পরিবেশে যাচাই বাছাই কার্যক্রম চলেছে । সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্তাব্যক্তিরা যা-ই করুক, আমরা লাল তালিকার মুক্তিযোদ্ধাদের বিকৃত আচরণে চরমভাবে বিস্মিত হয়েছি । ভুয়াদের পক্ষে লাল মুক্তিবার্তা তালিকার মুক্তিযোদ্ধারা, যারা অনেকেই ভুয়া, তারা অর্থের বিনিময়ে বেসামরিক গেজেটে অবস্থানকারী ভুয়াদের পক্ষে ঝেড়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন । আর এটাই প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, লাল মুক্তিবার্তায়ও বিপুলসংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অবস্থান রয়েছে এবং এরাই সব যাচাই বাছাইয়ের যাবতীয় অনৈতিক কার্যকলাপের সাথে বেশি জড়িত । এসব বিষয়গুলো ইতোমধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরকারের উচ্চমহলের দৃষ্টিগোচর হয়েছে বলে জানা গেছে । সুতরাং ভুয়ার পক্ষে যারা যতোই সাক্ষ্য দিক, সেসব সাক্ষীরা যাচাই বাছাই ফরমের শর্ত ও নীতিমালা অনুসরণ না করেই শুধু ক'টি টাকার বিনিময়ে যে অপকর্মের স্বাক্ষর রেখেছেন তাতে ভুয়ার পাশাপাশি তাদের কপালেও দুর্গতি নেমে আসছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই ।

তিনি বলেন, আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার। আমরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ভুয়াদের সাথে সহবস্থান করতে পারি না । এটা আদর্শের প্রশ্ন, এটা মর্যাদার প্রশ্ন । ফলে শুধুমাত্র বেসামরিক ও লাল মুক্তিবার্তার ভুয়া নয়----১৯৯৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও জামায়াত-আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তালিকাভুক্ত সব ভুয়াদের উচ্ছেদ করতে হবে । তবে চলমান বাণিজ্যনির্ভর যাচাই বাছাই আর নয়---- বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তর সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে একটি "বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা তদন্ত কমিশন" অথবা সামরিক ও অন্যান্য বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা তালিকার অমুক্তিযোদ্ধাদেরকে চিহ্নিত করে তাদের উচ্ছেদ করা হোক । যতোক্ষণ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় একজনও ভুয়া থাকবে ততোক্ষণ পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম ও লেখালেখি চলতেই থাকবে । অপরদিকে এটাও আমরা চাই যে, কোনোভাবেই যেনো একজনও বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকা বহির্ভূত না থাকেন । এটা আমাদের আত্মগরিমা ও আবেগের প্রশ্ন ।

(ওএস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২১)