ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

মোল্লাদেরকেও রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও চেতনার সাথে মিশে যেতে হবে

২০২১ এপ্রিল ১৮ ১৩:১৯:৩৫
মোল্লাদেরকেও রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও চেতনার সাথে মিশে যেতে হবে

আবীর আহাদ


ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতারা এসব দেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বা আদর্শের বাইরে নিজেদের একটা বলয় সৃষ্টি করেছেন । তারা রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাস করেও সেই রাষ্ট্রের আইন-কানুনের বাইরে শরিয়তি আইনে নিজেদেরসহ অন্যান্য সবাইকে চলতে নসিহত করে থাকেন । তারা এটুকুও বুঝতে অক্ষম যে, রাষ্ট্রটির মধ্যে কেবল মুসলমানরা নন, অন্যান্য ধর্মের মানুষও বসবাস করে । তাছাড়া রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকে না; রাষ্ট্র সব ধর্মের অনুসারীদের ধর্ম পালনের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা দিয়ে থাকে মাত্র । কিন্তু অর্ধশিক্ষিত মোল্লা সমাজ সবকিছুকে ধর্মের নামে গলিয়ে ফেলে ভেবে বসে যে, তারা বড়ো পুণ্যের কাজ করে চলেছেন !

সর্বক্ষেত্রে ইসলামী ধর্মকরণ করতে গিয়ে অর্ধশিক্ষিত মোল্লা সমাজ মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যক্তির নাম ও পোশাক নিয়েও নসিহত করে থাকে । মুসলিম পরিবারের শিশুদের নামের ক্ষেত্রে তারা ঘটা করে আরবী ভাষার নামের পক্ষে ফতোয়া দিয়ে থাকে । জোব্বা ও পাগড়িকে তারা ইসলামী পোশাক বলে গণ্য করে । এই মূর্খরা বুঝে না যে, আরবী নাম মানেই ইসলামী নাম নয় । হযরত মোহাম্মদ (স:) এর সময়ও আরবে বহু অমুসলিম, বিধর্মীরা বসবাস করতো, তাদের নামও ছিলো একই আরবী ভাষার নামে । এমনকি ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের পূর্বে হযরত মোহাম্মদ (স:) এর নামটিও ঐ আরবী নাম থেকে এসেছিলো । ইসলাম প্রবর্তনের পরে তো রাসুল ও তাঁর সাহাবীদের নামে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি ! এখন তো আরবী নামধারী লক্ষ লক্ষ ইহুদি-খৃস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ আরবজাহানে বসবাস করেন । সুতরাং আরবী নামের সাথে ইসলামের সম্পর্ক নেই । পোশাকের ক্ষেত্রেও তাই । আরবের উচ্চতাপের আবহাওয়াগত কারণে মুসলমান ইহুদি খৃস্টান ও অন্যান্য ধর্মের সবাই একই ধরনের জোব্বা ও পাগড়ির পোশাক ব্যবহার করেন । সুতরাং ইসলামী পোশাক বলতেও কিছু নেই । এগুলো হচ্ছে আরবীয় পোশাক ।

ইসলামী মোল্লারা আরেকটা মারাত্মক ফতোয়া দিয়ে থাকে । সেটি হলো, মুসলমান ছাড়া কেউ আল্লাহর কাছে গণ্য হবেন না বা তারা বেহেস্তে যেতে পারবেন না । অথচ পবিত্র কোরআনে এধরনের একটি আয়াতে আছে, যেমন, 'মুসলমান ইহুদি খৃস্টান সেবিয়ানস মেজিয়ানস স্ক্রিপচার্চ পলিথিস্ট, এর বাইরে আর যারা আছে, যারা আল্লাহ্ ও পরকালে বিশ্বাস করে, সৎ পথে চলে, তাদের কোনো ভয় নেই ।' এখানে কি শুধু মুসলমানদের কথা বলা হয়েছে ? মোল্লারা কথায় কথায় ধর্মের বিরোধিতাকারী, সমালোচনাকারী ও ভিন্ন ধর্মের লোকদের কাফের, মুরতাদ, নাস্তিক ইত্যাদি অভিধায় মণ্ডিত করে তাদেরকে হত্যা করা জায়েজ বলেও ফতোয়া দেয় । অথচ কোরআনের আরেক জায়গায় এভাবে বলা হয়েছে, কোন ধর্ম সঠিক কোন ধর্ম বেঠিক----কে মুত্তাকি কে কাফের তার বিচারের এখতিয়ার একমাত্র আল্লাহর ওপর ।' ধর্ম নিয়ে জবরদস্তি না করতে এবং যার যার ধর্ম তার তার কাছে বলেও কোরআনে উল্লেখ রয়েছে । কোরআনের এসব দার্শনিক বাণীর মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি সংঘটনে ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষা ফুটে উঠেছে । এজন্য বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় মূলনীতিমালার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ লিপিবদ্ধ করে গেছেন । ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয় । রাষ্ট্র ধর্মের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে সমাজে প্রচলিত সব ধর্মের নিরাপত্তা বিধান করবে । প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে । ধর্ম নিয়ে কেউ কারো ওপর চড়াও হতে পারবে না ।

অপরদিকে ধর্ম শিক্ষার বিনিময়ে ও ধর্মের নামে অর্থকড়ি না নিতেও পরিষ্কার বলা হলেও মোল্লা হুজুররা ওয়াজ মাহফিল বা বিভিন্ন সময় কারো কাছ থেকে অর্থ নিয়ে সেই অর্থদাতাকে তার চৌদ্দগোষ্ঠীসমেত বেহেস্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেন !

ধর্ম একটি দর্শন তাতে সন্দেহ নেই । কিন্তু ধর্মগুলো অর্ধশিক্ষিত কাঠ মোল্লাদের হাতে পড়ে সেটি তাদের ব্যবসায়ী পুঁজিতে পরিণত হয়ে পড়েছে । ফলে সততা, সভ্যতা, একতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ধর্ম যতোটা না বাধা, তার চেয়ে বহুগুণ বাধা এই মোল্লার দল । তারা একটু আলিফ বে তে ছেসহ কিছু সুরা ও মসলা মুখস্থ করে মনে করে তারা ধর্মকে পুরোপুরি শিখে ফেলেছে, তারাই ধর্মগুরু ও পণ্ডিত ! এরাই সমাজে ধর্মের সাথে ধর্মের বিরোধ ঘটিয়ে, আস্তিক-নাস্তিক, কাফের-মুরতাদ, বিধর্মী-অমুসলিম প্রশ্ন তুলে হানাহানি মারামারি রক্তারক্তি খুনোখুনি বাঁধিয়ে বিকৃতসুখ লাভ করে থাকে । মূলত: যে কাজটি আল্লাহর এখতিয়ারে সেই কাজটিই মোল্লারা নিজেদের এখতিয়ারে নিয়ে নিয়েছে । যেমন কোরআনে বলা হয়েছে, ইসলামকে তিনিই রক্ষা করবেন----অথচ তথাকথিত ইসলামী পণ্ডিত 'আল্লামা' হেফাজতিরা আল্লাহ্ নাম ধারণ করে তারাই ইসলাম রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে 'হেফাজতে ইসলাম' সৃষ্টি করেছেন । যে এখতিয়ারটি আল্লাহর, সেটি এখন তেঁতুল হুজুর আহমদ শফির অনুসারীদের এখতিয়ারে ! আর বর্তমানে লম্পট ও ফাসেক চরিত্রের অধিকারী বাবুনগরী ও মামুনুল হক গংদের এখতিয়ারে ইসলাম পরিচালিত হচ্ছে !

বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে । সেই মুক্তিযুদ্ধে মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান জৈন ইহুদি---আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সবার অপরিসীম শৌর্য রক্ত ত্যাগ ও বীরত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে । এই যে সর্বধর্ম অনুসারী-সমন্বিত ঐক্যবদ্ধ অবস্থান-----এর মূলে রয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা । আরো রয়েছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আর্থসামাজিক সমতার আকাঙ্খা । এজন্য বাঙালি জাতির পিতা বাংলাদেশের সংবিধানে ঐসব আদর্শ ও চিন্তাচেতনার নির্জাস হিশেবে রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতি সৃষ্টি করেছেন, তাহলো : গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ । এই মূলনীতিমালার সাথে কোনো ধর্মের যেমন বিরোধ নেই, তেমনি বিশেষ কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাত নেই বা কোনো ধর্মকে ঝেটিয়ে বিদায় দেয়ার কোনো উদ্দেশ্য নেই ।

সুতরাং এ আলোচনার মাধ্যমে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির সাথে প্রকৃত ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মের সাথে সম্পর্ক, বিরোধ বা সাংঘর্ষিক কোনো কিছু নেই । ধর্ম হলো যার ব্যক্তি ও সম্প্রদায়গত ব্যাপার । কিন্তু একটি জাতির রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আদর্শ ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার সাথে সেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসকারী সব ধর্মাবলম্বী মানুষের পারস্পরিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, জাতীয় ঐক্য, শান্তি-শৃঙ্খলা ও জাতীয় চেতনার প্রশ্ন জড়িত বিধায় রাষ্ট্রটি হবে অবশ্যই জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটি দেশ । এ-নিরিখে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উপরোক্ত আদর্শ ও চেতনার ভিত্তিতে । সুতরাং অন্যান্য শ্রেণী-পেশা-সম্প্রদায়সহ এদেশের নাগরিক হিশেবে সব ধর্মের মোল্লা-পুরোহিত ভিক্ষু ও যাজকদেরও এই দেশের আদর্শ ও চেতনার সাথে মিশে যেতে হবে ।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।