ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » সম্পাদকীয় » বিস্তারিত

আমার চোখে দেখা কানাইপুরের গণহত্যা

২০২১ মে ০৮ ০১:২০:২২
আমার চোখে দেখা কানাইপুরের গণহত্যা

প্রবীর সিকদার


সিকদার বাড়ি বললেই ফরিদপুরের প্রায় সবাই আমাদের বাড়ি চিনতে পারেন! উনসত্তর, সত্তর ও একাত্তর, খুবই ব্যস্ত ছিল আমাদের বাড়ি। উনসত্তরের কথা আমি মনে করতে পারি না। সত্তরের নির্বাচনের কিছু কিছু মনে করতে পারি। একাত্তর মনে করতে পারি পুরোটাই! আমাদের বাড়িতে কে আসতেন না, জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্য কেএম ওবায়দুর রহমান, প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্য ইমাম উদ্দিন আহমেদ।

আসতেন স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা এনামুল কবির ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের প্রাণপুরুষ ও বাবা কাকার খুবই প্রিয় ছাত্র আব্দুল আলী মোল্লা অর্থাৎ আমাদের প্রিয় আলী কাকা! আসতেন ছাত্রনেতা এহতেশাম খান, সিরাজুল ইসলাম লাল, চিত্ত রঞ্জন পোদ্দার, দুলাল চন্দ্র সরকার, ইকরাম আলী খান, নেছার উদ্দিন, নজির হোসেন! ওই সময়ে আমার মায়ের প্রধান কাজ ছিল চা তৈরি করা। প্রতিদিন তাকে দেড় দুইশ' কাপ চা তৈরি করতে হতো! প্রায় প্রতিদিন সকালে বাবা কাকার ছাত্র সব ছাত্রনেতারা আমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যেতেন, বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে যেতেন সন্ধ্যার পর; আমি নাকি শ্লোগান ভালো দিতে পারি! সকাল থেকে সন্ধ্যারাত পর্যন্ত গ্রামের পথে পথে মিছিলে আমি শ্লোগান দিতাম ছাত্রনেতাদের কাঁধে চড়ে! পথে পথে মানুষ গরম রুটি আর গুঁড় খেতে দিতো। 'জয় বাংলা জয় বাংলা', 'জয় বঙ্গবন্ধু জয় বঙ্গবন্ধু', 'শেখের নৌকায় ভোট দিন ভোট দিন' ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ' ইত্যাদি নানা শ্লোগানে মুখর থাকতো মিছিল। একসময় ছোটমনে মনে হতে থাকে, আমাদের বাড়ির পুরোটাই বুঝি আওয়ামীলীগ! ঘরে আনা ছিল ঘুড়ি বানানোর বাঁশতা কাগজ। দুটি কাগজ আঠা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে ভাই সুবীরের সাহায্য নিয়ে কালো রং দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লিখেছিলাম 'আওয়ামীলীগ'! বাবা কাকারাও আমার আওয়ামীলীগ লেখা সেই বড় কাগজ দেখে হেসে হেসে যুগিয়েছিলেন অনুপ্রেরণা। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, বাড়ির সামনের দিকে ছাদের কার্নিশে সেটা ঝুলিয়ে দিবো! আজ কাল করতে করতেই আমাদের সামনে হাজির হবে ভয়ঙ্কর এক মে মাস, সেটা কে জানতো!

ঢাকায় গণহত্যা চলছে ২৫ মার্চ রাত থেকেই! মেঝমামা নিখিল পোদ্দার ঢাকা থেকে পালিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে সবাইকে পাকিস্তানী সৈন্যদের নৃশংসতার বর্ণনা করেছেন। সেই সময়েই আমরা গল্প শুনেছি, গোয়ালন্দের পদ্মাপারে মুক্তিযোদ্ধারা কামান পেতে বসে আছেন, কিছুতেই যেন পাকসেনারা ফরিদপুরে ঢুকতে না পারে! তখনো উজ্জীবিত ফরিদপুরের মানুষ! কানাইপুরেও চলে মিছিল! এমন অবস্থার মধ্যেই ২১ এপ্রিল ১৯৭১ আকাশ ও নৌপথে ফরিদপুরে ঢুকে পড়ে পাকসেনারা। আমরা সেদিন পালিয়ে দূরের গ্রাম গোপালদীতে এক হিন্দু বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেদিন রাতে গোপালদী গ্রামের মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই ফরিদপুরের ঘরবাড়ি পোড়ানোর ভয়াবহ লেলিহান শিখা দেখেছিলাম। সে কী আতঙ্ক সবার মনে! পরদিন দুপুরের মধ্যেই আমরা খবর পেলাম, আমাদের সিকদার বাড়িসহ কানাইপুর ও আশেপাশের গ্রামের সকল হিন্দু বাড়ি লুটপাট হয়ে গেছে। এই খবর পেয়েই আমার বাবা কাকা সিদ্ধান্ত নিলেন, আর কানাইপুরের বাড়িতে ফেরা নয়! কিন্তু সিকদার বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ অভিভাবক অজিত সিকদার দিলেন ভিন্ন মত, তার কাছে তার পেয়াদারা এসেছিলেন, তারা নাকি বলে গেছেন, যা হবার হয়েছে, আর কোনও অসুবিধা হবে না। আমরা বাড়ি ফিরে গেলে ওরা আমাদের দেখভাল করবে। আমার বাবা কাকারা তাদের বাড়িতে না ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারলেন না। অজিত সিকদারের পীড়াপীড়িতে বাড়ি ফিরতে রাজী হলেও তারা বলেছিলেন, বাড়ি ফিরে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব গুছিয়ে আমরা ভারতে চলে যাব। আমরা দুই তিন দিনের মধ্যেই গোপালদী থেকে ফিরে এলাম কানাইপুর সিকদার বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মধ্যে।

৮ মে ১৯৭১। চোখ মেললেই যেন মনে হয় গতকালের ঘটনা এটি। হটাত চারদিকে গুলির শব্দ! সেই সাথে কানে আসছে কান্নার শব্দ! পালাচ্ছে শুধুই হিন্দুরা! পালাতে পালাতে চিৎকার করে বলছে ওরা, মিলিটারি আইছে, বিহারি আইছে! পালাও সবাই! আমাদের বাড়িতে তো লুটপাট হয়েছে আগেই। আজ তাহলে আর কী করবে! বড় কাকা, ছোট কাকা, ঠাকুরমা,‌ মা আর আমরা পাঁচ ভাই বোন বাড়িতে! বাবা বাড়িতে নেই, উনি বাজারে গেছেন। বাড়ির সবাই বাকরুদ্ধ! এখন কী করা! বড় কাকা সিদ্ধান্ত নিলেন, আমরা পালাবো না, যা হবার হোক বাড়িতেই! এর মধ্যেই আমার আনন্দ মামা হাফাতে হাফাতে এসে বললেন, বিহারি গ্রামে ঢুকেছে, মানুষ খুন করছে, পালাতে হবে এখনই! বাবার জন্য কেঁদে উঠলেন আমার মা। ঠাকুরমাও কেঁদে বললেন, পরেশের যা হয় হোক, তোরা পালা; আমি বাড়িতেই থাকি! আমি ঠাকুরমাকে ছাড়া কোথাও যাবো না, আঁচল ধরলাম ঠাকুরমার! সিদ্ধান্ত হলো, পালাবো সবাই।

বাড়ি অরক্ষিত রেখেই আমরা বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে উত্তরপাড়ার দিকে রওনা দিলাম। মায়ের কোলে ৬ মাসের ছোট ভাই পীযূষ। ঠাকুরমার কোলে ছোট বোন দীপ্তি। বড় কাকার কোলে আরেক বোন দেবী। ছোট কাকার হাতধরে ভাই সুবীর। আর আমি ঠাকুরমার আঁচল ধরে হাত ধরে পালিয়ে যাচ্ছি অজানা গন্তব্যে! আমাদের বাড়ির সীমানা পার হলেই একখণ্ড জমি; সেই জমি পার হতে না হতেই গুলির শব্দ! যে যার মতো ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলাম! বড় কাকা হটাত আমাকে টেনে নিয়ে এক ঝোপের আড়ালে চলে গেলেন! যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত পোহায়! সাদা পোশাকের এক লোক রাইফেল উঁচিয়ে গুলি করছেন! আমাদের পাশেই আর একটি ঝোপে লুকিয়ে ছিলেন আমাদের গ্রামেরই দীনবন্ধু সাহা! সেই লোকটি গুলি করলো তাকেই। সে কী বীভৎস দৃশ্য! আর ওই দিকে তাকাতে পারিনি! বড় কাকা দ্রুততার সাথেই আমাকে টেনে নিয়ে ঝোপ পার হয়ে উত্তরপাড়ার দুলাল কাকাদের বাড়ির সামনের পথ ধরলেন! কিছুদূর যেতেই পথ আগলে দাঁড়ালেন বড় কাকা ও বাবারই ছাত্র লাল মিয়া! তার সাথে রাইফেল হাতে সাদা পোশাকের আর একজন। লাল মিয়াকে দেখে আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম, বাবা কাকার ছাত্র লাল মিয়া, আমাদের কিছু বলবে না নিশ্চয়ই! লাল মিয়া যখন 'শালার মালাউন, হিন্দুরা ইসলামের শত্রু, হিন্দুরা পাকিস্তানের শত্রু' বলে হুংকার দিলেন, তখন আমার মোহভঙ্গ হলো! লাল মিয়া ও ওই সাদা পোশাকের সশস্ত্র লোকটি আমাদের নিয়ে আমাদের বাড়ি দিকেই রওনা দিলেন।

ওরা আমাদের ঠেলতে ঠেলতে সিকদার বাড়ির বটকৃষ্ণ দাদুর রান্নাঘরের বারান্দায় নিয়ে বসালো। কিছু সময়ের মধ্যেই দেখলাম, আরও সশস্ত্র লোক হাজির; তাদের সাথে এক এক করে সেখানে এলো আমার মা, ঠাকুরমা, ছোট কাকা, আমার চার ভাই বোন, আনন্দ মামা, দুলাল কাকা, চিত্ত দাদু, বিভূতি কাকা, আমাদের বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ অভিভাবক অজিত সিকদার। সবাইকে একত্রিত করার পর বুঝতে পারলাম, গোপালদীতে যারা অজিত সিকদারকে বাড়ি ফিরে আসার অনুরোধ করতে গিয়েছিলেন, তারা আসলে একটা ফাঁদ পেতেছিলেন! ওই ফাঁদে আমরা সবাই আটকে গেছি! বড় কাকা ও বাবার ছাত্র লাল মিয়া আজ ওই সশস্ত্র দলের নেতা, যদিও তার হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। সেখানে আবার শুরু হলো সেই বয়ান, 'শালার মালাউন, হিন্দুরাই ইসলামের শত্রু, হিন্দুরাই পাকিস্তানের শত্রু'! ওদের বয়ানে সেখানে নতুন যোগ হলো, 'এদেরকে এখনই খুন করতে হবে।' মুহূর্তে শুরু হয়ে গেলো খুনের আয়োজন! বড় কাকা বিকারহীন চিত্তে লাল মিয়াকে বললেন, 'দাদা বাজারে গেছেন, তার কি হয়েছে কিংবা কি হচ্ছে তা জানি না! তুমি আমাদের সবাইকে একসাথে খুনের ব্যবস্থা কর।' এবার মনে হলো, বড় কাকার অনুরোধ রাখলেন লাল মিয়া! শুরু হয়ে গেল তোরজোড়, খুন করা হবে আমাদের সবাইকে, একই সাথে! পাশের একটি ভিটির সামনে আমাদেরকে কয়েক সারিতে দাড় করানো হলো! প্রত্যেক সারির সামনে রাইফেল হাতে এক একজন দাঁড়িয়ে। লাল মিয়া ও তার সহযোগীরা লাইন ঠিক করছেন। আমরা যারা ছোট ছিলাম, তাদেরকে এক এক জনের বুকে তুলে দিলেন লাল মিয়া। আমি রইলাম বড় কাকার বুকে; তিনি তার দুই হাত দিয়ে আমাকে তার বুক বরাবর উঁচু করে ধরেছেন। ওদের কথাতেই বুঝেছিলাম, আমরা যারা ছোট, তারা ওদের রাইফেলের নিশানায় না থাকায় এই উপরে তুলে ধরার ব্যবস্থা! আমাদের লাইনে সবার আগে বড় কাকা, বড় কাকা তার বুকে ধরেছেন আমাকে। অর্থাৎ আমিই সবার আগে! আমি দেখছিলাম, রাইফেল উঁচিয়ে তাক করা হয়েছে, ট্রিগারে আঙুল! শুধু আমি নই, যাদের চোখের সামনে গুলি বোঝাই রাইফেল নড়াচড়া করছে, তারা সবাই ছিলেন নির্বিকার! তাদের কোনও আকুতি নেই বেঁচে থাকার; সে যেন অনেকটাই ছবি তোলার জন্য ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা!

রাইফেলের লাইন থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো আমাদের বাড়ির অভিভাবক অজিত সিকদারকে। মুহূর্তে সেখানে হাজির হলেন রুস্তম খা নামের এক বয়স্ক ব্যক্তি! তিনি উচ্চস্বরে বললেন, মেয়ে মানুষ আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মারা যাবে না! তিনি আদেশ করলেন, নাকি অনুরোধ করলেন, সেটা বুঝলাম না! রুস্তম খার যে কথা সেই কাজ শুরু হয়ে গেল! বড় কাকার অনুরোধ উপেক্ষা করে আমি ও আমার চার ভাইবোন, আমার মা ও ঠাকুরমাকে লাইন থেকে সরিয়ে নিয়ে পাশের বটকৃষ্ণ দাদুর রান্নাঘরের বারান্দায় ফের বসানো হলো। হটাতই সেখানে রামদা হাতে হাজির হলেন সলিম সেখ! সে তো আমাদের কতো চেনা কতো কাছের সলিম কাকা; আমাদের খেজুর গাছ কাটেন! কতো মিষ্টি খেজুরের রস খাওয়ান তিনি আমাদেরকে! সেই সলিম কাকার আজ এ কোন মূর্তি দেখছি! চোখ দিয়ে যেন তার বের হচ্ছে রক্ত! ডানহাতে রামদা উঁচিয়ে বড় কাকাসহ সবাইকে বাহাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে রান্নাঘরের পাশেই থাকা তুলশী ভিটির সামনে নিয়ে এলেন। আরও কয়েকজনের হাতে দেখলাম লোহার রড ও ছুরি। ততক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গেল, রাইফেলের গুলি নষ্ট করা হবে না, খুন করা হবে রামদা দিয়েই। রামদা হাতে তৈরি হচ্ছেন সলিম কাকা! তৈরি হচ্ছেন লোহার রড ও ছুরি হাতে যারা। বড় কাকা এগিয়ে এসে আমাদের দিকে অপলক তাকিয়ে ঠাকুরমাকে প্রণাম করে ফিরে গেলেন সলিমের কাছে। সলিম বড় কাকার ঘাড়ে রামদা দিয়ে কোপ দিতেই ফিনকি দিয়ে বের হলো রক্ত! বড় কাকা মা মা বলে আর্তনাদ করে উঠলেন! আমরা সবাই একসাথে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম! সলিম একে একে অন্যদের কোপাতে শুরু করেছে! আমি বারান্দা থেকে লাফিয়ে নেমে বড় কাকাকে জড়িয়ে ধরলাম। বড় কাকার উষ্ণ রক্তে ভিজে গেল আমার শার্ট, শরীর! ওই প্রথম অনুভব করা, স্বজনের রক্তের উষ্ণতার মধ্যেও কী দারুন মায়াবী পরশ! বড় কাকাও আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোদেরকে মানুষ করে যেতে পারলাম না! ছুরি হাতে থাকা খালেক আমাকে বড় কাকার কোল থেকে কেড়ে বারান্দায় অনেকটাই ছুড়ে ফেলে দিলেন! মুহূর্তে রাইফেল ওয়ালা মানুষগুলো রান্নাঘরের বারান্দায় এসে আমাদেরকে রাইফেল উঁচিয়ে ঘিরে ধরলো। আমাদের চোখের সামনে রাইফেলের বেয়োনেট ধরে ভয়ঙ্কর চিৎকারে গর্জে উঠলো ওরা, কেউ কাঁদতে পারবি না; কাঁদলেই চোখ তুলে ফেলবো! মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেল আমাদের গগনবিদারি আর্তনাদ; শুধুই কাপড়ে চোখ মুছে কান্না লুকোনোর চেষ্টা আমাদের।

সলিম যখন রামদা দিয়ে কোপাচ্ছিল, রামদায়ের কোপ হাত দিয়ে ঠেকিয়ে দৌড়ে নদীর দিকে পালিয়ে গেলেন আমাদের চিত্ত দাদু। তার পেছনে পেছনে ছুটে গেল কয়েক জন। চিত্ত দাদুর পালিয়ে যাওয়ার পর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন লাল মিয়া। এবার তিনি নির্দেশ দিলেন তাদেরকে, যারা হত্যাকাণ্ড দেখতে এসেছিলেন, তারা যেন ওই জায়গাটি ঘিরে রাখে। যে কথা সেই কাজ। সবাই ওই তুলশী তলা ঘিরে দাঁড়ালেন, যাতে আর কেউ পালিয়ে যেতে না পারেন! এখনো, আমার মনে হয়, সেটা বুঝি ছিল হাট বাজারে ওষুধ বিক্রির মজমা কিংবা জলসা! চারদিকে দাঁড়িয়ে সবাই সলিমের বীরত্ব দেখছে! কিভাবে যেন ওই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ছোট কাকা! আমি সশস্ত্র রক্ষীদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ছোট কাকার কাছে গিয়ে বললাম, তুমি চিত্ত দাদুর মতো পালিয়ে যাও! ছোট কাকা আমার কথা শুনলেন, কিন্তু বললেন না কিছুই! নির্বিকার ছোট কাকা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন ওই বারান্দায়। মা ঠাকুমার কাছে আমাকে রেখেই ছোট কাকা সলিমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।! সলিম রামদা দিয়ে পিঠ বরাবর কোপ দিতেই ছোট কাকা মাটিতে আছড়ে পড়লেন! সেখানে সবাই সলিমের রামদায়ের কোপে মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছিলেন। তারপর সবার মৃত্যু নিশ্চিত করতে চলল সলিমের উপর্যুপরি রামদায়ের কোপ আর খালেক ও তার সহযোগীদের ছুরি-রডের নৃশংস তাণ্ডব! এক এক করে মৃত্যু নিশ্চিত করে ওরা যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন, তথন সেখানে হাজির করা হলো সিকদার বাড়ির অভিভাবক অজিত সিকদারকে। এখন আমার খুব মনে হয়, রক্তাক্ত লাশগুলো দেখাতেই লাল মিয়ারা সেখানে তাকে হাজির করেছিলেন। তার বাড়ির আপনজনদের রক্তাক্ত লাশ দেখে অজিত সিকদার মূর্ছা যান! সলিম, খালেক ও অন্যান্যরা অজিত সিকদারকে তুলে নিয়ে যান আমাদের আমাদের চোখের আড়ালে। পরে শুনেছি, সামান্য দূরেই অজিত সিকদারকে জবাই করে রক্ত পান করেছিল সলিম!

হত্যাকাণ্ড শেষ হয়ে গেলে আমি আর বড় কাকা ও বাবার ছাত্র লাল মিয়াকে দেখিনি। আমাদের পাশ থেকে চলে গেছেন রাইফেল ওয়ালারাও! শত শত মানুষ আসছেন আমার কাকা মামাদের রক্তাক্ত লাশ দেখতে! যেন ওরা সবাই চিরিয়াখানার দর্শক! দর্শকদের সামনে পড়ে আছে আমার বড় কাকা দীনেশ সিকদার, ছোট কাকা জীবেশ সিকদার, মামা আনন্দ পোদ্দার, কাকা দুলাল সিকদার, বিভূতি সিকদারের লাশ! আমাদের চোখের আড়ালে পড়ে আছে অজিত সিকদারের লাশ! হটাত কোথা থেকে এসে হাজির হলেন আমাদের সাধুদার মা। তিনি আমাদের কাকিমা। তিনি যেন তখন আমাদের কাছে শুধুই একজন দেবদূত! কাকিমা রক্তাক্ত লাশগুলো দেখে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদলেন। কাঁদতে কাঁদতেই উঠে এলেন আমাদের কাছে। তিনি আমাদের সবাইকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন পাশেই চিত্ত দাদুদের বাড়ির একটি ঘরে। যাওয়ার সময় লক্ষ্য করেছি, আনন্দ মামার মাথায় কান বরাবর রামদায়ের কোপের চিহ্ন! মাথাটা কান বরাবর দুই ভাগ হয়ে আছে!

চিত্তদাদুদের ঘরে ঢুকতেই শুকনা মরিচের গুঁড়ার গন্ধ নাকে এলো! মেঝেতে তাকিয়ে দেখলাম মরিচের গুঁড়া মেঝেয় ছড়িয়ে রয়েছে! বুঝতে বাকি রইলো না, লুটপাটের সময় লুটেরারাই ছড়িয়েছে ঘরের মরিচের গুঁড়া। ঘরের এক কোণায় একটি খেজুরের পাটি মোড়ানো রয়েছে! আমরা ভেতরে ঢুকেই কান্নাকাটি করছি! হটাত দেখি খেজুরের পাটি নড়াচড়া করছে! কিছু বুঝে ওঠার আগেই খেজুরের পাটির ভেতর থেকে মুখ বের করে খুবই নিচু স্বরে কথা বললেন আমাদের তারিণী কাকা! কৃষি বিভাগে চাকুরি করতেন তিনি। ময়মনসিংহের মানুষ তারিণী বর্মণ ভাড়া থাকতেন আমাদের বাড়িতেই! তাকিয়ে দেখলাম ঘরের কোথাও তার স্ত্রী সন্তানেরা নেই! পরে সাধুদার মা কাকিমার মুখেই শুনেছি, তিনিই তারিণী কাকাকে এখানে এনে খেজুরের পাতার পাটির ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছেন।

চিত্তদাদুদের ওই ঘরে আমরা সবাই আছি। আমাদের পাহারা দিচ্ছেন কাকিমা। বিভিন্ন লোকজন আসছেন, কাকিমা তাদের সাথে কথা বলছেন! কেউ কেউ ঘরে ঢুকেও দেখতে চাইছেন! কাকিমা তাদেরকে অনুনয় বিনয় করে বলছেন, ওরা যাদেরকে খুন করেনি, ওই বাচ্চা আর মেয়ে মানুষগুলোকে আমি এখানে এনে রেখেছি। ওরা সবাই শোকে ভেঙে পড়েছে। বাবারা তোমরা আর ওদেরকে বিরক্ত করো না! ওদের মধ্যে অনেকেই ভালো মানুষ ছিলেন। তারাও অন্যদেরকে ওই ঘরে ঢুকতে বাধা দিলেন। ওদের বাধা ও কাকিমার কথায় অন্যরা ফিরেও গেলেন! লোকজনের যাতায়াত ও কথার সূত্রেই আমরা জানতে পারলাম, রামদায়ের কোপ খেয়ে পালিয়ে যাওয়া চিত্ত দাদু তথা সরোজিত সিকদার পাশের কুমার নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। নদীতে কচুরি পানা থাকায় কেউ তাকে আর খুঁজে পায়নি। সন্ধ্যার পর তিনি নদী থেকে উঠে হোগলাকান্দির দিকে চলে যান! আরও জানা গেল, আমাদের পাশের গ্রাম ইব্রাহিমদীর ফজলু মুন্সী, কেউ কেউ তাকে পীরও বলেন, তিনিই কানাইপুরে হিন্দুদের বাড়িঘর লুটপাট ও হিন্দু খুনের মূল হোতা! তিনিই ফরিদপুরের আলাউদ্দিন খাঁয়ের সাথে যোগাযোগ করে কানাইপুরে সশস্ত্র বিহারি এনেছেন! আমরা তখন বুঝতে পারলাম, রাইফেল হাতে যাদেরকে দেখেছি, তারাই বিহারি! ফজলু মুন্সীর ছেলে লাল মিয়া অর্থাৎ আমার বাবা কাকার ছাত্র লাল মিয়া মাঠ পর্যায়ে খুনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, মানে লাল মিয়াই ছিলেন সেনাপতি! তখন আরও জানতে পারলাম, আমাদের চোখের সামনে যারা খুন হয়েছেন, তারাই সব নয়; সেই দিন আরও হিন্দু খুন হয়েছেন! আমার বাবা পরেশ চন্দ্র সিকদার, আমার দাদু মনোরঞ্জন পোদ্দার ও গ্রাম্য সম্পর্কে আমার মামা পরেশ চন্দ্র পোদ্দার ওরফে নিতাই পোদ্দারকে বিহারিরা বাজার থেকে ট্রাকে তুলে নিয়ে গেছে। আর তাদের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেদিন বিহারি ও লাল মিয়া বাহিনীর হাতে আরও যারা খুন হয়েছেন, তারা হলেন, কানাইপুরের অশোক সিকদার, নিমাই চন্দ্র পোদ্দার, অজিত পোদ্দার, ধীরেন্দ্র নাথ সাহা, খগেন্দ্র নাথ পোদ্দার, নৃপেন্দ্র নাথ পোদ্দার, অরবিন্দ পোদ্দার, ভাটিকানাইপুরের অমূল্য কুণ্ডু, কিশোরী মোহন কুন্দু, অজিত দেবনাথ, অনিল দেবনাথ, সুনীল দেবনাথ, হোগলাকান্দির পূর্ণ চন্দ্র সরকার, মনমথ সেন, আনন্দ দত্ত। আনন্দ দত্ত অর্থাৎ আমার প্রিয় আনন্দ কাকাও নেই! এই খবরে আমি আরেক দফা কেঁদে উঠলাম! বাবা কাকার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আনন্দ কাকা তো আমাদের পরিবারেরই সদস্য! ইংরেজির দুর্দান্ত শিক্ষক আনন্দ কাকার ক্লাসে আমি মুগ্ধ হয়ে তারদিকে তাকিয়ে থাকতাম! সুন্দর চেহারা, স্মার্ট ও অত্যাধুনিক পোশাক, শরীরে বিদেশি সুগন্ধি, ইংরেজি ও বাংলায় তার সেরা বাচনভঙ্গী, সে কী আকর্ষণ ছিল আমার তার দিকে! সেইদিন আরও নিখোঁজ হন, সিকদার বাড়ির কনকভূষণ সিকদার ও অনুকূল চন্দ্র সিকদার; তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেইসব স্মৃতি আজও আমাকে কাঁদায়! ভয়ে আঁতকে উঠি! বাবাকে বাবা ডাকতে না পারার যন্ত্রণা আমাকে বহুদিন কাঁদিয়েছে। এই জন্যই হয়তো যন্ত্রণার সঙ্গী করতেই একাত্তরে বাবা হারানো অনিতাকে জীবনসঙ্গী করেছিলাম; কানাইপুরেরই মেয়ে অনিতার বাবা ধীরেন্দ্র নাথ সাহা আমার বাবা কাকাদের সাথেই জীবন হারান। বাবা ডাকতে না পারার যন্ত্রণা বহুদিন পরে খানিকটা ভুলেছিলাম, আমার প্রথম ছেলে সুপ্রিয়র জন্মের পর। ওকে বাবা বলতে বলতেই এখন আমি এখনো আমার বাবাকে বাবা ডাকতে না পারার যন্ত্রণা ভুলে থাকি।

চিত্তদাদুদের ঘর আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে; সেটাই জানান দিচ্ছে, ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যা। এতক্ষণ কাঁদছিলাম স্বজন হারানোর বেদনায়, এবার আমাদের পাঁচ ভাই বোনের কান্না শুরু ক্ষুধায়! সারাদিন আমরা কিছুই খাইনি! এমনকি এক গ্লাস জলও নয়! খাবার দাবার নিয়েই কাকিমা কার কাছে যেন কী বলছিলেন! এক দেড় ঘণ্টা পর উত্তরপাড়ার নরেশ কাকার বাবা আমাদের জন্য কতো খাবার নিয়ে এসেছেন! আমরা খাওয়া শুরু করেছি, এর মধ্যেই খবর এলো, কারা যেন আমার কাকা মামাদের লাশ বটকৃষ্ণ দাদুদের বাড়ির কুয়ায় ফেলে দিচ্ছে। খবর পেয়ে আমি ছুটে গিয়েছিলাম, সেই তুলশী তলায়, যেখানে পড়েছিল সবার লাশ! যারা লাশগুলোকে কুয়ায় ফেলছিল, তাদের কাউকে আমি চিনতে পারিনি! কে যেন একজন ধমক দিলে আমি এক দৌড়ে আবার ওই ঘরে ঢুকে খাওয়া শুরু করি; যা ক্ষুধা পেটে! আমরাই শুধু পাঁচ ভাইবোন খেয়েছিলাম; আর কেউ খায়নি! রাত বাড়লে কারা যেন এলেন, কথা বললেন কাকিমার সাথে। কাকিমা তারিণী কাকাকে কিছু বলতেই তিনি উঠে পড়লেন। বের হয়ে চলে গেলেন তাদের সঙ্গে। পরে কাকিমার মুখেই শুনেছিলাম, নদী পার হয়ে তারিণী কাকা তার স্ত্রী সন্তানদের কাছে চলে গেছেন।

সারারাত আমাদের কারো ঘুম হয়নি! সবাই শোক আর উদ্বেগে কাতর। সকাল হতে না হতেই কয়েকজন লোক কাকিমার কাছে এসে আমাদের সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছেন। আমরা প্রথমে একটু আতঙ্কিত হলেও পরে জানতে পারলাম, কানাইপুর ইউনিয়নের পাশের ইউনিয়ন ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান রাজ্জাক মিয়া তাদেরকে পাঠিয়েছেন, আমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রাজ্জাক মিয়া নামটি আমাদের পরিবারের সবার খুবই পরিচিত ও প্রিয়। রাজ্জাক মিয়ার বাড়ির পাশের স্কুল ধোপাডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়। সেই স্কুলের প্রধানশিক্ষক ছিলেন আমার বড় কাকা দীনেশ চন্দ্র সিকদার। ওই ধোপাডাঙ্গাতেই আমার ছোট পিসি বাড়ি। আমাদের ভাবনায় তখন পিসি বাড়ি। তাই রাজ্জাক মিয়ার পাঠানো লোকজনের সাথেই আমরা রাজ্জাক মিয়ার বাড়ি ধোপাডাঙ্গার চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বের হওয়ার সময় দেখলাম, কোথাও কোনও লাশ নেই! শুধুই জমাট বাধা রক্ত আর পিঁপড়ের সারি! সেই সাথে কানে বাজছিল সেই ভয়ঙ্কর বয়ান, 'হিন্দুরাই ইসলামের শত্রু, হিন্দুরাই পাকিস্তানের শত্রু!'