ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

দুর্নীতিবাজ-লুটেরাচক্র কেন ধরা ছোঁয়ার উর্দ্ধে ?

২০২১ মে ২৮ ১৪:৪৬:৩০
দুর্নীতিবাজ-লুটেরাচক্র কেন ধরা ছোঁয়ার উর্দ্ধে ?

আবীর আহাদ


চারদিকে দুর্নীতি ও লুটপাট । সভ্যতা ও ভব্যতার দলন । নৈতিকতা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিকৃতি । মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক মূল্যবোধে চরম অবক্ষয় । অসুন্দর নষ্টামি ভণ্ডামি ও নষ্টাচার-ভ্রষ্টাচারের হোলিখেলা ইত্যাকার অশুভ কর্মযজ্ঞের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত বাংলাদেশ হাবুডুবু খাচ্ছে । সর্বত্র কেঁচো খুঁড়লে বড়ো বড়ো বিষধর সাপ বেরোয় । কালো টাকার প্রভাবে মাদক ও ব্যভিচারের করাল গ্রাসে বাঙালি সমাজ ডুবে যাচ্ছে । দেশের ভেতর কতিপয় মহাদুর্নীতিবাজ মাফিয়া পরিবারের উত্থান ঘটেছে যারা জবর দখল, দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ, লুটপাট, খুনসহ নানান পৈশাচিক কার্যকলাপের সাথে জড়িত । অপরদিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দৌরাত্বে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা অপমানিত হচ্ছেন । অকারণে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে ভাগ বসানোর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অর্থ ও অন্যান্য সুবিধাদি ভোগ করে আসছে । সরকারি প্রকল্প, উন্নয়ন ও কেনাকাটার অন্তরালে চলছে শতসহস্র কোটি টাকা লুটপাট । ব্যাংক ও পুঁজিবাজারে চলছে সাগর চুরি । হুণ্ডিসহ নানান উপায়ে দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে । কিন্তু দুর্নীতিবাজদের কোনো ধরাধরি নেই । দুর্নীতির প্রতিকার নেই !

এই তো ! পিকে হালদার নামে এক লুটেরা-প্রতারক ৩ হাজার কোটি টাকা মেরে দেশ থেকে পালিয়ে কানাডায় রাজকীয় জীবনযাপন করছেন । ব্যাসিক ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান কোথাকার কোন আবদুল হাই বাচ্চু হাজার হাজার কোটি টাকা নয়ছয় করে দেশে-বিদেশে নিরাপদে বিচরণ করছেন । শোনা যায় দুবাইতে কয়েকটি সাততারা হোটেল করে সাদ্দাতীয় বেহেস্তে অবস্থান করছেন । এ ব্যতীত ব্যাঙ্ক ও শেয়ারবাজার, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প ও কেনাকাটার লুটেরাচক্র হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে দিব্যি আরাম-আয়েশে রাজকীয় নিরাপদ জীবনযাপন করছেন !

দুর্নীতি ও লুটপাটের এমনতর অবস্থা দেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রয়াত ইব্রাহিম খালেদ একদা আমার সাথে এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, এসব দুর্নীতিবাজ লুটেরাচক্র কীভাবে পার পেয়ে যায় জানো ? তিনি বলেছিলেন, কোনো সেক্টরে বড়ো ধরনের আত্মসাত ও লুটপাট হলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত একটি চক্র খুব খুশি হন । চক্রটি তখন তাদের কাছ থেকে লুটকৃত অর্থের একটা বড়ো অংশ ভাগ নিয়ে তাদেরকে সেলটার দেয়, পরবর্তীতে তাদেরকে বিদেশে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করে থাকে । ফলে বড়ো বড়ো লুটেরাচক্র থাকে ধরাছোঁয়ার উর্দ্ধে ! এদের কেউ কেউ আবার দরবেশী ছদ্মবেশে সরাসরি ক্ষমতায় আসীন ! চুনোপুঁটি ধরনের কিছু কিছু লুটেরাদের বিচার হলেও, বড়ো বড়ো লুটেরাদের কোনো বিচার হয় না ।

এ তো গেলো বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প, কেনাকাটা, ব্যাঙ্ক, শেয়ারবাজার ও অন্যান্য আর্থিক খাতের কেচ্ছা । এবার আসুন মুক্তিযোদ্ধা সেক্টরে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, সম্মানী ভাতা ও অন্যান্য বিষয়াদির ওপর ভাগ বসানোর লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত নন----রাজনীতি, প্রশাসন, ব্যবসা, বানিজ্য ও শিল্পখাতের অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি; ক্ষমতাসীন দলের নেতা, আমলা এমনকি রাজাকাররাও হাজারে হাজারে মুক্তিযোদ্ধা সেজে বসেছেন ! মুক্তিযোদ্ধার সর্বসাকুল্য সংখ্যা যেখানে ১লক্ষ ৫০ হাজারের নীচে, সেখানে সরকারি খাতায় মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা কমবেশি ২ লক্ষ ৩৫ হাজার ! ৮০/৮৫ হাজারই ভুয়া। এই ভুয়াদের প্রায় ৫০ হাজার তালিকাভুক্ত হয়েছে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আর বাকিগুলো হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে । আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায় থেকে বহুবার বলা হয়েছিলো যে, তারা ক্ষমতায় গেলে ঐসব ভুয়াদের বিতাড়ন করবেন, কিন্তু ১২ বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় থেকেও তারা ভুয়াদের তো বিতাড়ন করেনইনি, উপরন্তু তারা ক্ষমতায় থেকে ভুয়া বানিয়েই চলেছেন ! প্রয়াত ইব্রাহিম খালেদের বক্তব্যটি একটু ঘুরিয়ে এভাবে বলা যায় যে, ক্ষমতার সাথে জড়িত লুটেরাচক্রের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা এখানেও আত্মীয়তা, অর্থ ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ভুয়াদের রক্ষা করে চলেছেন । ফলে ভুয়া বিতাড়ন সম্ভব হচ্ছে না । ফলে মুক্তিযোদ্ধা অঙ্গনের এসব দুর্নীতিবাজরাও থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে !

দুর্নীতিবাজ-লুটেরাদের ধরার বিশাল এক সংস্থার নাম দুর্নীতি দমন কমিশন = দুদক । কিন্তু তারা কী ধরেন, কী কাজ করেন তা তারাও জানে না । তারা ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার ! দুর্নীতি ও লুটপাটের বিষয়ে তারা মাঝে মাঝে তৎপরতা দেখালেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা আলোর মুখ দেখে না । বড়ো বড়ো দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের কমিশনের সামনে দু'একবার লোকদেখানো হাজির করেন, কিন্তু তারপর আর কোনো খবর হয় না । মূলত: দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন বলা হলেও তার লেজটি সরকারের হাতে । বিশেষ করে আমলা পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও মামলা করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হয় । এখানেই ঘাপলা । এসব ক্ষেত্রে দুদকের করণীয় কিছু নেই । তারা নামে বাঘ হলেও কামে নেই ! এজন্যই দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান একদা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, দুদক হলো নখ-দন্তহীন এক বাঘ !

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।