ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

বড়োই আক্ষেপের কথা

২০২১ মে ৩১ ১৬:৩২:২০
বড়োই আক্ষেপের কথা

আবীর আহাদ


আজ যারা দেশের বড়ো বড়ো চেয়ারে বসে আছে, দুর্নীতি আর লুটপাট করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে, তারা বেমালুম ভুলে গেছে বাংলাদেশের জন্মের প্রসববেদনার কথা ! মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত রণাঙ্গনের কথা ! বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বের কথা ! ত্রিশ লক্ষ স্বাধীনতাকামী শহীদ ও লক্ষ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির কথা ! ভুলে গেছে ১৪ হাজার ভারতীয় মিত্রবাহিনীর জীবনদানের কথা ! শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কথা । ভারতের জনগণের কথা । মুক্তিযুদ্ধে যারা ছিলো আমাদের জাতশত্রু, ব্যক্তি ও দলগত স্বার্থে তারাই হয়ে যাচ্ছে মিত্র । কী বিচিত্র দেশ ! ভাবতেই পারা যায় না ।

ক্ষমতা ও প্রাচুর্যের অন্ধমোহে তারা ভুলে গেছে, এই দেশে যার যা হওয়ার কথা ছিলো না তারা তাই হয়েছে হচ্ছে ও হতে থাকবে ! এমন সব লোক মন্ত্রী এমপি সচিব শিল্পপতি ব্যবসায়ী প্রভৃতি হয়েছে যাদের কেরানি পিয়ন চাপরাসি হওয়ার যোগ্যতা নেই ! আরো কী নির্মম পরিহাস, এদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীও হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ! কিন্তু যাদের অবদানে এতসব, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও তাদের জীবনের আশা-আকাঙ্খা পদদলিত ও তাদের ঐতিহাসিক কর্মের অবমূল্যায়ন করার মধ্য দিয়ে তারা এক ধরনের বিকৃতসুখ লাভ করে মনে আনন্দ পায় ! তারা বোধহয় মনে করে, কিসের মুক্তিযোদ্ধা----আকাশ থেকে একদল ফেরেস্তা এসে এদেশ স্বাধীন করে দিয়ে তারা আকাশেই মিলিয়ে গেছে ! তাইতো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এ-জাতির ক্ষমতাধর রাজনীতিক আমলা শিল্পপতি ব্যবসায়ী জ্ঞানীগুণীসহ স্বাধীনতার সুফল ভোগকারী তথাকথিত এলিট সম্প্রদায়ের এতো অনীহা ও হিংসা ! যে রাজাকার আলবদর ও অন্যান্য অপরাধী----দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়ারা দেশ ও জাতির শত্রু, তারা শাসকগোষ্ঠীর কাছে সম্মানের পাত্র । টাকা দিয়ে যে কেউ শাসকদলের নেতা ও এমপি-মন্ত্রী হতে পারে । কোনো আদর্শ নেই । চেতনা নেই । অঙ্গীকার নেই । শুধুই লুটপাট । চাটাচাটি । কী বিচিত্র মানসিক বিকৃতির হলাহল !

মাত্র দেড় লক্ষের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধা । গোঁজামিল মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞায় অর্থের বিনিময়ে, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়া হয়েছে । এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কমবেশি দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার । এর মধ্যে আশি/পঁচাশি হাজারই ভুয়া । এরা তুলনামূলক অল্প বয়সী, শিক্ষিত ও স্বচ্ছল । অপরদিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পঁচানব্বই ভাগই চলা চলে অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত ও দরিদ্র । তাদের অধিকাংশই অনাহারে অর্দ্ধাহারে রোগোশোকে ধুকে ধুকে মানবেতর জীবনযাপন করছে ! আজ রাষ্ট্র নাকি অর্থনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী । রিজার্ভ ব্যাংক ভরা হাজার হাজার কোটি টাকা । আজ বাংলাদেশের আর্থিক বুনিয়াদ এতোটাই নাকি শক্তিশালী হয়েছে যে, সে এখন বিদেশী রাষ্ট্রগুলোকে লোন দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে । বাংলাদেশ এখন উন্নত বিশ্বের কাতারে অবস্থান করছে । হতে পারে তা মন্ত্রী এমপি আমলা শিল্পপতি ব্যবসায়ী দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের কাছে । সরকার প্রধানের কাছে । কিন্তু ঐ বেঁচে থাকা ও মরে-যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি আজো ভীষণ গরিবই রয়ে গেছে ! রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও একটিমাত্র সেক্টর তার বাইরে অবস্থান করছে । সেটি মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর । তাদের পরিবারবর্গও অবহেলার শিকার । মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে পিছিয়ে-পড়া থেকে উদ্ধার করার জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রচলন করেছিলেন । আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সেটি কোনোকালেই বাস্তবায়ন ঘটেনি । সেটিও বলা চলে আজ আর নেই ! ফলে বংশপরম্পরায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে ছলেকলেকৌশলে বঞ্চিত করা হয়েছে । রাষ্ট্র দয়া-দাক্ষিণ্য দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যে যৎকিঞ্চিত সম্মানী দিয়ে থাকে, সেটি নানান ছুতোয় আমলারা সময়মতো প্রদান করে না । উপরন্তু মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ও অন্যান্য সুবিধাদি ভোগ করতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আমলাদের যোগসাজশে অনেক অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকাররাও মুক্তিযোদ্ধা বনে গিয়েছে । ভাবখানা এই যে, মুক্তিযোদ্ধা অঙ্গনটি শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ছেড়ে দেয়া যাবে না, সেখানেও অন্যান্যদের (ভুয়া) অবস্থান থাকতে হবে !

একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত দরিদ্র মানুষগুলোই মুক্তিযুদ্ধে বেশি অংশগ্রহণ করেছিলেন । সুতরাং এখানেও ভাবখানা এমন যে, ওরা কেনো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হবে ? বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমাজ-রাষ্ট্রের উচ্চশ্রেণী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি একধরনের হীনমন্যতা ও হিংসায় আক্রান্ত হয়ে তাদেরকে নানাভাবে দূরে ঠেলে রেখে মনের বিকৃতসুখ লাভ করে থাকে । তারা যেনো পণ করে বসে আছে যে, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে কোনো অবস্থাতেই আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে ওপরে উঠতে দেয়া হবে না । যতোই বলা হোক যে, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, আদতে এটা কথার কথা, কিন্তু বাস্তবে একথার এক পয়সাও মূল্য নেই । মূল্য থাকতো, যদি জাতীয় সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকতো । সেটি থাকলে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সাংবিধানিক আইন দ্বারা সংরক্ষিত হতো । তাদের আর্থসামাজিক উন্নত ও নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা থাকতো । আজ গ্রাম গঞ্জ শহর ও নগরের সর্বত্র মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই রাজাকার পরিবারের হাতে নিহত আহত নির্যাতিত হচ্ছেন। তাদের জায়গা জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা সন্তানকে আগুনে পুড়িয়ে মারার উদাহরণও ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে । মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর যেসব রাজাকার ও তাদের শাবকরা এসব অপকর্ম করছে তারা এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা !

এই যখন মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও বীরত্বে অর্জিত দেশে তাদেরই করুণ অবস্থা, আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন, তাহলে তারা তাঁকে প্রশ্ন করতো, কেনো তিনি এদেশকে স্বাধীন করার জন্যে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, নির্দেশনা দিয়েছিলেন ? কিন্তু হায় ! তাঁকে এদেশেরই উচ্চাভিলাষীচক্র নির্মমভাবে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে দেশকে আজ এ-অবস্থায় নিয়ে এসেছে ! শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া রাজনৈতিক দলটি আজ ক্ষমতায় যেয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দুর্নীতিবাজ আমলা লুটেরা ও মাফিয়াদের সাথে হাত মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে । যাদের আওয়ামী লীগ করার কথা তারা দলের ধারেকাছেও নেই । দেখেশুনেবুঝে মনে হয়, আওয়ামী লীগ শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার ওপর জোর দিচ্ছে---বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দূরে সরিয়ে রেখে । যে ক্ষমতার আদর্শ নেই, চেতনা নেই, জনগণের সার্বিক কল্যাণ নেই, মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা দেয় না----সেই ক্ষমতার কী মূল্য ?

বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যা ঘটেছে ও ঘটে চলেছে-----এসবের পরিণতিতে এদেশের বুকে যে সুনামী ধেয়ে এসেছে ও আসছে, তা থেকে কি কেউ নিরাপদ থাকতে পারবে ? পারবে না । বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চারনেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যে অবিচার করা হলো, এর ফলে এ-দেশে আর কোনো বঙ্গবন্ধু, জাতীয় নেতা ও ত্যাগী বীরদের জন্ম হবে না ! এ-দেশের জন্য আর কেউ কোনোদিন বীরত্বের অবদান রাখবে না ! এটা বড়োই আক্ষেপের কথা !

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।