ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

জাতীয় স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অশুভশক্তিগুলোর উৎখাত একান্তই জরুরী

২০২১ জুন ১৮ ১৬:১৮:১৮
জাতীয় স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অশুভশক্তিগুলোর উৎখাত একান্তই জরুরী

আবীর আহাদ


এক খবরে প্রকাশ, বিগত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে প্রায় ৯/১০ লক্ষ কোটি টাকা! এসবই হলো বিভিন্ন প্রকল্পের বাড়তি মূল্য, সরকারি কেনাকাটা, ভুয়া প্রকল্প/শিল্পের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেয়া অর্থ। বেশ কিছুকাল আগে সুইস ব্যাংক ও পানামা পেপার্সে বাংলাদেশের কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের খবর প্রচারিত হয়েছিল। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্রী বলেছেন যে, দেশের ২৮ জন দুর্নীতিবাজ লুটেরার নাম নাকি তাঁর কাছে এসেছে যারা সুইস ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে ! বিভিন্ন সময় লুটেরাগোষ্ঠী তাদের সেসব পাচারকৃত অর্থে আমেরিকা, লণ্ডন, কানাডা, পানামা, সুইজারল্যান্ড, দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালায়েশিয়া প্রভৃতি দেশে বিশাল অর্থ পাচারসহ সেসব দেশে অনেকেই সেকেণ্ড হোম গড়ে তুলেছে। এসব দুর্নীতিবাজ লুটেরাগোষ্ঠী তাদের ভবিষ্যত বংশধরদের নিরাপদ জীবনের জন্য তাদেরকে ঐসব দেশে লেখাপড়া করাচ্ছে । অর্থাত্ এদেশের প্রতি তারা দায়বদ্ধ নয়। এদেশ থেকে নানান ছলেকলেকৌশলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিদেশের মাটিতে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে।

আমি বাংলাদেশের একটি বহুমুখী বিশাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের খবর জানি। বিগত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনের তিন/চার মাস পূর্ব থেকেই সেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তাদের প্রধান কার্যালয় সিঙ্গাপুর ও মালায়েশিয়ায় স্থানান্তর করে পরিবার-পরিজনসহ সেখানে চলে যান। নির্বাচনের পর তার মনঃপূত রাজনৈতিক দলটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেই তিনি আবার প্রধান কার্যালয়সহ পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। এভাবেই চলে আসছে দেশের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ লুটেরা রাজনীতিক আমলা ও ব্যবসায়ীদের এমনসব কায়কারবার।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অঙ্গীকার ও দেশপ্রেমের প্রতি যারা দায়বদ্ধ নয় তাদের কাছে দুর্নীতি ও লুটপাটসহ নানান সমাজ ও দেশবিরোধী কার্যকলাপ হলো ভাত-মাছ। নিজেদের এবং তাদের গোষ্ঠীস্বার্থে তারা যেকোনো অন্যায় ও অপরাধ করতে তাদের বিবেকে বাঁধে না। দেশটা যে মুক্তিযুদ্ধের রক্তের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বে অর্জিত হয়েছে, এটা তাদের মনেই ধরে না। আজ যারা সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেসব রাজনীতিক, মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ী----এদের অধিকাংশের সাথে মুক্তিযুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই। যারা মুক্তিযুদ্ধের রক্ত ও কষ্ট দেখেছে, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করছে তারা দুর্নীতি ও লুটপাট করতে পারে না। আজকে দেশের মধ্যে যেসব মহাদুর্নীতিবাজ, লুটেরা ও মাফিয়াদের আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নয় যেমন বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, এস আলম, শিকদার, যমুনা, অরিয়ণ, মেঘনাসহ বিভিন্ন মাফিয়াচক্র। এসব মাফিয়াচক্র গোটা দেশ এমনকি সরকার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়াকে জিম্মি করে ফেলেছে। এরা বিভিন্ন বাণিজ্যিক সিণ্ডিকেট সৃষ্টি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে সাধারণ মানুষকে শোষণ করছে, নিরীহ মানুষের জায়গাজমি দখল করছে, তাদের অপকর্মের বিরোধিতাকারীদের হত্যাসহ নানাভাবে অত্যাচার করছে। টাকার গরমে ব্যভিচার ধর্ষণ ও পাশবিকতা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে হেরেমখানার প্রচলন করছে! কোনো সুন্দরী মেয়ে ও গৃহবধূ তাদের চোখে যদি পড়ে যায়, তাদের ভোগ করার লক্ষ্যে ছলেকলেকৌশলে তাদেরকে তাদের হেরেমখানায় রক্ষিতা করে রাখে । পরবর্তীতে তাদেরকে হত্যা বা গুম করা করে ফেলে। অর্থাত্ হেন কোনো অপকর্ম নেই যা এসব মাফিয়ারা সংঘটিত করে যাচ্ছে।

আজ দু:খের সঙ্গে বলতে হয়, যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই দলটির পকেটে দেশের সিংহভাগ দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া এবং স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ঢুকে গেছে! আওয়ামী নেতৃত্ব তাদের অর্থের কাছে আত্মসমর্পণ করে তাদের অনেককেই দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছে! বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের মধ্যে নেই, ফলে তাদের প্রতি আমাদের কোন অনুযোগ নেই। আছে শুধু ধিক্কার । আমাদের আদর্শ, আমাদের চেতনা, আমাদের আশা-আকাঙ্খা, আমাদের মান-অভিমান-অনুযোগ সবকিছুই আওয়ামী লীগকে ঘিরে । আজ আওয়ামী লীগও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে যোজন মাইল দূরে অবস্থান করছে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দূরে ঠেলে দিয়ে রাজাকারদের কাছে টেনে নিচ্ছে!

আওয়ামী লীগের গর্ভ থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের আবির্ভাব। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ এই তিন মিলেই আওয়ামী লীগ। সেই আওয়ামী লীগের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার দাবিতে গোটা মুক্তিযোদ্ধা সমাজ চেয়ে আছে। কিন্তু তাদের কোনোই প্রতিক্রিয়া নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থসামাজিক উন্নতজীবনের আকাঙ্খা আজ মানবেতর জীবনে পর্যবসিত হয়ে গেছে। তারা বিনা চিকিৎসায় ও দারিদ্রের মধ্যে ধুকে ধুকে মরছে। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার মাথা গোঁজার ঠাই নেই। সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে তাদের কোনো মর্যাদা নেই। তাদেরকে মাসিক যে সম্মানী দেয়া হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ফলে সব মিলিয়ে তারা তাদের সৃষ্ট দেশে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

এইতো গত বছর, ওমরা হজ্বে ষাটজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী হেফাজতি মোল্লাকে নেয়া হলো, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও নেয়া হলো না । সরকার প্রধানের বিদেশ সফরের সময় সমাজের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতিবাজ অনেকেই জামাই আদরে সফরসঙ্গী হয়, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও সে-সফরে নেয়া হয় না ! যে যৎকিঞ্চিত ভাতা দেয়া হয়, তাতে তাদের চিকিত্সা নিতেই তা খরচ হয়ে যায় । তার ওপর আছে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি। ইদানীং রাজাকারগোষ্ষ্ঠী তাদের ওপর একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। বলা চলে তারা (রাজাকাররা) প্রায় সবাই এখন আওয়ামী লীগ করে এবং আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় এসব অপকর্ম করা হচ্ছে। গ্রামেগঞ্জে কিংবা শহরের সর্বত্র চলছে মুক্তিযোদ্ধা উৎপাটনের কার্যক্রম।

এটাই হলো আজ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা। চারদিকে দুর্নীতি ও লুটপাটের হলাহলের ফলে সামাজিক মূল্যবোধে চরমতর ধস নেমেছে। মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা ও সৌজন্যবোধ হারিয়ে গেছে। দেশে আইনের শাসন মুখ থুবড়ে পড়েছে। সবকিছুই মূল্যায়িত হচ্ছে আর্থিক মাপকাঠিতে। সমাজের সৎ মেধাবী, ত্যাগী মানুষেরা অবমূল্যায়নের চরম শিকার হচ্ছে। দেশের প্রতি মমত্ববোধ আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে । মনে হয় কে বা কারা যেন, বেছে বেছে খারাপ মানুষগুলোকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে বসিয়ে দেয়া হয়েছে! বেকারত্বের অভিশাপে বিশাল শিক্ষিত যুবসমাজ দিশেহারা। দেশের ভবিষ্যত নিয়ে কারো মাথা ব্যথা আছে বলেও মনে হয় না। সবাই আজ বিভ্রান্ত। সবাই আজ মরীচিকার পানে অন্ধের মতো ছুটে চলেছে। আর এই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ জঙ্গি অপশক্তির নিরব উত্থান ঘটছে। যেকোনো সময় তার মহাবিস্ফোরণ ঘটা অস্বাভাবিক নয়।

দেশের চলমান সার্বিক রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারে উদ্বুদ্ধ শুভশক্তি তথা দেশপ্রেমিক সৎ মেধাবী ও সাহসী মানুষগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে অশুভ শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে । এর বিকল্প পথ খোলা নেই। মুক্তিযুদ্ধের গণবিপ্লবের ধারা যে অশুভশক্তি ও প্রতিবিপ্লবীচক্রের অপচেতনায় কলুষিত হয়েছে, সেই হারিয়ে যাওয়া বিপ্লবকে আবার টেনে আনতে হবে। নইলে বাঙালি জাতি, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাংলাদেশ চিরতরে হারিয়ে যাবে ।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।