ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তিযুদ্ধ » বিস্তারিত

পথের ধুলো থেকে : পর্ব-৮ 

স্বাধীনতা পরবর্তী জটিল রাজনীতি : নিজেকে ‘বাহাদুর’ প্রমাণের লোভে স্বাধীনতা বিরোধীদেরই সহায়তা করা হচ্ছে

২০২১ আগস্ট ১৬ ১৪:৫৯:৪৭
স্বাধীনতা পরবর্তী জটিল রাজনীতি : নিজেকে ‘বাহাদুর’ প্রমাণের লোভে স্বাধীনতা বিরোধীদেরই সহায়তা করা হচ্ছে

সাইফুল ইসলাম


মুক্তিযুদ্ধের প্রধান স্তুম্ভ মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৬৯-এর আগেও রাজনীতি ছিল। রাজনৈতিক দল তাদের গোষ্ঠী বা শ্রেণি অনূযায়ী জনসমর্থণ পেতো। কারো ভিত্তি শ্রমিকের মধ্যে, কেউবা কৃষকের মধ্যে, আবার কোনও কোনও দলের মধ্যবিত্তের মধ্যে সমর্থণ বেশি। কিন্তু উনসত্তুরের ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় রাজনীতির নতুন মেরুকরণ। বিকশিত হতে শুরু করে নতুন রাজনীতি, নিপীড়ন বিরোধী বাঙালির জাতিগত আন্দোলন- যাকে অনেকেই বলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এই আন্দোলনের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নতুন নেতার বাহন হয়ে ওঠে রাজনৈতিক কর্মী, ১৯৭১-এর নয় মাসের মুক্তিযোদ্ধা। এদের কাছেই থাকার কথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আকাঙ্খা-চেতনাও। এটাই জনগণের ধালণা, আশা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে তাদের কাছেই সবাই দৌড়াবে এটাই স্বাভাবিক। গবেষক, সাংবাদিকেরা তাদের কাছেই যান। অনুসন্ধান কমিটির সংগঠকেরাও তাদের কাছেই যেতে শুরু করে, তাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে অনুলিখন করতে থাকে ‘মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধস্মৃতি।’ এতে নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ অনুসন্ধান কমিটির সংগঠকেরা।

স্থানীয় পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ হতে থাকে ‘মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধস্মৃতি’। যারা সাধারণ মু্িক্তযোদ্ধা, গবেষক-সাংবাদিকেরা যাদের কাছে পৌঁছে না, তাদের যুদ্ধস্মৃতি অনুলিখন করে ছাপা হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেও যাওয়া হবে বলে আশা করে লেখক-সংগঠকেরা। লেখা নিয়ে শোরগোল পড়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারন পাঠকের মধ্যে। গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধারা বলতে শুরু করেন- ‘ও কী জানে? তেমন কিছু তো ওরা জানার কথা নয়।’ অনেকেই বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা গোঁজামিল দেন, কোথাও কোথাও মিথ্যেও বলেন।’ এসব কথা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে থেকেও আসতে শুরু করে। সাবধান হতে হয় লেখক-সংগঠকদের। বুঝতে পারে যে মুক্তিযোদ্ধারা যা বলবে তা-ই লেখা চলবে না। যাচাই-বাছাই করে লিখতে হবে, প্রশ্ন করে করে বের করে আনতে হবে আসল কথা। সে ভাব্ইে চলতে থাকে ‘মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধস্মৃতি’ লেখার কাজ। আরো একটি বিষয় লেখক-সংগঠকদের গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে থাকে, তা হলো- মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সেদিনের আদর্শের চেয়ে বর্তমানের স্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যুদ্ধের কথা। সাংগঠনিক বা অন্যান্য কাজে যারা নিয়োজিত থেকেছেন, তাদের ভাগে যুদ্ধ নেই বলে তুচ্ছতাচ্ছিল করা হচ্ছে তাদের। সে কারণে গোঁজামিল দিয়ে হলেও যুদ্ধের কথা বেশী বেশী করে বলছেন অনেকে। কী কারণে এসব ঘটছে তা-ও বুঝতে হবে লেখক-সংগঠকের, বুঝতে হবে মুক্তিযুদ্ধকে। একাত্তুরের মুক্তিযোদ্ধা আর এখনকার মুক্তিযোদ্ধা এক নন। পঞ্চাশ বছরে মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের মধ্যে যে পরিবর্তণ ঘটেছে, তা-ও আমলে নিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের এই সংগঠকদের।

জনৈক মুক্তিযোদ্ধা আগ্রহ প্রকাশ করেন সাক্ষাৎকার দিতে। তাকে সবাই লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চেনেন। তার সঙ্গে বসা হয়। তিনি বলতে থাকেন তার মু্িক্তযুদ্ধের কথা। লেখক-সংগঠক নোট নিতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর অংশে কোনও গোজাঁমিল নেই, প্রয়োজনও পড়ে না। পাকসেনারা শহরে আসার পর ছত্রভঙ্গ হযে পড়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের কর্মী সমর্থকসহ সাধারণ জনগণ। পরে জনগণের প্রধান অংশ ফিরে আসে স্ব স্ব বাড়িতে এবং তারা বসবাস করতে থাকে ভীতসন্ত্রস্থ অবস্থায়। প্রধান প্রধান নেতাকর্মীরা ভারতে চলে যান। যারা ভারতে পারি জমাতে ব্যর্থ হন তারা বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট গ্রুপে সংগঠিত হতে শুরু করে। ভারত যেতে না পারাদের মধ্যে সিরাজগঞ্জ কলেজের তৎকালীন ভিপি সোহরার আলী সরকার, ছাত্রলীগ নেতা মনীরুল কবীর, প্রো-ভিপি লুৎফর রহমান মাখন, ছাত্রলীগের শফিকুল ইসলাম শফি ও আব্দুল আজিজ সরকার অবস্থান নেন ভদ্রগাটের একটি গ্রামে। তাদের ঘিরে সংগঠিত হতে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধারা। এই গ্রুপটির নাম হয় পলাশডাঙ্গা যুব শিবির। আমাদের আলোচিত মুক্তিযোদ্ধাও সংগঠিত হন সেখানেই। ভারত থেকে ফেরত আব্দুল লতিফ মির্জা, লুৎফর রহমান অরুণ সহ অনেক নামীদামী ছাত্রনেতা এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট সদস্যসহ প্রায় পঞ্চাশ জন যুক্ত হন পলাশডাঙ্গায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য খোলা হয় একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পও। ভদ্রঘাট বসাকপাড়াসহ আশপাশের বিভিন্ন পাড়া হয়ে ওঠে তাদের আশ্রয়স্থল। জুন মাসের মাঝামাঝি পাকসেনা ও রাজাকারেরা হামলা চালায় ওই ক্যাম্পে। মূল বাহিনীটি রান্ধুনীবাড়ি হয়ে চলনবিলের দিকে সরে গেলেও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে গ্রুপের অন্য মুক্তিযোদ্ধারা। আলোচিত মুক্তিযোদ্ধাকে এ পর্যায়ে এসে প্রশ্ন করা হয়, পলাশডাঙ্গার ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর তিনি কোন দিকে চলে গিয়েছিলেন? প্রশ্নে তিনি ভ্যাবাচ্যাগা খেয়ে যান। দম নিয়ে জানান যে, তিনি মূল বাহিনীর সঙ্গে রান্ধুনিবাড়ির দিকে চলে গেছেন। এর পর নামাজ পড়ার উছিলায় সেদিনের মতো আলোচনা স্থগিত করে চলে যান তিনি। নানা উছিলায় পরবর্তী সময়ে তিনি আর বসেন নি। লেখক-সংগঠকেরা ইতিমধ্যেই বুঝতে শুরু করেন যে, একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ কেউ একা সংঘটিত করতে পারেন নি। যে কোনও মুক্তিযোদ্ধাকে দলবদ্ধ ভাবেই চলতে হয়েছে। তখন সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গীদের মধ্যে খোঁজ নিতে থাকেন যে আলোচিত মু্িক্তযোদ্ধা কোথায় কিভাবে যুদ্ধ করেছেন। তাঁর সঙ্গী সাথীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে তা অনুলিখন করা হয়। এতে জানা যায়, তিনি ভদ্রঘাট যুদ্ধ থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে আমিনুল ইসলাম চৌধুরী ও শফিকুল ইসলাম শফির সঙ্গে চলে যান বাহুকা গ্রামে। সেখান থেকে শফিকুল ইসলাম শফির নেতৃত্বে চলে গেছেন কাজীপুর থানার গোয়ালবাথান চরে। সেখানেও হামলার শিকার হয়ে আবারো ছত্রভঙ্গ হতে হয় গ্রুপটিকে। ওই গ্রুপ থেকেও বিচ্ছিহ্ন হতে হয় সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাসহ দুই জনকে। নভেম্বর মাসের দিকে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তাকে দেখা যায় কাকড়ি ইয়থ ক্যাম্পে।

অপরদিকে, পলাশডাঙ্গা যুব শিবির ১১ নভেম্বর হান্ডিয়াল-নঁওগায় হামলার শিকার হয়। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে তারা চলে যায় কুড়িগ্রামের রৌমারীতে। আমাদের আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা কাকড়ি ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে সেখানেই যুক্ত হন তার পুরনো গ্রুপ পলাশডাঙ্গায়। অন্য এক মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকারে জানা যায়, পলাশডাঙ্গা তাদের খোঁজে লোক পাঠিয়েছিল তার এলাকায়, কিন্তু তখন তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিজয় পরবর্তী সময়ে রৌমারী থেকে পলাশডাঙার সঙ্গে তিনি চলে আসেন এলাকায়। যুক্ত হন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশাসনে। লেখক-সংগঠকেরা নিশ্চিত যে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের জন্য সূচনালগ্নে বাড়ি ছেড়েছেন তিনি। যখন খুব কম মানুষই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছেন, তখন থেকেই তিনি পলাশডাঙ্গার সদস্য হিসেবে যুক্ত আছেন। তার দেশপ্রেমে কোন ঘাটতি লেখক-সংগঠক পাচ্ছেন না। তাহলে কেন তিনি তার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ঘটনা নিয়ে লুকোচুরি খেলছেন? এর পিছনে যে কারণটি সংগঠকদের কাছে মনে হয়েছে তা হলো, তিনি মুক্তিযুদ্ধকে সুশৃঙ্খল দেখতে চেয়েছেন, কিন্তু তা হয়নি। তাই তিনি গোঁজামিল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে মেলাতে চাইছেন। এতে যে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রণয়ন বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে তা বুঝতে পারছেন না তিনি। সেই সঙ্গে মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকেই বিতর্কিত করছেন।

সংগঠকদের আরো ধারণা হয়, স্বাধীনতা পরবর্তী জটিল রাজনীতি এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এক ধরণের ‘লোভের ফাঁদে’ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাকে ‘মিথ্যুকে’ পরিণত করছে সামান্য ব্যক্তিগত স্বার্থের লোভে। নিজেকে ‘বাহাদুর’ প্রমাণের লোভে সঠিক কথা না বলে স্বাধীনতা বিরোধীদেরই সহায়তা করা হচ্ছে। অথবা তারা মনেপ্রানে বিশ্বাস করছে যে, মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধটাই প্রধাণ- রাজনীতি, সংস্কৃতি, ওই সময়ে গড়ে ওঠা সংগঠন গৌণ। গৌণ জনগণ। ফলে মুুক্তিযুযোদ্ধারা যেনতেন ভাবে বলে চলেছেন যুদ্ধের গল্প। তাতে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছে এক ধরণের কল্পগল্প। কারণ যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন তাদের বিশাল অংশ এখনো বেঁচে আছে। তারা অব্শ্বিাস করছে মুক্তিযোদ্ধাদের। গড় ফল হয়ে পড়েছে- মুক্তিযোদ্ধা আর জনগণ ধীরে ধীরে হয়ে পড়ছেন আলাদা, পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের মধ্যে একটি সিঁড়ি গড়ে তোলার দায়িত্বও পড়ছে সংশ্লিষ্ঠ সংগঠকদের ওপরই।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক, সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক।