ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তিযুদ্ধ » বিস্তারিত

পথের ধুলো থেকে : পর্ব-১০

সেইদিন ভদ্রঘাটে পাকহানাদার বাহিনীর গুলিতে অন্তত ২১ জন শহিদ হন, পুড়িয়ে দেওয়া হয় ২০০ বাড়িঘর 

২০২১ আগস্ট ২৩ ১৪:২৭:৩০
সেইদিন ভদ্রঘাটে পাকহানাদার বাহিনীর গুলিতে অন্তত ২১ জন শহিদ হন, পুড়িয়ে দেওয়া হয় ২০০ বাড়িঘর 

সাইফুল ইসলাম


মুক্তিযুদ্ধের সব কিছুই এখন ‘মু্িক্তযোদ্ধা’ নির্ভর। ইতিহাস রচনা থেকে মুক্তিযুদ্ধের নীতি-নৈতিকতা, সাহিত্য-সংস্কৃতি সবকিছুই এখন মুক্তিযোদ্ধা, আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এটা ঘটেছে বা ঘটানো হয়েছে জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত। সর্বত্র কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার ওপর নির্ভর করছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রায় দেওয়া না দেওয়া। গবেষকেরা তাদের ওপর নির্ভরশীল, সাংবাদিকেরাও মুক্তিযুদ্ধের কোনও তথ্যের জন্য দৌঁড়ান তাদের কাছেই। এমনকি ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রশাসন থেকে স্কুল-কলেজ গুলিতে যে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়, সেখানেও মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানো হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শেখানো বা বোঝানোর জন্য। এদের অনেকের যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলা শুরু করেন। তারা কোনও জানাযা বা শেষকৃত্য অনুষ্ঠানেও কথা বলার সুযোগ পেলে বলে থাকেন তাদের ‘মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁধা।’ যারা এই ইতিহাস বলেন তাদের প্রধান প্রবণতা- অন্যরা তেমন কিছু জানে না- ধরণের। এমন কি এক মুক্তিযোদ্ধা অপর মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কেই বলে থাকেন যে- ‘ও তো তেমন কিছু জানে না’ বা ‘এতো দিনে সব ভুলে গেছে’- ধরণের কথা। এক মু্িক্তযোদ্ধা সম্পর্কে আরেক মুক্তিযোদ্ধার এমন মন্তব্য শোনা যায় অহরহই। অনুসন্ধান কমিটির লেখক-সংগঠকেরা এটার বিকল্প হিসেবে ‘সাধারণের চোখে মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘শহিদ পরিবার’ এর প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। কিন্তু এটাও ত্রুটিমুক্ত নয় বলে ধারণা এদের। এদের ধারণা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অবাধ তথ্যপ্রবাহ সৃষ্টি হওয়া প্রযোজন। মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শিক লড়াই মুক্তিযুদ্ধ শেষে বন্ধ হয়ে গেছে, তা আবার শুরু হওয়া জরুরি।

মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, তাহলো- তারা তাদের বিজয়ের ইতিহাসগুলো গর্বভবে বলতে পছন্দ করেন। এতে ছোট ছোট যুদ্ধের ঘটনাগুলো তাদের কাছে থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন, একজন মুক্তিযোদ্ধা তার অংশগ্রহণ করা বড় যুদ্ধের কথা দিয়ে শুরু করেন। সাধারণ বা ছোটখাট যুদ্ধের ঘটনাগুলো বলার সময়ই পান না তিনি। এভাবেই হারিয়ে যেতে বসেছে ছোট ছোট যুদ্ধের ঘটনাগুলো। এমনকি, যুদ্ধের শুরুতে যে খ- খ- উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা-ও হারিয়ে যাচ্ছে সহজেই। তিনি যেটা জানেন, খন্ডাংশকে ইতিহাস বলে চালিয়ে দিতে হচ্ছে তাদের। এতে চলে আসছে খন্ডিত ইতিহাস। আর এ পথ ধরেই ঘটে যাচ্ছে ইতিহাস বিকৃতি। আবার এর বিপরীতে যারা ‘স্বল্প দিনের যোদ্ধা’ তারা বানিয়ে কিছু বলতে গিয়েও ঘটাচ্ছেন ইতিহাস বিকৃতি।

ধরা যাক, বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব আলী সরকার। পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের কমান্ডার-ইন চিপ। সিরাজগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এ কথা বলাই যায় যে, তাকে ঘিরেই শুরু হয় পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের প্রাথমিক সংগঠন। ধীর ধীরে তা সিরাজগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠনে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে সেখানে যুক্ত হন বেঙ্গল রেজিমেন্ট সদস্য লূৎফর রহমান অরুণ, জনপ্রিয় ছাত্রনেতা আব্দুল লতিফ মির্জাসহ অনেক খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা। এ ভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন সিরাজগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এখন তাকে যদি মু্িক্তযুদ্ধের ইতিহাস বলতে বলা হয়, তখন তিনি কোন অংশটি বলেন? তিনি কিন্তু বলতে শুরু করেন পলাশডাঙ্গার সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হান্ডিয়াল-নঁওগার যুদ্ধ থেকেই। বড় থেকে ধীরে ধীরে ছোট যুদ্ধের দিকে আসবেন। তার মানে পলাশডাঙ্গার কমান্ডার-ইন চিফ হওয়ার আগের অংশে তিনি বলার সুযোগই পান না। অথচ তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা, সিরাজগঞ্জ কলেজের ভিপি হওয়া সত্বেও কেন অন্যান্য ছাত্রনেতার মতো ভারতে গেলেন না অথবা যেতে পারলেন না, কেন তিনি তাঁর মামার বাড়ি তেনাচেড়া ভদ্রঘাটে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন? তিনি বা তারা ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন কিনা, ওই সময়ে তাদের দিনকাল কেমন কেটেছে, পলাশডাঙ্গার প্রথম অস্ত্র কোথা থেকে এলো- এসব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া গেলে সিরাজগঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন পলাশডাঙ্গার ইতিহাস লেখা হবে কি? আর পলাশডাঙ্গার ইতিহাস লেখা না হলে সিরাজগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যয় অপ্রকাশিত থেকে যাবে না-কি? তাছাড়া, সোহরাব আরী সরকার যে যে এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ করেছে সেই এলাকার মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধের ঘটনা তিনি ভালো জানেন। যে এলাকায় তিনি চলাচল করেননি, সে এলাকার খবর পরবর্তীতে যদি না নিয়ে থাকেন, তবে তার তা জানার কিন্তু কথা নয়। যেমন তার পলাশডাঙ্গার বাইরে অন্য গ্রুপগুলো কী করেছে, কেমন ভাবে যুদ্ধ করেছে- তার কতটুকু খোঁজ তিনি পরবর্তীতে না নিয়ে থাকেন তবে সে সম্পর্কে বলবেন কিভাবে? তাই স্বাভাবিক ভাবেই তার কাছের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা মানে খন্ডিত ইতিহাস। বর্তমান যে পদ্ধতিতে মু্াক্তযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা চলছে তা প্রধাণত মুক্তিযোদ্ধা বনাম মু্ক্তিযোদ্ধায় প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে প্রতিযোগিতা এক অবিনাশী রূপ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ধ্বংস করছে, মুক্তিযুদ্ধের সকল সম্ভাবনাকে টুটি টিপে ধরে আছে, যা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রমাণ মিলবে ভবিষ্যতে। যার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেল একটি তথ্যকে যাচাই করতে গিয়ে।

মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় সকল যুদ্ধের ঘটনা বলার শেষেই বলে থাকেন যে, ‘আমাদের কোনও ক্ষতি হয়নি, আমরা নির্বিঘ্নে বেড়িয়ে আসতে পেরেছি।’ মুক্তিযুদ্ধ অনুসন্ধানের লেখক-সংগঠকদের এ বাক্যটি নিয়ে ঘটকা লাগে। তারা শুরু করে অনুসন্ধান। তাদের অভিজ্ঞতা বা জানা অনুযায়ী মু্ক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে, মু্িক্তযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেলেই পাকসেনারা হামলা চালাতো। মেতে উঠতো অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা আর ধর্ষণে। এটা তারা করতো বাঙালিদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টির জন্য। নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটাই ছিল পাকসেনাদের যুদ্ধকৌশল। লেখক-সংগঠকদের মনে ধারণা গড়ে ওঠে, যে কোনও যুদ্ধঅঞ্চল মানেই সেখানে অথবা তার আশপাশেই খুঁজতে হবে পাকসেনা কতৃক গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষণের ঘটনা। লেখক-সংগঠকেরা যুদ্ধের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ছকে অনুসন্ধান শুরু করে। সিরাজগঞ্জ জেলার প্রথম বড় যুদ্ধের স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয় ভদ্রঘাট যুদ্ধ, এটাকেই তারা বেছে নেয়। শুরু হয় অনুসন্ধান।
ভদ্রঘাট যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রায় সকল মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানার চেষ্টা করা হয়। ওই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অর্ধেকের বেশী মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হয়। কেউ কেউ সাক্ষাৎকার দেন, লেখা হয় যুদ্ধস্মৃতি। কারো মতামত জানা হয় ব্যক্তিগত আলাপচালিতায়। সংগ্রহ করা হয় এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বইপুস্তকও। মু্ক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সবাই বলেন, যুদ্ধের ঘটনা, পাকসেনার সাথে সংঘর্ষ, অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের বেড়িয়ে যাওয়া। শেষ করেন, সবাই এক বাক্য দিয়ে, তাহলো- ‘তারা নির্বিঘ্নে বেড়িয়ে যেতে পেরেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের কোনও ক্ষতি হয়নি।’ কিন্তু বিভিন্ন বইপুস্তক এবং ‘সাধারণের চোখে মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘শহিদ পরিবার’ প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়, ওই দিন ভদ্রঘাটে পাকহানাদার বাহিনীর গুলিতে অন্তত একুশ জন শহিদ হন। পুড়িয়ে দেওয়া হয় দুই শ’ বাড়িঘর। এ কথা যখন ভদ্রঘাট যুদ্ধে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের জানানো হয়, তখন তারা বেশীর ভাগই বলেন যে, ওই যুদ্ধের পর তারা আর ওই গ্রামে যাননি বা খবর নেন নি। ফলে তাদের এ খবর জানার কথাও নয়। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, লেখক-সংগঠকদের তথ্য সঠিক নয় বলে। এদের মধ্যেকার কেউ কেউ মু্িক্তযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে এদের কথা তো ফেলনা হতে পারেই না। ফলে মুক্তিযুদ্ধের এসব কল্পগল্প শুনে বিরক্ত হয়েও বলতে পারছেন না কিছুই। কারণ, মুক্তিযোদ্ধারাই যে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান স্তম্ভ।

আর লেখক-সংগঠকেরা ভাবছেন, এমন বক্তব্য জনগণ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিচ্ছিহ্ন করার চেষ্টা। ভদ্রঘাট যুদ্ধ বা অন্যান্য যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনও ক্ষতি হয়নি মানে দাঁড়ায় ‘জনগণ মু্ক্তিযুদ্ধের অংশ নয়।’

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক, আহ্বায়ক- সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি।