ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা : একটি ক্ষুদ্র মূল্যায়ন

২০২১ সেপ্টেম্বর ২৮ ১৪:২৭:২২
রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা : একটি ক্ষুদ্র মূল্যায়ন

আবীর আহাদ


আজ ২৮ সেপ্টেম্বর। বঙ্গবন্ধু-কন্যা রাষ্ট্রনায়ক জননেত্রী শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্মজয়ন্তী। ১৯৪৭ সালে তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের চলমান ৫০ বছরের রাজনীতি ও রাষ্ট্র ক্ষমতায় তিনি তাঁর পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরেই একমাত্র সফল রাষ্ট্রনায়ক হিশেবে সমহিমায় উদ্ভাসিত। ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি তিনি বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় থেকে নিজেকে সবচে' দীর্ঘকালীন প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করে আছেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চেতনা বহ্নিশিখারূপে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তাঁর দেশসেবার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য এই যে, অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন করেন। সবাইকে তিনি আপন করে পথ চলেন। চিরায়ত শাশ্বত বাঙালি চারিত্রিক সব গুণাবলী তাঁর মধ্যে বিরাজমান। তিনি নিজগুণে নিজেকে সবার 'হাসুপা' তথা বড়োবোন হিশেবে সবার মনে ঠাঁই করে করে নিয়েছেন। বাংলাদেশকে নিয়ে আসছেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্তির এক অনন্য উচ্চতায়। বঙ্গবন্ধু ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা যেনো তাঁর সুমহান নেতৃত্বের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে।

ব্যক্তিগত সততা, মেধা, সাহস ও দেশপ্রেমে শেখ হাসিনা অনন্য তাতেও কোনোই সন্দেহ নেই। এসব গুণাবলি তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন তাঁর মহান পিতা বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে। কিন্তু একথা বলা নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না যে, সুদীর্ঘ রাজনৈতিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকেও দলীয় ও সরকার প্রধান হিশেবে দলে ও সরকারে কাকে কোথায় রাখতে হবে, কোথায় কাকে আনতে হবে, কাকে এমপি উপদেষ্টা ও মন্ত্রী করতে হবে, কাকে পাশে রাখতে হবে, কাকে দল ও ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে হবে এসব ব্যাপারে তিনি তাঁর বিশাল উদার মনের কারণে খুব একটা চিন্তা করেন বলে হয় না! কোনো ব্যক্তির সততা মেধা ত্যাগ ও দেশপ্রেমকে মূল্যায়ন না করে সেই ব্যক্তির প্রতি তাঁর অন্ধস্নেহ এবং তাঁর প্রতি সেই ব্যক্তির আনুগত্যের বিষয়টিকে তিনি বেশি প্রাধান্য দেন বলে মনে হয়। তাঁর এ সরল বিশ্বাসে এ-প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থীসহ দুর্নীতিবাজ-লুটেরারা তাঁর দল ও সরকারে ঢুকে পড়েছে! এ ব্যতীত আওয়ামী লীগ দলের ভেতর ও বাইরের শুভানুধ্যায়ী মহলেও যে বহু সৎ মেধাবী ও ত্যাগী মানুষ রয়েছেন, এসব বিষয়ে তিনি ভেবে দেখেন বলে মনে হয় না!

বিশেষ করে বর্তমানে যাদেরকে দিয়ে তিনি সরকারের মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টামণ্ডলী সাজিয়েছেন, তাদের অনেকেই তাদের পদের যোগ্যই নন। তারা অনেকেই নানাভাবে সমালোচিত ও বিতর্কিত। তারা মানসিকভাবে দুর্বল। এ-সুযোগে ধুরন্ধর আমলাতন্ত্র তাদের 'আসল' চরিত্র নিয়ে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে নিয়েছে। এ অবস্থায় তিনিও তাঁর মনোনীত জনপ্রতিনিধি, দলীয় নেতা ও এমপিদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছেন বলেই মহামারী করোনাকালীন ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় তাদের বাদ দিয়ে আমলাদের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন, যা দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিকদের প্রতি এক অশনি সংকেত!

ক্ষমতাসীন দল ও সরকার, বিশেষ করে বেশকিছু মন্ত্রী ও উপদেষ্টার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমলারা সরকারি বিশাল বিশাল উন্নয়ন প্রকল্প ও কেনাকাটায় আকাশচুম্বি বাড়তি ব্যয়মূল্য দেখিয়ে বিভিন্ন খাত থেকে শতসহস্র কোটি টাকা লুটপাটের হোলিখেলা চালিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, লিজিং কোম্পানি ও পুঁজিবাজারে চলছে ধারাবাহিক হরিলুটের কারবার। সরকারের আর্থিক নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর যোগসাজশে দেশ থেকে নানান উপায়ে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব বন্ধ ও এসবের সাথে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে যারা জড়িত তাদের ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না!

একইভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা ও গরিমা ভুলুণ্ঠিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাটি এড়িয়ে, শেখ হাসিনার সরলতার সুযোগ নিয়ে তাঁর সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তথা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল নানান গোঁজামিলের নির্দেশিকা দিয়ে একটি বাণিজ্য প্রকল্পের অবতারণা করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে চলেছে! মুক্তিযোদ্ধাদের হাজারো বাদপ্রতিবাদ সত্বেও বিএনপি-জামায়াতের অসৎ উদ্দেশ্যে তৈরিকৃত জামুকার ঐতিহ্যকে পাথেয় করে একটি চক্র এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে রাজাকার তালিকা প্রকাশের নামে সেই তালিকায় কিছু মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশ করে বে-আক্কেলের মতো একটি কাজ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক সরকারের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছেন যার ফলে তাকে নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দু:খ প্রকাশ করতে হয়েছে। এছাড়া ব্যাঙ্ক ও শেয়ারবাজারের লুটপাটের দরবেশখ্যাত উপদেষ্টা, সড়ক ও যোগাযোগমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী,স্বাস্থ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী ও এমপিদের কার্যকলাপ ও কথাবার্তা দেশের সাধারণ মানুষ চরম বীতশ্রদ্ধ হলেও একজন মন্ত্রী-উপদেষ্টা-এমপির কিছুই হলো না! মূল নাটের গুরু আমলারাও ধরাছোঁয়ার উর্দ্ধে অবস্থান করছে!

দেখুন করোনাকালীন সরকারের অবস্থা! এ দু: সময়ে গোটা সরকার একাই চালাচ্ছেন একা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা! কোথায় তাঁর মন্ত্রী এমপি সচিব সাহেবরা? তাঁকে যদি একাই সবকিছুই করতে হয় তাহলে ঐ মন্ত্রিসভা, ঐ উপদেষ্টামণ্ডলী ও ঐ সচিবালয়ের কী প্রয়োজন?

অতীতের ধারাবাহিকতায় দুর্নীতি ও লুটপাট এখন দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে। এ-ব্যাপারে সরকারের তেমন মাথাব্যথা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অপরদিকে পোড়খাওয়া দলীয় নেতাকর্মীসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে পাশ কাটিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত শিবির ফ্রিডমপার্টি বিএনপি হেফাজত চাটুকার ও সুযোগসন্ধানীরা সরকারি দলের উচ্চস্তরের নেতৃবৃন্দকে বিশাল অর্থ দিয়ে আওয়ামী লীগ ঢুকে গিয়ে দলের বিভিন্ন স্তরের পদ বাগিয়ে নিচ্ছে। এ-প্রক্রিয়ায় সরকারের ভেতরে থেকে ক্যাসিনো সম্রাট, গণিকা সম্রাজ্ঞী, ব্যাঙ্কিং দরবেশদের চরম উত্থান ঘটছে। এ-ব্যাপারটা দলীয় হাইকমান্ড বা প্রশাসনের অগোচরে হচ্ছে এটা ভাবার অবকাশ নেই। বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপরিণামদর্শি চিন্তা ও মেরুকরণের পথ ধরে হেফাজতে ইসলামের মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধর্মান্ধ জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সাথে আওয়ামী লীগের গাঁটছড়ার বিষয়টি কোনোভাবেই দেশপ্রেমিক ও সচেতন মানুষ মেনে নিতে পারছেন না। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ তথা রাজাকারদের উত্তরসূরিরা আওয়ামী লীগ নেতাদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে দলে ঢুকে, যেসব মুক্তিযোদ্ধা তাদের বাপ-দাদাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারগিরির শাস্তি দিয়েছিলো, সেসবের প্রতিশোধ নেয়ার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের ওপর হত্যা, নির্যাতন, সম্পত্তি লুটসহ নানান উৎপীড়ন চালালেও এ বিষয়ে দল ও প্রশাসনের তেমন কোনো প্রতিকারমূলক তৎপরতা নেই !

সবকিছু পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে, দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার নয় দেশটি দাঁড়িয়ে রয়েছে একা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনারই ব্যক্তিগত সততা সাহস মেধা ও দেশপ্রেমের ভাবমূর্তির ওপর। এটা একটা দেশ ও জাতির জন্য মোটেই সুখকর নয়। দেশ, দল ও সরকার পরিচালিত হওয়া উচিত আদর্শিক ও চেতনানির্ভর একটি টিমওয়ার্কের মাধ্যমে। চারদিকে অসৎ ও দুর্নীতিবাজচক্র পরিবেষ্টিত থেকে কোনো একক সৎ ব্যক্তির পক্ষে দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে কাঙ্ক্ষিত পথে এগিয়ে নেয়া যায় না। অন্যদিকে একক ব্যক্তির পক্ষে অগণন দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করাও সম্ভব নয়। এজন্য কৌশলে ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে দল ও দলের বাইরে অবস্থানরত শুভানুধ্যায়ীদের মধ্য থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত সৎ মেধাবী সাহসী ও ত্যাগী লোকদের বসিয়ে দিয়ে দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াচক্রকে ধরাশায়ী করার কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এরপর দলের জন্য ক্ষতিকর দুর্নীতিবাজ লুটেরা হাইব্রিড ও সুযোগসন্ধানীদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে বের করে দিয়ে সৎ সাহসী ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের দলে প্রতিস্থাপন করতে হবে। তৃতীয়ত: বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের ভিত্তিতে দেশকে পরিচালিত করার লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরিহার করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে রাষ্ট্র ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে। এসব কার্যক্রম শুরু করার পূর্বে শেখ হাসিনাকে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যাপারে সবিশেষ সজাগ থাকতে হবে।

বাঙালি জাতি বিশ্বাস করে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে এবং তাঁর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মশাল হাতে নিয়ে তাঁরই সুযোগ্যা কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব, যদি তিনি দল, প্রশাসন ও আর্থিকখাত থেকে দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের বলয় ভেঙে চুরমার করে বেরিয়ে আসতে পারেন।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।