ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » জাতীয় » বিস্তারিত

কেউ মনে রাখেনি শহীদ ক্রীড়াবিদ মুক্তিযোদ্ধা মিরাজউদ্দিনকে! 

২০২১ ডিসেম্বর ২৬ ১৭:২৫:৪৬
কেউ মনে রাখেনি শহীদ ক্রীড়াবিদ মুক্তিযোদ্ধা মিরাজউদ্দিনকে! 

সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু


পাকিস্তান ওলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী একমাত্র বাঙালী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বলতম এ্যাথলেট, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মিরাজউদ্দিন হারিয়ে যাচ্ছেন বিস্মৃতির অন্ধকারে। বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন, এ্যাথলেটিক ফেডারেশন কিংবা জাতীয় ক্রীড়াপরিষদ- কেউই মিরাজকে স্মরণ করে না।

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও জাতীয়ভাবে তো নয়ই, তার জন্মভূমি মানিকগঞ্জেও আলাদা করে কেউ তাকে মনে রাখবার তাগিদটুকুও বোধ করেননি। অথচ এই মিরাজেরই পাবার কথা ছিল দেশসেরা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সম্মান। যা আজ আমাদেরই অবহেলায় অন্যরা পাচ্ছে।

মানিকগঞ্জের প্রবীনেরা মোটামুটি চিনলেও অল্প বয়েসী যারা কালেভদ্রে স্টেডিয়ামে আসেন, তারা মিরাজ নামটাই শুধু জানে্‌ এর বেশি কিছু জানেন না। এ প্রজন্ম জানে না শহীদ মিরাজের বর্ণাঢ্য খেলোয়াড়ী জীবন কিংবা যোদ্ধাজীবনের একটি বর্ণও। জানাবার উদ্যোগও নেই কোথাও, কারও মধ্যে। মানিকগঞ্জ স্টেডিয়ামের নামফলকে শহীদ তপনের সাথে যৌথভাবে আছে তার নাম 'শহীদ মিরাজ-তপন স্টেডিয়াম' হিসেবে, মিরাজের প্রাপ্তি এটুকুই।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ, মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ভাটিকান্দা গ্রামে জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা পুরুষ, স্বাধীনতাপূর্ব সময়ের সেরা বাঙালী ক্রীড়াবিদ এ.কে.এম মিরাজউদ্দিন (আলোক)। মাত্র ১১ বছর বয়সে হারিয়েছিলেন বাবা শরীফ উদ্দিন আহমেদকে। বিধবা মা হাজেরা খাতুন তাকে তিল তিল করে বড় করেছিলেন মানুষের মত করে।

লেখাপড়ার হাতেখড়ি হরিরামপুরের লেছরাগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে। প্রাইমারি পেরিয়ে হরিরামপুরে পাটগ্রাম অনাথবন্ধু হাইস্কুল। এ স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণী পাশ করে ভর্তি হন ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউটে। এরপর ঢাকার জগন্নাথ কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

অসাধারণ গড়নের সুদর্শন মিরাজের ক্রীড়াখ্যাতি ঝলসে উঠেছিল স্কুল জীবনেই। তার প্রিয় ইভেন্ট ছিল পোলভল্ট, হার্ডলস এবং লং-জাম্প। ১৯৬৩ সালে আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে এ তিনটি ইভেণ্টে প্রথম হয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করেছিলেন মিরাজ।

১৯৬৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাতেও হয়েছিলেন ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন। ১৯৬৫ সালে আন্তঃকলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ঢাকার জগন্নাথ কলেজের হয়ে ১১০ মিটার হার্ডলস, পোলভল্ট এবং লং-জাম্পে নতুন জাতীয় রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন।

১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ১০ম পাকিস্তান অলিম্পিকে পোলভল্ট ইভেন্টে স্বর্ণপদক জয় করবার মত অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিলেন মিরাজ। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের খেলোয়াড়দের মধ্যে মিরাজই একমাত্র স্বর্ণপদকটি ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বিস্ময়ের বিষয় ছিল মিরাজ ১২.২ ফুট উচ্চতা অতিক্রম করেছিলেন বাঁশের পোল দিয়ে। সে সময়ের পাকিস্তান দলের এ্যাথলেটিক্স কোচ জার্মানীর হফম্যান বলেছিলেন 'এই ছেলেটি একটি ফাইবার পোল পেলে এশিয়ান গেমসের রেকর্ডও ভাংতে পারবে। বাঁশের পোল দিয়ে মিরাজের গড়া সেই রেকর্ড বহু বছর কেউ ভাঙতে পারেনি।

১৯৭০ সালে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনটি ইভেণ্টে প্রথম হয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করেছিলেন মিরাজউদ্দিন। একই সনে করাচী হকি ক্লাব মাঠে অনুষ্ঠিত ১২তম পাকিস্তান জাতীয় গেমসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়াদলের পতাকা হাতে মার্চপাস্টের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সেরা এ্যাথলেট হিসাবে মিরাজকে স্বীকৃতিও দিয়েছিল।

শুধু ক্রীড়াঙ্গনেই নিজেকে আটকে রাখেননি মিরাজ। জনপ্রিয়তা আর বন্ধুবাৎসল্য দিয়ে রাজনীতির মাঠও জয় করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিরাজউদ্দিন ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসিন হলের ক্রীড়া সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে মিউনিখ ওলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মিরাজ। কিন্তু তাতে যোগ দেবার সৌভাগ্য তার হয়নি। ২৫ মার্চের কালরাত্রি সব কিছু উল্টে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসহ শহরের অলিগলিতে নির্বিচার গণহত্যায় জ্বলে উঠে ট্র্যাক এণ্ড ফিল্ড কাঁপানো মিরাজের বিদ্রোহী মন। চেতনায় জ্বলে উঠে দেশ মাতৃকার মুক্তির গান। কালবিলম্ব না করে ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে আসেন হরিরামপুর গ্রামে, মায়ের কাছে। গ্রামে বসে সংগঠিত করতে থাকেন তরুণদের, লড়াই করতে হবে বলে।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিক। খবর আসে মানিকগঞ্জ ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে হরিরামপুরে ঘাঁটি গেড়েছেন মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ক্যাপ্টেন (অবঃ) আব্দুল হালিম চৌধুরী। বিধবা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর কাছে হাজির হন মিরাজ। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাননি তিনি। পোলভল্টের বাঁশের পোল ধরা হাতে আঁকড়ে ধরেন অস্ত্র। একটির পর একটি গেরিলা যুদ্ধ, আসতে থাকে জয়। যুদ্ধকালীন কমান্ডার তবারক হোসেন লুডুর নেতৃত্বে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে ঘটে ঐতিহাসিক গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধ। টাইগার লোকমান, নবাবগঞ্জের মনসুর, মিরাজদের মরণপণ হামলায় নিহত হয় ৮১ জন খানসেনা।

২ নভেম্বর ১৯৭১। যুদ্ধজয়ের নেশায় উন্মত্ত মিরাজদের উপর দায়িত্ব পড়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বানিয়াজুরি ব্রীজ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবার। রাতের আঁধারে শুরু হয় অপারেশন। কিন্তু বিধিবাম। ব্রিজে ডিনামাইট বসাতে গিয়ে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান মিরাজ। তাকে চিনতে দেরী হয়নি হানাদারদের। বন্দী মিরাজকে মানিকগঞ্জের ক্যাম্পে না রেখে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকার আর্মি হেড কোয়ার্টারে। এখানে জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলে নির্মম নির্যাতন। হাজারও নির্যাতনের মুখে মিরাজের কাছ থেকে সহযোদ্ধাদের কোন সত্য খবর বের করতে পারেনি তারা। এরই এক পর্যায়ে আহত মিরাজকে দেখানো হয় পাকিস্তান টেলিভিশনে। পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় দুস্কৃতি হিসেবে। জোর করে বলানো হয় অনেক কথা। তারপর তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

১৭ ডিসেম্বর স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেল সারা দেশ। স্বর্ণরাঙা সকালে মিরাজের ভাইসহ পরিবারের সবাই ছুটে যান কেন্দ্রীয় কারাগারে। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ তাদের নির্মম সত্যটি জানিয়ে দেন, ‘মিরাজ তাদের কাছে নেই’। ৮ ডিসেম্বর সকালে আলবদর বাহিনীর ডিরেক্টর মেজর মোস্তাক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মিরাজকে পাকবাহিনীর জীপে করে তুলে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে আজও কোন খোঁজ মেলেনি মিরাজের। আলবদর বাহিনী ক্রীড়াঙ্গণের এই নক্ষত্রকে চিনতো বলেই তাকে নিভিয়ে দেবার কথা ভুলেনি। স্বাধীনতার ৫০ টি বছরেও মিরাজের পরিবার খুঁজে পায়নি তার লাশের ঠিকানা, কবরের কোন চিহ্ন।

পাকিস্তানী শাসনামলে মিরাজের মত উজ্জ্বল নক্ষত্র ক্রীড়াঙ্গণে খুব বেশি ছিল না, যাকে নিয়ে ৭ কোটি বাঙালী গর্ব করতে পারতো। সেই গর্বের মিরাজ আজ তার রক্তে স্বাধীন ভূমিতেই পরবাসী বিস্মৃত এক অতীত। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াবিদ হিসেবে বাংলাদেশ মিরাজকে যেমন স্মরণে রাখেনি, তেমনি ভুলতে বসেছে তার নিজ জেলা মানিকগঞ্জও। মানিকগঞ্জ স্টেডিয়ামের নামকরণ করেই সব দায় শেষ করেছে মানিকগঞ্জ। মিরাজকে নিয়ে একটি স্মরণসভা কিংবা বছরান্তে একটি দোয়ার মাহফিলও হয়নি গত ৫০ বছরে,এই মানিকগঞ্জে। অথচ মিরাজেরই পাবার কথা ছিল দেশবরেণ্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াবিদের সম্মান।

লেখক : শিক্ষক ও সাংবাদিক।