ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

‘স্যার, আমি সেই জালাল, কানাইপুরের জালাল’

২০২২ জানুয়ারি ০৭ ১৫:৩১:৩৬
‘স্যার, আমি সেই জালাল, কানাইপুরের জালাল’

চৌধুরী আবদুল হান্নান


বেশ আগের কথা, আমি সোনালী ব্যাংক ফরিদপুর শাখার ম্যানেজারের দায়িত্বে। একজন অপরিচিত লোক চেম্বারে এসে আমাকে তার মেয়ের বিয়ের দাওয়াত পত্র দিয়ে বললো—‘স্যার, আমি সেই জালাল, কানাইপুরের জালাল, আপনি যখন কানাইপুর শাখার ম্যানেজার ছিলেন তখন আমাকে তিন হাজার টাকা লোন দিয়েছিলেন।’

আমি ফিরে গেলাম ৮০ র দশকের মাঝামাঝি সময়ে, কানাইপুর বাজারে জালালের একটি ছোট্টহোটেল ছিল ।ব্যাংকে আমরা কর্মী ছিলাম দশ বারো জন এবং তার হোটেল থেকে আমাদেরজন্য দুপুরের খাবার সরবরাহ করতো ।

একদিন আমার সহকর্মীরা সকলে মিলে আমাকে ধরলো জালালকে একটি ছোট লোন দিতেহবে। তখন ব্যাংকগুলোতে কৃষিঋণ বিতরণের মৌসুম চলছে, আমি নিজে খোঁজ নিলামজালালের। তার জমিজমা নেই, ভূমিহীন । ঋণ কীভাবে দেব ?

অবশেষে বর্গাচাষী দেখিয়ে তাকে তিন হাজার টাকা কৃষঋণ দেওয়া হয়েছিল , তাতে তার ছোটহোটেলটি পরিচালনায় পুঁজির ঘাটতি পূরণ হয়েছিল ।

কানাইপুর একটি ইউনিয়ন পর্যায়ের বাজার হলেও তখন এটা একটি পাটের মোকাম হিসেবেপ্রসিদ্ধ ছিল, অনেকগুলো পাট ক্রয়ের এজেন্সি ছিল আর ছিল একটি মাত্র ব্যাংক ।

চেম্বারে বসিয়ে জালালের সাথে অনেক কথা বললাম, তিন হাজার টাকা মূলধনে তার হোটেলব্যবসার ক্রমান্বয়ে শ্রীবৃদ্ধির গল্প শুনে আমি যারপর নেই মুগ্ধ হলাম । মনোযোগ দিয়ে শুনলামতিন হাজার টাকায় তার জীবনের বাঁক বদলের কথা । আরও ভালো লাগলো এই ভেবে যে, এখানে আমারও কিছু অবদান আছে । সে এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে, বসবাসের জন্যজমি কিনে টিনের ঘর দিয়েছে গ্রামে ।

তার হোটেল ব্যবসার প্রসার ও সুনাম দুই ই বৃদ্ধি পেয়েছে, বিভিন্ন প্রকার পিঠাসহ নানা পদেরখাবার তৈরি হয় তার হোটেলে, ভোজন রসিকদেরও আকৃষ্ট করে । বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চাহিদা মতোখাবার সরবরাহ করে থাকে । “জালালের হোটেলে” এখন নারী-পুরুষ মিলে আট দশজন লোক কাজ করে তাদের সংসার চালায় ।

জালাল আমাকে ভুলেনি, মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছে । দুই শতাধিক লোকের আয়োজন । দেশে এমন শত শত জালাল রয়েছে, যারা পরিশ্রমী কিন্ত কিছু একটা করার জন্য কোনো পুঁজিনেই । বলা হয়, আর চাকুরির পিছনে দৌড়ানো নয়, উদ্যোক্তা হতে হবে, হোক না তা ছোটআকারে ।

অভিজ্ঞজন বলেন, পরিশ্রম, সততা , উচ্চাশা থাকলে একদিন সফলতা আসবেই । যারা ছোটথেকে বড় হয়েছেন তাদের সকলের অভিজ্ঞতা এমনই এবং ইতিহাসও এমন সাক্ষ্য দেয়।

জালালের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার কাহিনী আমাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করিয়ে দিলো সোনালীব্যাংকের এক সময়ের ব্যবস্হাপনা পরিচালক স্বনামধন্য ব্যাংকার ব্যক্তিত্ব কে এ রশীদকে।

ব্যাংকের চাকুরিতে প্রবেশের প্রারম্ভে আমাদের ট্রেইনিং প্রোগ্রাম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্যাংকিং ওজীবন-ঘনিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে তিনি তিন ঘন্টার অধিক সময় বক্তব্য রেখেছিলেন, আমরামন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলাম।তাঁর কথার কিছু কিছু আজও মনে পড়ে, অনুপ্রেরণা দেয়।

আমাদের প্রত্যেকের সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত ( সি ভি ) সামনে নিয়ে একাডেমিক ব্যাক গ্রাউন্ডমনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন এবং বলেছিলেন, “আপনারা কিছু মনে করবেন না, আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী আপনাদের মতো অত মেধাবীদের ব্যাংকে খুব জরুরি নয়।বিসিএস দিয়ে প্রশাসনে বা সরকারি অন্যান্য লোভনীয় পেশা সকলকেই তো হাতছানি দেয় , হয়তো অনেকেই এমন সুযোগ পেলে ব্যাংকে থাকবেন না। তবে অন্যদের চেয়ে ব্যাংকারদেরএকটি বাড়তি ক্ষমতা বা সুযোগ আছে— আপনারা চাইলে কাউকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করেদিতে পারেন ।”

সরকারের নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলো বড় বড় শিল্প গড়ে তুলছে , কর্ম সংস্থান সৃষ্টি করেচলেছে এবং এ সব ক্ষেত্রে প্রভাবশালীরাই অগ্রাধীকার পায় ।অন্যদিকে যাদের কেউ নেই , পুঁজিনেই কিন্ত শক্ত কর্মীর হাত রয়েছে , তাদের বিরাট একটা অংশ আজও ব্যাংক-সেবার বাইরে । তাদের ব্যাংক-সহায়তা না দেয়ার পক্ষে বহু যুক্তি দাঁড় করানো যাবে এবং তাদের সহায়তা দেয়াপ্রায় অসম্ভব হবে কিন্ত অনুকূল মনোভাব নিয়ে , ভালো কাজের জন্য প্রয়োজনে ব্যাংক-বিধিরকিছুটা ব্যত্যয় ঘটিয়ে এ সব কর্মীর হাতকে সহায়তা করা খুব কঠিন নয়।

শাখা ব্যবস্থাপকগণ তাদের কমান্ড এরিয়ার মধ্যে এমন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে পারেন এবং তাতে এক সময় অপার এক সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচন হতে পারে।ভালো কাজে নিয়মের কিছুটা ব্যত্যয় ঘটানো দোষের কিছু নয়।

ব্যাংক ব্যবস্থা কত শক্ত নিয়ম কানুন দ্বারা পরিচালিত কিন্ত তাতে কী লাভ হয়েছে ? কিছু লোকতো নিয়মের বেড়াজাল ভেঙ্গে সব কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে আর এখন তো ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের দাপটে ব্যাংক অস্থির।

বিধিবদ্ধ নিয়ম দ্বারা পরিচালিত দেশব্যাপী ব্যাংকিং সেক্টরের যত বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে অন্যকোনো সেক্টরের তা নেই, ধারনা করি দশ হাজারের অধিক ব্যাংক শাখা কার্যকর রয়েছে দেশে।

ইচ্ছা করলে, দেশের জন্য কাজ করতে চাইলে এমনভাবে কর্ম সংস্থান সৃষ্টি এবং দেশের কৃষিক্ষেত্রে বা ক্ষুদ্র শিল্পে প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়েও উদ্যোক্তা তৈরি করা যায়।

এ সকল কাজ নির্ভর করবে শাখা ব্যবস্হাপকের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সদিচ্ছার ওপর , এ কাজ নাকরলে তাকে কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না।তবে কিছু মানুষ কর্মসূত্রে মানবিকতার ছোঁয়া রেখে যেতে চায়।

একজন অসচ্ছল ব্যক্তিকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্ভী করে দেয়ার মধ্যে অন্য রকম তৃপ্তি আছে, আর যখন এমন সফল কোনো ব্যক্তি কখনো এসে এমন করে কৃতজ্ঞতার সাথে বলে,— স্যার, আমি সেই জালাল, কানাইপুরের জালাল, তখন আত্মতৃপ্তির সীমা থাকে না ।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।